ভিনদেশে গিয়ে পোলিও নির্মূল
>বাংলাদেশি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আনিস রহমান সিদ্দিকী। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) হয়ে পোলিও নির্মূলে কাজ করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সংস্থাটিতে তিনি কমিউনিকেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চিফ এবং পোলিও টিম লিড হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়েই তিনি পোলিওমুক্ত করেছেন আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়াকে। এর আগে ভারত পোলিওমুক্ত করাতেও রেখেছেন ভূমিকা। এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কথা লিখেছেন পল্লব মোহাইমেন।
‘আমরা এখন পোলিওমুক্ত বিশ্বের দ্বারপ্রান্তে।’ প্রতিবেদন তৈরির জন্য ঘণ্টাখানেক আলাপনের পর যখন ভিডিও বক্তব্য নেওয়া হচ্ছিল, তখন এ কথা দিয়েই শুরু করলেন আনিস রহমান সিদ্দিকী। পরের বাক্যটি ছিল এমন, এখন নাইজেরিয়া পোলিও রোগীমুক্ত তিনটি বছর পার করল।
নাইজেরিয়া পোলিওমুক্ত হওয়ার ফলে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান— এই দুটি দেশ বাদে সব দেশ পোলিও রোগমুক্ত হয়ে গেল। নাইজেরিয়া পোলিওমুক্ত হওয়ার এই সাফল্যের পেছনে ইউনিসেফের হয়ে যিনি আছেন, তিনি একজন বাংলাদেশি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। নাম আগেই বলা হয়েছে—আনিস রহমান সিদ্দিকী। তাঁর আনুষ্ঠানিক পদ হলো জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) কমিউনিকেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চিফ এবং পোলিও টিম লিড। নাইজেরিয়ার আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ইউনিসেফের হয়ে ভারতকে পোলিওমুক্ত করার কাজেও ভূমিকা রেখেছেন আনিস সিদ্দিকী। কয়েক দিন আগে ঢাকায় বসে নানা অভিজ্ঞতার কথা শোনান তিনি।
অনুপ্রেরণা বাংলাদেশ
নতুন সহস্রাব্দ অর্থাৎ ২০০০ সাল নাগাদ বিশ্ব পোলিওমুক্ত করার কথা ছিল। সে জন্য দেশে দেশে ছিল জীবনঘাতী রোগ প্রতিরোধ নিয়ে নানা উদ্যোগ। বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে টিকাদান কর্মসূচি যে খুবই সফল হয়েছিল, তা অনেকের জানা। সে সময়ে একটা বেসরকারি সংস্থায় কাজ করছিলেন আনিস রহমান সিদ্দিকী। ‘১৯৯৯ সালে আমরা কয়েকজন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যোগ দিই।’ বললেন তিনি।
ডব্লিউএইচওতে যোগ দিয়ে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) সঙ্গে ভালোভাবেই জড়িয়ে গেলেন আনিস রহমান সিদ্দিকী। সে সময় ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে টিকা দেওয়া নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশ ২০০১ সালের মধ্যেই পোলিওমুক্ত হয়ে যায়।
পোলিওমুক্ত করতে ভারতে
ভারত তখনো পোলিওমুক্ত হয়নি। আনিস তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঢাকা বিভাগীয় সমন্বয়ক। ২০০৩ সাল। তাঁকে পাঠানো হলো ভারতে। সেখানকার প্রত্যন্ত জেলায় কাজ করতে হবে আনিস রহমান সিদ্দিকীকে। আনিস বলে যান, উত্তর প্রদেশের সেই স্থানে সামাজিক আচার, ধর্মীয় ফতোয়া—এসব এড়িয়ে কোনো কিছু করা সম্ভব না। এখানে বিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা। সেখান থেকে নাকি বলা হয়েছে শিশুদের যে টিকা খাওয়ানো হয়, তা হালালভাবে তৈরি না। ফলে বড় এক জনগোষ্ঠী টিকার আওতার বাইরে। এমন বৈরী পরিবেশে কাজ করতে হয়েছে আনিসদের।
আনিস রহমান সিদ্দিকী দেওবন্দের আলেম–ওলামাদের সঙ্গে কথা বললেন। একবার নয়, বারবার। তাঁরা জানালেন, যদি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় সনদ দেয়, তবেই ফতোয়া বদলানো যাবে। ‘আমি যোগাযোগ করলাম আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাসিম খানের সঙ্গে। তাঁকে বোঝালাম টিকাদান সম্পর্কে। টিকা উৎপাদন পদ্ধতি এবং এর বৈজ্ঞানিক বিষয় বুঝে আলীগড় সনদ দিল। টিকাদান নিয়ে সেখানে আর কোনো সমস্যা থাকল না।’
২০০৩ থেকে ২০১৫—এক যুগ ভারতে কাজ করেছেন আনিস। এর মধ্যে ২০০৭ সালে চাকরি বদল করলেন। ডব্লিউএইচও থেকে এলেন ইউনিসেফে। তবে কাজটা বদলাল না আনিসের। দিল্লিভিত্তিক চাকরি ছিল ইউনিসেফের।
২০০৭ সালের দিকে বিহার রাজ্যে পোলিওর প্রাদুর্ভাব দেখা গেল। ডাক পড়ল আনিসের। গিয়ে দেখলেন জাতপাতের প্রকট সমস্যা সেখানে। পাটনায় একটা বড় সম্প্রদায় ‘মূষাহারি’। সেসব পরিবারে কোনো টিকা কর্মী যান না। ‘আমি ওই সম্প্রদায় থেকে ৩০০ লোক নিয়োগ দিলাম। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকা খাওয়াতে থাকলেন।’
বিহার থেকে আবার উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌতে প্রোগ্রাম ম্যানেজার হয়ে যান আনিস রহমান সিদ্দিকী। এখানে পোলিওর পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের নানা সমস্যা ছিল। পাকা পায়খানা ব্যবহার না করা, সন্তান প্রসবের সময় হাসপাতালে মাকে নিয়ে না যাওয়াসহ নানা সমস্যা চিহ্নিত করলেন আনিস রহমান সিদ্দিকীরা। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের (বর্তমানে ভারতের সমাজবাদী পার্টির সভাপতি) সহায়তা নিলেন তাঁরা।
আনিস রহমান সিদ্দিকী ২০১৪ সালে দিল্লিতে এলেন ইউনিসেফের অফিসার–ইন–চার্জ হয়ে। তিনি বললেন, ‘২০১১ সালে ভারত পোলিওমুক্ত হয়েছে। এটা তো একটা উদ্যাপনের বিষয়। আমরা পার্টনার করে নিলাম অমিতাভ বচ্চনকে। তাঁকে নিয়ে শুরু হলো মিশন ইন্দ্রধনু (রংধনু) প্রচারণা। রংধনুর সাত রং মানে সাতটি রোগ প্রতিরোধের টিকা। অবশেষে ২০১৪ সালে দক্ষিণ এশিয়াকে (পাকিস্তান–আফগানিস্তান বাদে) পোলিওমুক্ত সনদ দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাংলাদেশ যদিও ২০০১ সালেই পোলিওমুক্ত হয়েছিল।
গন্তব্য নাইজেরিয়া
২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত আনিস রহমান সিদ্দিকী ব্যস্ত থাকলেন তাঁদের সংস্থায় নতুন নতুন টিকা চালু করার কাজে। এরপর ডাক এল নাইজেরিয়ায়। আফ্রিকার এই দেশটি ২০১৪ সালে পোলিওমুক্ত হয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে আবার সেখানে পোলিও আক্রান্ত চারজন রোগীর দেখা পাওয়া গেল। নাইজেরিয়ায় গেলেন আনিস রহমান সিদ্দিকী। এখানকার চ্যালেঞ্জ অন্য রকম। নাইজেরিয়ায় এখনো সম্প্রদায়ভিত্তিক নেতারা শক্তিশালী। গোষ্ঠীগত সংঘাত সেখানে বড় সমস্যা। নানা কারণে অনেক এলাকায় ঢুকে শিশুদের টিকা খাওয়ানো সম্ভব হচ্ছিল না। নিরপেক্ষ এলাকায় শিশুদের এনে টিকা খাওয়ানো হতো। এই নেতাদের কাজে লাগালেন তিনি। তাঁদের মাধ্যমে ওই সব এলাকায় টিকা কর্মীদের পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। নাইজেরিয়ায় সহযোগিতা করেছিল বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
এভাবেই গত আগস্ট মাসে নাইজেরিয়া তথা আফ্রিকা হলো পোলিও রোগীমুক্ত।
ইচ্ছে ছিল শল্যবিদ হওয়া
আনিস রহমান সিদ্দিকীর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বাবা সিদ্দিকুর রহমান চাকরি করতেন অধুনালুপ্ত টিঅ্যান্ডটি বোর্ডে। মা শামসুন্নাহার বেগম গৃহিণী। এই দম্পতির পাঁচ ছেলের মধ্যে বড় আনিস সিদ্দিকীর জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৬ মে, নবীনগর উপজেলায়। আনিস যখন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র তখন আসেন ঢাকায়। মাদারটেক আব্দুল হাইস্কুল থেকে ১৯৮৩ সালে এসএসসি, নটর ডেম কলেজ থেকে ১৯৮৫ সালে এইচএসসি পাস করে পড়তে যান সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে। ১৯৯২ সালে এমবিবিএস এবং ১৯৯৬–৯৭ সালে ঢাকার নিপসম থেকে জনস্বাস্থ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি। আরও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাস্থ্য অর্থনীতির ওপর স্নাতকোত্তর কোর্স করেছেন।
কথায় কথায় জানা গেল আবৃত্তি করতে পছন্দ করেন আনিস সিদ্দিকী। ‘একসময় তো এটাই প্রায় জীবিকা হয়ে গিয়েছিল।’ শোনান সেই গল্প। বাড়ির অবস্থা তেমন সচ্ছল ছিল না। এম এ জি ওসমানী মেডিকেলে আনিস যখন পড়তে যান, তখন ভেবেছিলেন টিউশনি জোগাড় করে খরচ চালাবেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে টিউশনি জোগাড় হলো না। ‘আবৃত্তি করতাম তখন। একটা অনুষ্ঠানে আমার কণ্ঠ শুনে সিলেট বেতারের একজন আমাকে সেখানে যেতে বললেন। কয়েক মিনিটের একটা কথিকা পড়তে দিলেন। সেটা অন–এয়ার হলো। এরপর প্রতিদিন রাতে একটা করে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার কাজ পেলাম। সে অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্টও লিখতে হতো। সাত বছর সিলেট বেতারে কাজ করেছি।’
এমবিবিএস পাস করার পর শুরু হলো আনিসের ইন্টার্ন জীবন। বিখ্যাত শল্যবিদ ডা. রশীদ–ই–মাহবুবকে দেখে তখন ইচ্ছা সার্জন হওয়ার। ইন্টার্নশিপ করে ৪ হাজার টাকা পান। বাড়িতে পাঠাতে হয়, ছোট এক ভাই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তার খরচ দিতে হয়। এভাবে হাতে টাকা আর থাকে না বললেই চলে। তবু সার্জন হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এক বছর বিনা পারিশ্রমিকে রশীদ–ই–মাহবুবের সঙ্গে কাজ করেন আনিস। সার্জন যে তাঁকে হতেই হবে।
১৯৯৩–৯৪ সালে এলেন ঢাকায়। চাকরি পেলেন বেসরকারি একটা ক্লিনিকে, ডিউটি রাতে। সকালে আবার বড় চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচার করতেন। তাঁদের সঙ্গে থাকতেন আনিস। এভাবে ক্লান্তিকর হয়ে উঠল জীবন। এক সিনিয়র ভাই বললেন, ‘এভাবে পারবে না। একটা এনজিও আছে, দিনে ২০–২৫ জন রোগী দেখতে হবে, ওখানে কাজ করো। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে।’ বললেন আনিস। যোগ দিলেন তেজগাঁওয়ের দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। বেগুনবাড়িসহ আশপাশের বস্তির মানুষদের চিকিৎসা করতে হতো সেখানে। বেশির ভাগ চর্মরোগে আক্রান্ত।
আনিস রোগীদের সঙ্গে নানা কথা বলতেন। জানতে পারলেন এদের বেশির ভাগই নর্দমা বা অন্য কোনো নোংরা পানিতে গোসল করে। আনিস ওয়াসার সঙ্গে কথা বলে ‘হোল্ডিং নম্বর’ ছাড়া এই মানুষদের জন্য পানির ব্যবস্থা করলেন। রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকল। দিনে প্রায় ২০০–৩০০ রোগী। আনিসের বেতনও বাড়ল। এই সংস্থা থেকে আনিস যোগ দেন ডব্লিউএইচওেত।
আনিস বলেন, ‘একজন সার্জন হলে আমি একজন একজন করে রোগীর চিকিৎসা করতে পারতাম। কিন্তু জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হয়ে লাখো মানুষের জীবন বাঁচাতে বা তাদের সুস্থ রাখার কাজ করতে পারি।’
লাখো মানুষের জন্য
স্ত্রী শাহনাজ হায়াতও একজন চিকিৎসক। কাজ করছেন নাইজেরিয়াতে। আনিস ও শাহনাজের দুই ছেলে সুদীপ্ত শাহীন সিদ্দিকী অস্ট্রেলিয়ায় স্নাতকোত্তর পড়ছেন এবং অনিন্দ্য শাহীন সিদ্দিকী কানাডায় প্রি–মেডিকেল কোর্স করছেন। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ উচ্চ ধারণাই পোষণ করেন আনিস রহমান সিদ্দিকী। আট–নয় বছর পর ধরন পরিবর্তন ডেঙ্গু জ্বর ব্যাপক আকারে ছড়ানোর পর তা ভালোভাবেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি।
নাইজেরিয়া পোলিওমুক্ত হলো, তো এরপর কী কাজ আনিস রহমান সিদ্দিকীর। বললেন, ‘নাইজেরিয়ার স্বাস্থ্যব্যবস্থা তৈরি করে দেওয়ার কাজটা এখন আমরা করছি।’
আরও পরে? জনস্বাস্থ্য নিয়েই কাজ করে যাবেন আনিস রহমান সিদ্দিকী। এই ক্ষেত্রে তো লাখ লাখ মানুষের জন্য কাজ করা যায়।