বাইক-কসরতে কাইয়ুমের চমক
‘নিরাপত্তা, নিরাপত্তা, নিরাপত্তা’।
একবার নয়। পরপর তিনবার একই শব্দ উচ্চারণ করলেন আব্দুল কাইয়ুম। ব্যাপারটা আঁতকে ওঠার মতো কিছু নয়। ১৮ নভেম্বর তিনি ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে এসেছিলেন। তাঁর জীবনের গল্প শুনতে শুনতেই প্রশ্নটা করছিলাম, ‘নতুন কেউ যদি মোটরবাইক কসরত শিখতে চায়?’ সেটির উত্তরেই একই শব্দ তিনবার উচ্চারণ করেছিলেন।
কাইয়ুম মনে করিয়ে দেন, হুটহাট কসরতের চমক দেখাতে চাওয়া বোকামো। ঘটতে পারে বিপজ্জনক কিছু। তাই জানতে হবে কৌশল, করতে হবে নিয়মিত অনুশীলন। সেগুলোও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামে প্রস্তুত হয়ে।
আলাপ শুরু হয়েছিল কাইয়ুমের কসরত শেখার গল্প দিয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোটরসাইকেল স্টান্টের আনুষ্ঠানিক চল থাকলেও বাংলাদেশে অনেকটাই অপ্রচলিত। যাঁরা অংশ নেন, রোমাঞ্চের টানেই স্টান্ট করেন। ৩১ বছর বয়সী কাইয়ুমও জড়িয়েছেন রোমাঞ্চের টানে।
বাইকার বয়েজ ছবিটি কখন দেখেছিলেন, সময়টা হলফ করে বলতে পারলেন না। তবে পরিষ্কার মনে করতে পারলেন, হলিউডের এই সিনেমা মোটরবাইকের কারিকুরির প্রতি তীব্র আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছিল। সে আগ্রহ এখনো অটুট। তাই তো মোটরবাইক হাঁকিয়ে নতুন নতুন কসরত রপ্ত করেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন, দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন।
‘কত রকম স্টান্ট দেখাতে পারেন?’
‘৩৬০ ডিগ্রি (মাটিতে পা রেখে বাইক ঘোরানো), ক্রাইস্ট (সিট বা তেলের ট্যাংকের ওপর দাঁড়িয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বাইক চালানো), নানা ধরনের হুইলি (সামনের চাকা তুলে চালানো, পেছনের চাকা তুলে চালানো...)’। প্রশ্ন শুনেই পটাপট কয়েকটি স্টান্টের নাম বলে থামলেন। এরপর রীতিমতো আঙুলের কড়া গুনে গুনে বললেন, ‘হবে তো ১৯ কি ২০ ধরনের’। এসব কৌশল তিনি রপ্ত করেছেন নিজ আগ্রহে, শখের বশে। কখনো ইউটিউবে, কখনো বিদেশি স্টান্ট ম্যানিয়ার অনুষ্ঠান দেখে।
শেখার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। দেশে অনুষ্ঠিত স্টান্টভিত্তিক প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান পালসার স্টান্ট ম্যানিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন। প্রথম আসরেই শত শত প্রতিযোগীকে হারিয়ে তিনি হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন। কয়েকটি পর্বে টিভির পর্দায় তাঁর কারিকুরি দেখেছে হাজারো দর্শক। সবশেষে, বিচারকদের রায়ে ৮ নভেম্বর এক জমকালো অনুষ্ঠানে ঘোষণা করা হয় বিজয়ী হিসেবে তাঁর নাম। চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তিনি পেয়েছেন ১০ লাখ টাকা এবং একটি নতুন মোটরবাইক।
সেই পুরস্কার বুঝে নিতেই মাদারীপুরের শিবচর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। শিবচরের দত্তপাড়ার এই তরুণ পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বাড়ি থেকেই প্রায়ই ঢাকায় আসেন অনুশীলন করতে। দলের সদস্যদের সঙ্গে অনুশীলন করেন, অংশ নেন কোনো ফরমায়েশি অনুষ্ঠান থাকলে।
লুকিয়ে শুরু
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দনিয়া কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেছেন ২০০৬ সালে। পড়াশোনার চেয়ে মনোযোগটা ব্যবসার দিকেই ছিল। তাই পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে কাজ নেন খালুর আইপিএস (ইনস্ট্যান্ট পাওয়ার সাপ্লাই) তৈরির কারখানায়। প্রতিদিনই আইপিএস নিয়ে ছুটে যেতেন রাজধানীর এদিক-সেদিক। কখনো যেতেন বকেয়া টাকার তুলতে। সে সময় খালুর বাইকটা পেতেন সহজে।
বাইকার বয়েজ সিনেমার দৃশ্যগুলো মাথায় ঘুরপাক খায়। কিন্তু সাহসে কুলায় না তেমন কিছু করার। খুঁজতে থাকেন কীভাবে স্টান্ট শেখা যায়। ইন্টারনেট তখনো সহজলভ্য নয়। ইউটিউবেও তেমন কিছু পাওয়া যায় না।
২০১১ সালের একদিন হঠাৎই কাইয়ুমের চোখ আটকে গেল টিভি পর্দায়। ভারতীয় একটি চ্যানেলে পালসার স্টান্ট ম্যানিয়ার দ্বিতীয় আসরের কোনো একটি পর্ব দেখানো হচ্ছিল। সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। পাহাড়ে-পর্বতে মোটরবাইক হাঁকিয়ে নানা কসরত করছেন তরুণ অংশগ্রহণকারীরা। বাইকটাকে যেন মন্ত্রবলে বশ করেছেন প্রত্যেকে। চালকের ইচ্ছা অনুযায়ী সেটা এক চাকায় ভর করে চলছে, কখনো পেছনের চাকা দিয়ে শাঁ শাঁ করে ভেঙে দিচ্ছে মাটির হাঁড়ি...এমন আর কত–কী।
মোটরবাইক স্টান্টের পুষে রাখা স্বপ্নটা যেন জ্বলে উঠল। শেখার জন্য অস্থির হয়ে গেলেন। একদিন বাইক সারাইখানায় খোঁজ পেয়ে গেলেন স্টান্টম্যানদের একটি সংগঠনের। যোগাযোগ করেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মিথুন মৃধার সঙ্গে। ২০১২ সালের নভেম্বরের কোনো এক বিকেলে প্রথম দেখায় মিথুন জানিয়ে দিলেন, ‘দলে আমন্ত্রণ, তবে সবার আগে নিরাপত্তা।’
বংশালে ছুটে গেলেন কাইয়ুম। মোটরবাইকের দোকান ঘুরে কিনলেন স্টান্ট করার নিরাপত্তাসরঞ্জাম। দুই-এক দিন পর এল শুক্রবার, শুরু হলো তাঁর স্টান্ট শেখার অ, আ, ক, খ। রাজধানীর আফতাব নগর, ৩০০ ফুট সড়ক, ভাটারা, সাভার, হেমায়েতপুরসহ মানুষের আনাগোনা কম, এমন খোলা জায়গা বেছে নেন। অনুশীলন চলল। দিনে দিনে বেশ কিছু কসরত রপ্ত করলেন কাইয়ুম। দলের অন্য সদস্যদের কাছের মানুষ হয়ে গেলেন। কাইয়ুম বলছিলেন, ‘বাংলাদেশে স্টান্ট শিখতে এমন দলের সঙ্গেই যুক্ত হতে হয়। তাই সেটা ছিল আমার জন্য এক আনন্দের মুহূর্ত। যদিও দলের সবাই নিজের চেষ্টাতেই শেখে। তবু দলগতভাবে থাকলে নতুন কোনো কসরত কেউ শিখে ফেললে, সেই কৌশলটা সম্পর্কে জানা যায়, দেখিয়ে নেওয়া যায়।’
কিন্তু কাইয়ুমের গোপন দুনিয়ার কথা তখনো পরিবারের কেউ জানে না। প্রতি বৃহস্পতিবার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম রেখে আসেন সারাইখানায়। শুক্রবার মোটরবাইক নিয়ে ছোটেন অনুশীলনে। প্রতিবার অনুশীলন করার পরই গাড়ির কিছু না কিছু ক্ষতি হতো। সন্ধ্যায় সারাই করে ফিরতেন বাড়ি। দেখা গেল, কাইয়ুম যা বেতন পেতেন, তার পুরোটাই চলে যাচ্ছে গাড়ি সারাই আর তেল খরচে।
‘আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন, বড় ভাই প্রবাসী। তাই বেতনের পুরো টাকাটা নিজের মতো খরচ করতে পারতাম।’ বলেন কাইয়ুম।
কিন্তু তত দিনে পরিবারে জেনে গেছে কাইয়ুমের ভিন্ন জগৎ সম্পর্কে। কাইয়ুম যাকে ভাবছে দুঃসাহসী খেলা, পাড়া-প্রতিবেশীর কথায় পরিবার ভাবছে, ছেলেটা বখে গেছে। মা–বাবার দুশ্চিন্তা, এমন ঝুঁকিপূর্ণ কসরত করতে গিয়ে ছেলের যদি কিছু হয়ে যায়। কাইয়ুমের কাছে সে এক বিপত্তি।
সেই বিপত্তির জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে অনুশীলন করেন। নতুন কোনো কসরত সফলভাবে শিখেন, ভেতরে-ভেতরে অসম্ভব ভালো লাগা নিয়ে ঘুরে বেড়ান, কিন্তু সে রোমাঞ্চের কথা কাউকে বলতেই পারেন না। তিনি যেমনটি বলছিলেন, ‘অনেকে নেতিবাচকভাবে নেয় বলে কিছুদিন আগে পর্যন্ত ফেসবুকে আমার প্রোফাইলে নিজের কোনো ছবি আপলোড করতাম না।’
তবে একসময় সবাই জানল। তত দিনে ডাক পেয়েছেন টেলিভিশন অনুষ্ঠানে। তাঁদের দলের কারিকুরির ভিডিও প্রচার হয়েছে টেলিভিশনে। প্রতিবেদন হয়েছে পত্রিকায়। অনেকে দেখলেন, পড়লেন। কেউ কেউ বাহবা দিলেন, তাচ্ছিল্যও জুটল কারও কারও কাছে। কিন্তু এসব গায়ে মাখলেন না কাইয়ুম, ‘আমি তো নেশা করছি না, খারাপ কোনো কাজও করছি না। কত জনের কত শখ থাকে, আমার শখ নাহয় এটা।’
প্রশংসা দেখাচ্ছে স্বপ্ন
সেই কাইয়ুম এখন পরিচিতদের কাছে নায়ক বনে গেছেন। টিভি অনুষ্ঠানে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বেশ বাহবা জুটেছে ভাগ্যে। গ্র্যান্ড ফিনালের জমকালো অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। মঞ্চে যখন রঙিন আলোয় উদ্ভাসিত হলো কাইয়ুমের মুখ, হাজারো করতালিতে বরণ করে নিল স্টান্ট চ্যাম্পিয়ন কাইয়ুমকে, তখন নাকি আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলেন পরিবারের সদস্যরাও।
‘সেই মুহূর্তটা আমার জীবনের সেরা পাওয়া’, বলেন কাইয়ুম।
সবার আনন্দই স্বপ্ন দেখাচ্ছে কাইয়ুমকে। এখন তিনি ওয়ার্ল্ড মোটরবাইক স্টান্ট চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে চান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোটরসাইকেল স্টান্ট চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়। সেসব আয়োজনে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চান তিনি। তবে সে পথটা তাঁর জন্য সহজ নয়। কাইয়ুম হয়তো মনে মনে বলেন, ‘সহজ নয় বলেই তো সে পথে হাঁটতে চাই আমি!’