সাধারণ মায়ের অসাধারণ গল্প
আমাদের বেশির ভাগ মায়ের মতোই ‘সাধারণ’ এক মায়ের গল্প শুনবেন? মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ সেই মা হঠাৎ একদিন ‘অসাধারণ’ হয়ে উঠেছিলেন! সিলেট শহর থেকে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে।
১৯৯৯ সালের কথা। বাজারে এসেছে নতুন দৈনিক পত্রিকা, নাম প্রথম আলো। অষ্টম শ্রেণির এক কিশোর প্রথম আলোর বড় ভক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা বাবার পছন্দে বাসায় রাখা হয় অন্য আরেকটি পত্রিকা। তাই সেই কিশোর সপ্তাহে তিন দিন স্কুল থেকে তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে বাসায় ফিরত। তাতে রিকশাভাড়াটা বেঁচে যেত, আর তা দিয়ে কিনত প্রথম আলো; শনিবার ‘ছুটির দিনে’, সোমবার ‘আলপিন’ আর বৃহস্পতিবার ‘আনন্দ’ সাময়িকীর লোভে। মাঝেমধ্যে মঙ্গলবারও, মানে যেদিন ‘নকশা’ বেরোত, সেদিনও প্রথম আলো কিনত মায়ের জন্য। মা খুব খুশি হতেন ‘নকশা’ পেয়ে।
২০০০ সালের কোনো এক বিকেলবেলা। ক্লাস শেষে কিশোর পত্রিকা স্ট্যান্ডে গিয়ে প্রথম আলো ওলটাতেই দেখে, ‘প্রাণ আচার প্রতিযোগিতা’র ঘোষণা ছাপা হয়েছে। সেদিন ছিল রোববার; কিশোরের পত্রিকা কেনার দিন নয়। তারপরও সে ব্যাগ ঝেড়ে টাকা বের করে পত্রিকাটি কিনে ফেলে। বাসায় গিয়েই ঘোষণাটি পড়ে শোনায় মাকে। আর বলে, ‘মা, চলো, আমরা আচার পাঠাই।’
মা হেসেই উড়িয়ে দেন, ‘আরে, কী বলিস, ওখানে কত বড় বড় মানুষ আচার পাঠাবে। কত ধরনের আচার। আমি বানাই গেরাইম্যা স্বাদের আচার। খাবেও না। আর থাকি আমরা ঢাকার বাইরে, পাঠানো ঝামেলা। তোর আব্বা টাকাও দেবে না, বিরক্ত হবে। বাদ দে রে বাবা।’
কিশোরের মনটা খারাপ হয়, ‘তুমি মা সব সময় শুধু “না না” করো। বিরক্ত লাগে। শুধু শুধু পেপারটা কিনলাম।’
মা বলেন, ‘তোরে কিনতে বলছে কে! শুধু শুধু কয়টা টাকা নষ্ট।’
মায়ের কথায় কিশোরের মন মানে না। কারণ, সে তো জানে, মায়ের হাতের আচারের তুলনা হয় না। এলাকার মানুষ নানান অছিলায় তার মায়ের হাতের আচার খেতে আসে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মন খারাপের কয়েকটি দিন কেটে বুধবার আসে। আচার জমা দেওয়ার আর মাত্র দুই দিন বাকি। মানে শনিবার শেষ তারিখ। বৃহস্পতিবার জমা দিলে শনিবার ঠিকঠাকমতো পৌঁছানোর কথা। সব ভেবে কিশোর মায়ের কাছে অনুনয় করে, ‘মা, তুমি শুধু একটা করে আচার দাও প্রতি বিভাগের জন্য—টক, ঝাল, মিষ্টি আর সম্মিলিত বিভাগ; বেশি না তো। লেবেল বানানো, বয়াম সাজানো আমি ম্যানেজ করব। চলো, মাঠে নামি।’
মায়ের মুখে সেই পুরোনো কথা, ‘পড়াশোনা ফেলে তুই যে কী পাগলামি করস। তোর বাবা শুনলে তোরে ঝাড়ি দেবে, পরে তোর জন্য আমিও কথা শুনব।’
‘বাবা ঘুমালে আমরা লেবেল বানাবোনে, মা।’ কিশোর এবার নির্দেশ দিয়ে বসে, ‘তুমি আচার রেডি করো।’
রাতে বাবা ঘুমাল, পাড়া জুড়াল। মা-ছেলে মিলে বসল বয়ামের লেবেল বানাতে। মা আচারের নাম, রেসিপি, মেয়াদ ছেলেকে গুছিয়ে বললেন। ছেলে সেগুলো লেবেলে লিখে স্কচটেপ দিয়ে কাচের বয়ামে সেঁটে দিল। সদ্যই স্কুলে ভর্তি হওয়া ছোট বোনটা থাকল প্রহরীর ভূমিকায়; বাবার ঘুম ভাঙলেই যেন সে জানান দেয়।
আম, তেঁতুল, জলপাই আর আম-রসুন—চার পদের আচার বানালেন মা। তারপর সেগুলো ভরে দিলেন ব্যাগে। পরদিন সকালে ছেলে একটু আগেই বের হলো কুরিয়ার সার্ভিসের উদ্দেশ্যে। আচার পাঠানোর খরচ বাবদ ছেলের হাতে ৬০ টাকা দিয়ে মা বললেন, ‘খরচ বেশি হইলে পাঠানোর দরকার নাই। চলে আসিস।’
স্কুলের পাশেই কুরিয়ার সার্ভিসের একটি বুথ খোলা পেল কিশোর। সেখানকার লোকজন বললেন, ‘এভাবে পলিথিনে মোড়ানো কাচের বোতলে আচার পাঠানো যাবে না। ভেঙে যাবে। কার্টনে সুন্দর করে প্যাক করে পাঠাতে হবে। চারটা বয়াম ২৫ টাকা করে টোটাল ১০০ টাকা খরচ পড়বে। শনিবার সকালেই পৌঁছে যাবে আচার।’
কিশোর পড়ল বিপদে, পকেটে আছে ৬০ টাকা। আর ৪০ টাকা কোথায় পাবে সে? হঠাৎ তার মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। স্কুলে গিয়ে ব্যাগে থাকা সেবা প্রকাশনীর নতুন তিনটি ‘তিন গোয়েন্দা’র বই ৪৫ টাকায় বিক্রি করে দিল এক বন্ধুর কাছে। তারপর বাসার কাজের মিথ্যা অজুহাত দিয়ে চার পিরিয়ড পরই বেরিয়ে গেল ক্লাস থেকে। সেদিন দুপুরে আচারগুলো কার্টনে সাজিয়ে পাঠানোর পর স্বস্তির এক বিশাল নিশ্বাস ছাড়ল কিশোর।
এক মাস পরের কথা। বাবার কাছে চিঠি এসেছে ঢাকা থেকে। বাবা গম্ভীরমুখে চিঠি খুলে পড়ার পর মা-ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কি কোথাও আচার পাঠাইছিলা? ওরা চিঠি পাঠাইছে। তোমার আচার চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হইছে। সামনের সপ্তাহে প্রোগ্রাম। ওরা দাওয়াত দিছে যাওয়ার জন্য।’
আনন্দে চিৎকার করে উঠল কিশোর। বাবাকে বলল, ‘চলো না বাবা, আমরা যাই! কত বড় জায়গা থেকে দাওয়াত আসছে!’
বাবা ধমকে ওঠেন, ‘এখনো বাসাভাড়া দিই নাই; সেই চিন্তায় আমি শেষ। আর তোমরা আছ ঢাকায় যাওয়া নিয়ে। কত খরচ, জানো? আর কত বড় বড় জায়গার মানুষ আচার পাঠাইছে দেখো গিয়া। যাও, পড়তে যাও। আমি সামনের সপ্তাহে ওদের অফিসে ফোন দিয়ে রেজাল্ট জেনে নিবোনে।’
মন ভেঙে গেল কিশোরের। সে জানে, মুখে এসব বললেও বাবারও ইচ্ছা ছিল, তিনি আদতে নিরুপায়। কিশোর মন খারাপ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। স্বল্পভাষী মা কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেলেন। কিশোরের কাছে মনে হলো, তারা সবাই পাকা অভিনেতা-অভিনেত্রী। আর তাদের এই অভিনয়প্রতিভার কথা নিজেরা ছাড়া কেউ জানে না।
পরের সপ্তাহের শনিবার ঘটে গেল ধুন্ধুমার ঘটনা। আগের দিন ‘প্রাণ আচার প্রতিযোগিতা’র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হয়ে গেছে। কিশোর ছেলেটির সে কথা মনেও ছিল না। রাগে-অভিমানে সে আমন্ত্রণপত্র খুলে পড়েওনি। অন্যান্য শনিবারের মতো ক্লাস শেষে পত্রিকা স্ট্যান্ডের দিকে এগোয় সে। আজ বাসায় হেঁটে ফেরার দিন। কারণ, আজ শনিবার প্রথম আলো কেনার দিন। পত্রিকা কেনার সময় পৃষ্ঠা ওলটাতে গিয়ে কিশোর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না! প্রথম আলোর তৃতীয় পৃষ্ঠার একদম ওপরের দিকে ডান পাশে আচার প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণের খবর ছাপা হয়েছে। সেখানে সম্মিলিত বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে লেখা হয়েছে তাঁর মায়ের নাম—সুফিয়া আক্তার!
কিশোর পুরো লেখা পড়ে শেষ করতে পারে না। ছুট লাগায় বাসার দিকে। তার মনে হতে থাকে, পৃথিবীতে তার মতো গর্বিত, আনন্দিত আর কেউ নেই। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে, ‘আমার মা সেরা! আমার মা জিতছে!’
গল্পটি সত্যি। অসংখ্য না পাওয়ার গল্পে বড় হওয়া, অভিমানী সেই কিশোর আমি ফাহিম হাসান। আর সেই সহজ-সরল কিন্তু অসাধারণ নারীটি আমার মা। মা দিবসে পুরোনো দিনের কথা ভেবে সেদিনের আনন্দই ফিরে পেলাম। ভালো থাকুক সব মা। পৃথিবীর সব মায়ের জন্য ভালোবাসা।