বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় রয়েছেন যাঁরা
২০২১ সালে বিশ্বে ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে বিবিসি। সমাজ, সংস্কৃতি ও বিশ্বকে নতুন করে সাজাতে যে নারীরা ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এবারের তালিকায় নাম থাকা ১০০ নারীর মধ্যে অর্ধেকই আফগানিস্তানের নাগরিক। এ ছাড়া স্থান পেয়েছেন নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই, সামোয়ার প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ফিয়ামে নাওমি মাতাফা, ভারতের আইনজীবী ও অধিকারকর্মী মঞ্জুলা প্রদীপ, সাবেক আফগান নারী পুলিশ সদস্য মোমেনা ইব্রাহিমি, আফগানিস্তানের বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের প্রথম নারী পাইলট মহাদেসি মিরজায়ির মতো নারীরাও।
আফগানিস্তানে কাজ করতে গিয়ে দমন-পীড়নের শিকার হওয়া নারীদের উৎসর্গ করে এবারের তালিকায় ৫০ জন আফগান নারীকে রাখা হয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন এবং ছবি দেননি।
যেভাবে ১০০ প্রভাবশালী নারী নির্বাচন করা হয়
১০০ প্রভাবশালী নারীকে বাছাই করার জন্য বিবিসির একটি দল কাজ করে থাকে। এ দলের সদস্যরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী নারীদের নামের তালিকা জমা দেন।
এরপর বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস নেটওয়ার্কের ভাষা নিয়ে কাজ করা দলের পরামর্শ অনুযায়ী ছোট একটি তালিকা তৈরি করা হয়। যেসব প্রার্থী গত এক বছরে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন, কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন কিংবা সমাজের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন; তাঁদেরই মূলত নির্বাচন করা হয়ে থাকে।
প্রতিবছর একেকটি থিমের ভিত্তিতে প্রভাবশালী নারী বাছাই করা হয়। এ বছরের থিম হলো, পৃথিবীর বদলে নারী। বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির কারণে অনেক মানুষই তাঁদের জীবনযাপনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে জীবনযাপনে পরিবর্তন ও যাপনের নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনে যে নারীরা ভূমিকা রেখেছেন, তাঁরা তালিকায় স্থান পেয়েছেন।
মালালা ইউসুফজাই
পাকিস্তানের নারী শিক্ষা আন্দোলনের কর্মী ও শান্তিতে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের নাম রয়েছে বিবিসির ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায়। ১১ বছর বয়স থেকেই পাকিস্তানে নারী শিক্ষার পক্ষে সরব মালালা।
তালেবান শাসনের অধীন জীবন এবং স্কুলে মেয়েদের নিষিদ্ধ করার মতো বিষয়ে বিবিসিতে ব্লগ লেখার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন মালালা। এসব কারণে এক বন্দুকধারী তাঁকে গুলি করে। ২০১২ সালের অক্টোবরে এ ঘটনা ঘটে। মাথায় গুলি লেগেছিল মালালার। সুস্থ হওয়ার পর মালালা ফান্ড নামে একটি সংগঠনের সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। এ সংগঠনের লক্ষ্য হলো এমন একটি বিশ্ব গড়ে তোলা, যেখানে প্রত্যেক নারী পড়াশোনা করতে পারবেন এবং নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন।
বিবিসিকে মালালা বলেন, ‘লাখো মেয়েশিশু আজ স্কুলে যেতে পারছে না। আমি এমন একটি বিশ্ব দেখতে চাই, যেখানে প্রত্যেক নারী ১২ বছর ধরে বিনা মূল্যে, নিরাপদে মানসম্পন্ন শিক্ষা পাবে। যেখানে সব নারীই শিক্ষিত হবে এবং এগিয়ে যাবে।’
মোমেনা ইব্রাহিমি
আফগান নারী পুলিশ সদস্য মোমেনা ইব্রাহিমির নাম রয়েছে এবারের বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায়। আফগান পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার তিন বছর পর ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন তিনি। এরপর নিজের নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা ও আফগান পুলিশ বাহিনীতে অন্য নিপীড়নের অভিযোগগুলো নিয়ে সরব হন মোমেনা। ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া নারীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে লড়াই শুরু করেন এই পুলিশ সদস্য। এর জন্য নানা হুমকি–ধমকিও সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। বিবিসিকে মোমেনা বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতাম, কাউকে না কাউকে সরব হতে হবে। ভাবলাম, সে মানুষ তো আমিও হতে পারি। এর জন্য আমার জীবন চলে যায় তো যাক।’ তালেবান ক্ষমতা দখল করার পর অন্য অনেকের মতো মোমেনাও যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নিয়েছেন।
মঞ্জুলা প্রদীপ
ভারতের আইনজীবী ও অধিকারকর্মী মঞ্জুলা প্রদীপ কাজ করেন দেশটির বঞ্চিত সম্প্রদায়গুলোর অধিকার আদায়ে। মঞ্জুলা প্রদীপের জন্মও গুজরাটের একটি দলিত পরিবারে। দলিত মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করা ভারতীয় সংগঠন নবসর্জন ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেন লিডারসেরও সহপ্রতিষ্ঠাতা মঞ্জুলা প্রদীপ। সংগঠনটি এ বছরই গড়ে তোলা হয়েছে। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমি সমবেদনাবোধ ও ভালোবাসায় ঘেরা এমন এক বিশ্ব দেখতে চাই, যেখানে শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণে নেতৃত্ব দেবেন সুবিধাবঞ্চিত নারীরা।’
জালা জাজাই
আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের প্রথম নারী উপপ্রধান জালা জাজাই। দেশটির প্রায় চার হাজার নারী পুলিশ সদস্যের একজন তিনি। পেশাগত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তুরস্কের পুলিশ একাডেমিতে। কাজে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় পুরুষ সহকর্মীদের হুমকি–ধমকির শিকার হয়েছেন। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তাঁকে হত্যারও হুমকি দিয়েছিল। গত আগস্টে তালেবান ক্ষমতা দখল করার পর দেশ ছাড়তে বাধ্য হন জাজাই। তখন থেকে আফগানিস্তানে লুকিয়ে থাকা অন্য নারী পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন তিনি।
এই নারী বলেন, ‘আবার ইউনিফর্ম গায়ে দিয়ে চিরাচরিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার স্বপ্ন দেখি আমি। যে আফগান নারীরা দুর্গম জায়গায় থাকেন এবং যাঁদের কাজ করার অধিকার নেই, তাঁদের হয়ে আবার কাজ করতে চাই।’
আনিসা শহীদ
আফগানিস্তানের শীর্ষস্থানীয় সংবাদকর্মীদের একজন আনিসা শহীদ। এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনীতি ও দুর্নীতি বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। আফগানিস্তানের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম টোলো নিউজে কাজ করতেন আনিসা। করোনাভাইরাসের প্রকোপ নিয়ে তাঁর তৈরি প্রতিবেদনকে সাহসী আখ্যা দিয়েছিল রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার। ২০২১ সালে আফগানিস্তানের ফ্রি স্পিচ হাব নেটওয়ার্ক তাঁকে বর্ষসেরা সাংবাদিক ঘোষণা করেছে।
একই সঙ্গে একজন নারী ও সংবাদকর্মী হিসেবে হুমকি–ধমকি পেয়ে আসছিলেন আনিসা। গত ১৫ আগস্ট তালেবান ক্ষমতা দখল করার পরপর আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হন এই সংবাদকর্মী। বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় নাম রয়েছে তাঁরও। আনিসা বলেন, ‘আফগানিস্তানে শান্তি দেখতে চাই। নারীদের মুখে হাসি দেখতে চাই। আমার আশা, একদিন দেশের বাড়িতে ফিরে যেতে পারব। কাজ করতে পারব সেখানে।’
ফিয়ামে নাওমি মাতাফা
বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় নাম রয়েছে সামোয়ার প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ফিয়ামে নাওমি মাতাফার। ২৭ বছর বয়সে রাজনীতিতে আগমন ঘটে এই নারীর। এর আগে সামোয়ায় উপপ্রধানমন্ত্রী, নারীবিষয়ক মন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন মাতাফা। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি সামোয়া। মাতাফা বলেন, ঐক্য থাকলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আশা টিকে থাকবে।
মহাদেসি মিরজায়ি
আফগানিস্তানের বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের প্রথম নারী পাইলট মহাদেসি মিরজায়ি। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের পাইলট হিসেবে যাত্রা শুরু হয় তাঁর। চলতি বছরের শুরুর দিকে কাম এয়ার বোয়িং ৭৩৭ পরিচালনা করেন মিরজায়ি।
এ ফ্লাইটের সব ক্রুও ছিলেন নারী। তালেবান কাবুল দখল করার পর অন্য একটি উড়োজাহাজে যাত্রী হিসেবে দেশ ছাড়েন তিনি। বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় স্থান পাওয়া মিরজায়ির আশা, আবার উড়োজাহাজ চালাবেন তিনি।
এ ছাড়া আফগানিস্তানের কবি লিমা আফশিদ, কেনিয়ার মানবাধিকারকর্মী হালিমা এডেন, পাকিস্তানের শারীরিক প্রতিবন্ধীদের অধিকার আন্দোলনের কর্মী আবিয়া করিম, আর্জেন্টিনার নেটফ্লিক্স পরিচালক ক্যারোলিনা গার্সিয়া, ইরানের পথচিত্রশিল্পী শামসিয়া হাসানির নামও রয়েছে তালিকায়।