বিশ্ববিদ্যালয় আমার জীবনকে স্বাভাবিক করেছে
মাত্র ৯ বছর বয়স থেকে খ্যাতির স্বাদ পেয়েছেন ব্রিটিশ অভিনেত্রী এমা ওয়াটসন। ‘হ্যারি পটার’ সিরিজের সেই শিশুশিল্পী এমা এখন বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন। অভিনয়ের পাশাপাশি সমাজকর্মী ও নারীবাদী হিসেবেও তিনি পরিচিত। আগামী এপ্রিল মাসে তাঁর বয়স ৩০ ছোঁবে। সম্প্রতি জীবনের নানা দিক, দর্শন আর উপলব্ধির কথা এমা বলেছেন ভোগ সাময়িকীর ব্রিটিশ সংস্করণে।
একটা দারুণ উক্তি কোথাও শুনেছিলাম—‘যখন দুর্যোগ আসে, শিল্পীর আসল কাজ শুরু হয় তখনই। কোমর বেঁধে তাঁরা নামেন দুর্যোগের মোকাবিলায়।’ যেকোনো পরিস্থিতিতে সমাজের বাস্তবতা সবার সামনে তুলে ধরেন একজন শিল্পী, তিনি পরিস্থিতিটা সবার সামনে বোধগম্য করে তোলেন। একটা যুদ্ধ, একটা দুর্যোগ কত দিক থেকে, কতভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, তা মানুষকে শৈল্পিকভাবে একজন শিল্পীই বোঝাতে পারেন। তাই আমি সব সময় নিজেকে সাধারণ মানুষের বাস্তব গল্পের ছাঁচে ঢেলে দেখতে চাই।
আমি এমন সাধারণ মানুষ আর শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাই, যাঁরা জুড়ে থাকেন বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে, যাঁরা চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর খবর রাখেন। ‘রাতে আমার ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না’—কেবল এ ধরনের সামাজিকতা রক্ষার আলাপে থাকতে আমার ভালো লাগে না। একেক সময় একেক ধরনের মানুষের সঙ্গে মেশা, একটা গল্পকে আরেকটার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া, বাস্তবতার কাছাকাছি থাকাকে আমার কাছে মনে হয় একজন শিল্পীর দায়িত্ব।
তবে আমি সৌভাগ্যবান। মাত্র ৯ বছর বয়সেই আমি এমন জীবনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলাম, যেখানে আসলে স্বাভাবিকতার কোনো ছিটেফোঁটাও ছিল না। মনে হতো আমি কোনো একটা কাল্পনিক যাত্রায় আছি, যেখানে সবকিছুই কেমন যেন উচ্চকিত। মনে হতো আমি আছি ম্যাট্রিক্স ছবির ভেতর, প্রতি মুহূর্তে আমার দিকে ধেয়ে আসছে একেকটা বুলেট, আমার মাথার পাশ দিয়ে, কান ঘেঁষে সেগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে!
জীবনের এই অবাস্তব পর্যায় থেকে আমার বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ত, যদি ঠিক সময়ে স্বাভাবিক জীবনে আসার চেষ্টা না করতাম। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে তাই খানিকটা গর্ববোধ করি। এ কারণেই এমনভাবে জীবন যাপন করতে পেরেছি, যেটা আমার শৈশবে পাইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ডিগ্রিগুলোর কারণে এখন জীবনের অনেক কিছুই আমার কাছে অর্থবহ লাগে, স্বাভাবিক লাগে।
তবে একটা বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ঢুকেও আমি কিছু কিছু জায়গায় হোঁচট খেয়েছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতকের সময় ইতিহাস পড়তে গিয়ে উপলব্ধি করলাম, বিষয়টা আপেক্ষিক। ইতিহাসের সত্যতা নির্ভর করে আমি ঘটনাটা কার মুখ থেকে শুনছি তার ওপর। ইতিহাসের ক্লাসে বসে আমি শুরুতেই একটা ধাক্কা খেয়েছি। কারণ, সেখানে দাসত্ব বা বর্ণবৈষম্যের রূঢ় ইতিহাস নিয়ে তেমন কিছুই বলা হয়নি। যেখানে কিনা আমাদের পশ্চিমের গোড়পত্তন থেকেই শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের শাসন করত নির্মমভাবে আর আমাদের সভ্যতা সেই ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের পাঠ্যসূচিতে এসব নিয়ে খোলামেলা আলোচনা নেই। ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখলাম, এসব নিয়ে কেউ কোনো কথাই বলছে না।
আমি দেখলাম, ছেলেবেলা থেকে আমি বাড়িতে যা পড়েছি, জেনেছি, শিখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কিছুই মিলছে না। তখন বুঝলাম, ইতিহাস নির্ভর করে স্থান, পাত্র আর দৃষ্টিভঙ্গির ওপর, কার মুখ থেকে ইতিহাস বর্ণনা করা হচ্ছে তার ওপর। এ পর্যায়ে এসে আমার মনে হয়, শিক্ষাব্যবস্থায় এখন আর এই আংশিক ইতিহাস শিক্ষার কোনো অবকাশ নেই। আমাদের সবারই সবটা জানার অধিকার আছে। সময় এসেছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর। আমরা কী পড়ছি, কেন পড়ছি, কোন বিষয় আমাদের পাঠ্য করা হচ্ছে, সেটা কীভাবে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করবে, এই পাঠ্যসূচি দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো কীভাবে দৃঢ় করা যাবে—এসব ভাবতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে। নয়তো এই আংশিক ইতিহাস পড়ে পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্থহীন হয়ে পড়বে। এত পড়ালেখার কোনো মূল্যই থাকবে না।
ইদানীং আরেকটা বিষয় হচ্ছে আমার সঙ্গে, আমি সেটারও কোনো অর্থ খুঁজে পাই না। আমার বয়স এবার ৩০ হতে যাচ্ছে। আশপাশের সবাইকে দেখি এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হতে। কিন্তু আমি এর কোনো মানে বুঝতে পারছি না। ৩০–এর কাছাকাছি যেতেই আমি দেখছি কিছু তথাকথিত প্রশ্ন আমার দিকে তেড়ে আসছে, কিছু গৎবাঁধা ধারণা আমাকে জেঁকে ধরেছে। হঠাৎ করেই দেখি অনেকে কিছু কথা আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিতে চাইছে। যেমন ধরুন—৩০–এর আগে আমি যদি নিজের বাড়ি করতে না পারি, বিয়ে করতে না পারি, বাচ্চা নিতে না পারি, তাহলে আমার সব অর্জন বৃথা! এই বয়সেও আমার স্বামী না থাকা, সন্তান না থাকাকে অনেকেই একটা দুশ্চিন্তার বিষয় বলে মনে করছে। সবার এই দুশ্চিন্তা আমাকে ভাবাচ্ছে। আমি এর কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ, আমার জীবনে এর বাইরেও অনেক চিন্তা রয়েছে।
কোনো কনসার্টে গিয়ে অনেকের ভিড়ে হারিয়ে যেতে আমার খুব ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে সবার মতো চিৎকার করে গান গেয়ে কনসার্টটা উপভোগ করতে। কিন্তু একেবারে অল্প বয়স থেকেই যে খ্যাতি আমি পেয়েছি, তা আমাকে সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। আমি সবার মতো এই স্বাভাবিক বিষয়গুলো ভাবতেই পারি না। একটা সময় এমন হয়েছিল যে আমার কাছে সবকিছু অস্বাভাবিক লাগত। হ্যারি পটার ছবির খ্যাতিটা তখন এমনই বড় প্রভাব আমার ওপর ফেলেছিল যে আমি মা-বাবাকে প্রশ্ন করতাম—‘আচ্ছা, আমি কি এখনো তোমাদের মেয়ে? তোমরা কি এখনো আমাকে আর সব সন্তানের মতোই ভালোবাসো?’ কারণ, আমার কাছে সবকিছুই উচ্চকিত মনে হতো।
একটা সময় ভাবতে শুরু করলাম, ‘কেন আমার সঙ্গেই এমন হলো? আমি কি আদৌ এত খ্যাতি পাওয়ার যোগ্য?’ আমার নিজেকে অপরাধী লাগত। আমি তো কোনো অভিনয়ের স্কুলেও পড়তাম না। আমার প্রাথমিক স্কুলের জিমনেসিয়ামে হয়েছিল হ্যারি পটার–এর অডিশন। সেখান থেকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আমি পেয়ে যাই হারমিয়নের চরিত্রটি। তারপর যেন একটা বিরাট বিস্ফোরণই ঘটল জীবনে। তারকাখ্যাতি পাওয়ার আগের জীবনটা কেমন ছিল, এখন আর সেটা মনে পড়ে না। মনের ভেতরের এই অস্থিরতা আর অশান্তি দূর করার জন্য থেরাপি শুরু করি। নিজেকে নানাভাবে শান্ত করার চেষ্টা শুরু করি। যোগব্যায়াম শুরু করি। তারপর একটা সময় আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আর সব সাধারণ শিক্ষার্থীর সঙ্গে ক্লাস শুরু করলাম, পড়তে শুরু করলাম, তখন থেকে একটু একটু স্থিরতা খুঁজে পেলাম।
এমনকি এখন আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও স্থিরতা আর অনুপ্রেরণা খুঁজে পাই। অনেকেই বলে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় নেতিবাচক মন্তব্য এড়িয়ে গেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুব উপকারী। এখান থেকে এমন কিছু গঠনমূলক সমালোচনা আমি পেয়েছি, যা কখনোই কেউ হয়তো আমার সামনে এসে বলত না। আবার এই মাধ্যমের কারণেই অনেকের কাছ থেকে এমন কিছু মন্তব্য আমি পেয়েছি, যাদের আওয়াজ হয়তো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আমার কাছে পৌঁছাত না।
একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি প্রতিবছর ১০ দিনের জন্য মৌনব্রত পালন করি। যেখানে আমি এই ব্রত পালন করতে যাই, সেখানে সবাই মূলত বয়স্ক। আমার বয়সী একজন মেয়ের সঙ্গে একবার পরিচয় হয়েছিল। সে আমাকে জানায়, ভারতের এক প্রত্যন্ত এলাকার আশ্রমে থাকে সে। নিয়মিত সে আমার ইনস্টাগ্রাম আর টুইটার অনুসরণ করে। আমাকে বলেছিল, ‘কখনো যদি মনে হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো ভালো কিছু নেই, তাহলে আমার কথা মনে কোরো। জেনো, আমি তোমার একেকটা কথা শোনার জন্য, তোমার লেখা পড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকি।’
অনুবাদ: আদর রহমান