২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আফ্রিকা কি নতুন আফগানিস্তান হচ্ছে

আফগানিস্তানে ২০০১ সালে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। এতে পতন হয় তালেবান সরকারের।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

চলতি বছরের ১৫ আগস্ট তালেবানের হাতে কাবুলের পতন হয়। এর মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা তালেবানের হাতে চলে যায়। আগস্টের শেষ দিকে আফগানিস্তান ত্যাগ করে মার্কিন বাহিনী। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের আফগান যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। গত দুই দশকে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। একই পরিস্থিতি এখন বিরাজ করছে পশ্চিম আফ্রিকায়। সেখানে সাহেল অঞ্চলের চূড়ান্ত আফগানিস্তানের মতো হতে চলেছে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। সম্প্রতি ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে এ আশঙ্কা করা হয়েছে।

আফগানিস্তানে সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধ চালাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অনেক মাশুল দিয়েছে। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক হাজার সেনা নিহত হয়েছেন। প্রতিবছর নভেম্বরে অনেক পশ্চিমা দেশ, রাজনীতিক, সেনাসদস্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁদের দেশের জন্য লড়াইয়ে নিহত যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এক সঙ্গে সমবেত হন।

আফগানিস্তানের গণমাধ্যমের ওপর নানা কড়াকড়ি আরোপ করেছে তালেবান সরকার।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

চলতি বছর এ স্মরণ–শ্রদ্ধা অনুষ্ঠানে আফগানিস্তানের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশের ৩ হাজার ৫০০-এর বেশি নিহত সেনাদের বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়। চলতি বছরের গ্রীষ্মে আফগানিস্তানে পশ্চিমা দেশের সেনা প্রত্যাহারের আগেই এ সেনাসদস্যরা নিহত হয়েছিলেন। এ ছাড়া আফ্রিকায় প্রাণ হারানো সেনাসদস্যদের এদিন বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লন্ডনের সেনোটাফ বা প্যারিসের আর্ক ডি ট্রিয়োম্ফে সমাহিত আছেন আফ্রিকার যুদ্ধে নিহত সেনারাও। পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে জিহাদিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তাঁরা। শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৯ হাজার সেনা সাহেল অঞ্চলে আবারও মোতায়েন রয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, আফগান যুদ্ধ শেষ হলেও সামগ্রিক যুদ্ধ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বিশ্বে চলমান এ যুদ্ধ ঠিক কীভাবে শেষ হবে, তা নির্ভর করছে আফগানিস্তানে নিজেদের ব্যর্থতা থেকে পশ্চিমারা যথাযথ শিক্ষা নিতে পারছে কি না, তার ওপর।

সাহেল অঞ্চলে আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে জিহাদিরা পশ্চিমা দেশগুলোকেই টার্গেটে রেখেছে। তাঁরা পশ্চিম আফ্রিকায় পশ্চিমা দেশগুলোর দূতাবাসে বোমা হামলা চালাচ্ছে।

অনেকেই যুক্তি দেখাতে পারে, যেখানে জাতীয় স্বার্থের ওপর কোনো ঝুঁকি বা চাপ নেই, সেখানে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। কিন্তু সাহেল অঞ্চলের পরিস্থিতি ঠিক এ রকম নয়। এ অঞ্চলে আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে জিহাদিরা পশ্চিমা দেশগুলোকেই টার্গেটে রেখেছে। তাঁরা পশ্চিম আফ্রিকায় পশ্চিমা দেশগুলোর দূতাবাসে বোমা হামলা চালাচ্ছে। সেখানে থাকা পশ্চিমা দেশের নাগরিকদের অপহরণ বা হত্যা করছে। জিহাদিদের যদি সুযোগ দেওয়া যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তাঁরা ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেও হামলা চালাবে।

নাম প্রকাশ না করে একজন পশ্চিমা জেনারেলের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালানোই জিহাদিদের মূল লক্ষ্য। আর এ ব্যাপারে তাঁদের কোনো রাখঢাক নেই।

তালেবান যোদ্ধারা কাবুল দখলের পর লোকজন ভয়ে দেশ ছাড়তে বিমানবন্দরে আশ্রয় নেয়। তাদের কেউ কেউ উড়োজাহাজের ককপিটেও চড়ে বসে।আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দরে
ফাইল ছবি: এএফপি

পশ্চিমা সরকারগুলো এ কারণেই এ অঞ্চলে তাদের স্বার্থ দেখছে এবং শক্ত অবস্থান নিয়েছে। আরেকটি কারণ হলো এ অঞ্চলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বুরকিনা ফাসো, মালি ও নাইজার। এসব দেশ দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। জনসংখ্যাও বেড়ে চলেছে জ্যামিতিক হারে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এসব দেশ সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। নাজুক এ দেশগুলোতে হামলা চালিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে জিহাদিদের খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। এতে ওই সব দেশের লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে, যাদের অধিকাংশই শরণার্থী হিসেবে ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে। এতে ইউরোপীয় বা পশ্চিমা দেশগুলোকে বাড়তি চাপ সামাল দিতে হবে।

এ বিপর্যয় কীভাবে রোধ করা যাবে? বিশ্লেষকেরা বলছেন, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আরেকটু ধৈর্য ধরতে পারত। কারণ, সেখানে তাদের সেনাসংখ্যা খুব একটা বেশি ছিল না। এ অল্পসংখ্যক সেনা দিয়েই আফগানিস্তানে তালেবানকে দমিয়ে রাখা যেত। এতে অনেক হতাহতের ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া যেত। এখন নিজেদের স্বার্থেই সাহেলে পশ্চিমা সরকারগুলোর দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে যাওয়াটাই উচিত হবে। বিশেষ করে ফ্রান্সের এ লড়াই চালিয়ে যেতেই হবে। এসব অঞ্চলে থাকা সেনাদের মধ্যে ফ্রান্সের সেনাসদস্যই বেশি রয়েছে। ফ্রান্সের সেনারা নিয়মিত সেখানে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালায়।

সোমালিয়ায় বেসামরিক লোকদের হত্যার জন্য উগান্ডা তার দুই শান্তিরক্ষীকে বিচারের মুখোমুখি করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। অপরাধী সেনারাও যে আইনের বাইরে নয় এবং তাদের শাস্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা–ই দেখিয়েছে উগান্ডা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে দ্রুত পূর্ণ গণতন্ত্র গড়ে তোলার চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের একদম বোকামি হয়েছে। এই একই কাজ সাহেলে করতে চাইলে তাদের কয়েক দশক সময় লেগে যেতে পারে। তবে সাহেলে গণতন্ত্র গড়ে তোলার চেষ্টা করার চেয়ে পশ্চিমাদের সামরিক সমাধানের প্রস্তাবের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে। আর এটা হতে হবে বাস্তবসম্মত, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য।

নব্বইয়ের দশকে নাইজার সংখ্যালঘু তুয়ারেগের বিদ্রোহ সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমেই মোকাবিলা করেছিল। সে সময় সেনারা জয়ী হয়েছিল। কারণ, তারা তুয়ারেগদের দেশের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও রাষ্ট্রের রাজস্বের অংশীদারত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মালিতেও ৪০টির বেশি স্থানীয় শান্তি চুক্তি দেশটিকে নির্ঘাত সংঘাত বন্ধ করে স্বস্তি দিয়েছিল। তবে এ চুক্তিকে দীর্ঘস্থায়ী ও সফল করতে বাইরের শক্তির অংশগ্রহণ বা সমর্থন দিতে হবে।

আফগানিস্তানে দেখা গেছে, অপ্রতিরোধ্য সামরিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় জনগণের সমর্থন ছাড়া বিদ্রোহ দমন করা অনেক কঠিন।

জঙ্গি দমনে বুরকিনা ফাসোর সেনাবাহিনীর অভিযান।
ফাইল ছবি: এএফপি

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সাব সাহারান সাহেল অঞ্চলে ক্ষমতায় থাকা বিশেষ করে পশ্চিমা সেনাদের বিরুদ্ধে যেকোনো কাজে ঘুষ নেওয়া, দুর্নীতি ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের কারণেই পশ্চিমা–সমর্থিত শাসনে আস্থা হারিয়ে বেসামরিক নাগরিকেরা বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। তারা জিহাদিদের পতাকাতলে আশ্রয় নিচ্ছে। আবারও অভ্যুত্থান হতে পারে, এ ভয়ে সেখানকার দুর্নীতিগ্রস্ত সেনাদের বিচারের মুখোমুখি করতে পারছে না সরকার। এ ক্ষেত্রে তারা চাইলে উদাহরণ হিসেবে নাইজারের দিকে তাকাতে পারে। কারণ, নাইজারে জিহাদি বা জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা বেশি থাকলেও দেশটির সরকার জাতিগত বিবাদে লিপ্ত গোষ্ঠীগুলোকে দ্বন্দ্ব থেকে নিরুৎসাহিত করতে পেরেছে। সেখানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অনেকটাই কমে এসেছে।

এদিকে উগান্ডাও সাহেলের সামনে দৃষ্টান্ত হতে পারে। কারণ, সোমালিয়ায় বেসামরিক লোকদের হত্যার জন্য উগান্ডা তার দুই শান্তিরক্ষীকে বিচারের মুখোমুখি করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। অপরাধী সেনারাও যে আইনের বাইরে নয় এবং তাদের শাস্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা–ই দেখিয়েছে উগান্ডা। এ ক্ষেত্রে সাহেলের শাসক চাইলে উগান্ডার পথ অনুসরণ করতে পারে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, পশ্চিমা শাসকদের তাদের ভোটারদের প্রতি যথেষ্ট সৎ থাকতে হবে। যদি তারা দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য সমর্থন না দেয়, তাহলে ফ্রান্স নেতৃত্বাধীন অভিযানে সেনাদের ক্লান্ত হওয়া পর্যন্ত জিহাদিরা অপেক্ষা করবে। আর এতে আফগানিস্তানের সঙ্গে যা ঘটেছে, হয়তো আফ্রিকাতেও সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এটা একটা উদ্বেগের বিষয়, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

ইকোনমিস্ট অবলম্বনে আবু হেনা মোস্তফা কামাল