শাড়ি, বাক্স, টিফিন বাটি, কিসে নেই রিকশা পেইন্ট!
চড়া রঙের লতা–পাতা আঁকা চিত্রগুলো যে–কারও অতি পরিচিত মনে হবে। কারণ, পথ চলতে রিকশার পেছনে দেখা মেলে এমন পেইন্টিং। রিকশার পেছনের এ চিত্র দেশের এই বাহনকে আলাদা এক ঢং দিয়েছে। পাঁচ তারকা হোটেলে দেশের ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতীক হিসেবে রাখা হয় এমন রিকশা; রিকশা পেইন্ট নিয়ে হয়েছে চিত্র প্রদর্শনীও। ফ্যাশন দুনিয়ায় সময়ের সঙ্গে নানান স্টাইল ভেঙেচুরে উপস্থাপনের প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টায় জায়গা করে নিয়েছে এই রিকশা পেইন্ট। এ যেন ফ্যাশনদুরস্ত আধুনিক কোনো মেয়ের নাম কমলা বা জয়নাব অথবা জমিলার মতো ‘দাদি-নানির’ নাম। ব্যতিক্রম ফ্যাশন হিসেবে আপনি চাইলেই এখন শাড়ি, গয়না বা টাকা রাখার বাক্স, টিফিন ক্যারিয়ার, চায়ের মগ-কেটলিতে করে নিতে পারবেন রিকশা পেইন্ট।
আপনার পছন্দ অনুসারে পণ্যে রিকশা পেইন্ট করে দেবেন কাজী শবনম নামের এক তরুণ শিল্পী। হারিকেন, কেটলি, মগ, টিফিন বাটি, গয়নার বাক্স, বয়াম, মায়ের দোয়া লেখা টিনের ট্রাংক, সানগ্লাস, শাড়ি—সবকিছুতেই রিকশা পেইন্ট। কেটলিতে ক্রেতার নাম দিয়ে লেখা হয়েছে—শিপুর চা মহল। এর বাইরে বাবা-মা-মেয়ে বা বাবা-মা-ছেলের একই রকম পোশাক তো আছেই। এ সবকিছু নিয়েই গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছেন কাজী শবনম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁর বাহারি পণ্য দিয়ে সাজানো পেজটির নাম ‘নৈসর্গিক’।
শবনম হাসতে হাসতে বললেন, ‘শুধু রিকশা পেইন্টের পণ্য নয়, রিকশার গদিও বিক্রি করি। আর এসব শৌখিন পণ্যের বেশির ভাগ ক্রেতা বিদেশি। অনলাইনেই এই ক্রেতারা যোগাযোগ করেন।’
শবনম বললেন, দেশে রিকশা পেইন্টের একসময় রমরমা অবস্থা থাকলেও এখন দৈন্যদশা চলছে। চোখের সামনেই রিকশা পেইন্ট করা শিল্পীরা পেশা পরিবর্তন করে ফেলছেন। একজন মালয়েশিয়া চলে গেলেন শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য। দেশে থেকেই বা কী করবেন। রিকশার পেছনের ছবিও এখন আর শিল্পীরা হাতে আঁকেন না, সব ডিজিটাল প্রিন্ট। সিনেমার পোস্টারও ডিজিটাল। ফলে, এখন শিল্পী পাওয়াটাই বড় সমস্যা হয়ে যাচ্ছে।
ফেসবুকে ব্যবসা করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে শবনম বলেন, ‘শিল্পীর হাতে আঁকা ছবি সব সময় এক রকম হবে না। শিল্পীরা স্বাধীনচেতা, তাঁরা অন্যের ফরমাশ সেভাবে মানতে চান না। অন্যদিকে, ক্রেতারা একচুল ছাড় দিতেও নারাজ। পণ্য ডেলিভারির পর বলেন, এই দাগটা আর একটু বড় হতো। ওহ্, আমি ভেবেছিলাম এটা দেখতে এমন হবে। অগত্যা অর্ডার বাতিল। আবার ক্রেতার চাহিদা মতো বানিয়ে দিতে হয়।’
শবনম বললেন, ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী শাড়ির আঁচলে সিনেমার ডায়ালগ, মুঠোফোনের কভার—সবই বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শিশুদের একটি পার্টিতে সানগ্লাসের ফ্রেমে ১৮ জন শিশুর নাম লিখে নকশা করে দেওয়া হয়। এক কিশোরীর মনের বায়না অনুযায়ী পোশাকে লিখে দিতে হয়—‘বিয়া করুম না, কাচ্চির আলু নাই’। রিকশা পেইন্ট তিনটি লেয়ারে করতে হয়। ভাঁজে ভাঁজে রং বের হয়। তাই অনেক সতর্ক থাকতে হয়।
কাজী শবনম আক্ষেপ করে বললেন, পোশাকের ক্ষেত্রে ভারত, বিশেষ করে পাকিস্তানের কাপড়ে বাজার সয়লাব বলে ক্রেতারা দেশের পণ্য কিনতে আগ্রহ পাচ্ছেন না। সম্প্রতি মাইডাস সেন্টারে অনুষ্ঠিত এক মেলায় অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বললেন, সেখানে অর্ধেক জায়গা ছিল দেশীয় পণ্য নিয়ে ব্যবসা করা উদ্যোক্তাদের জন্য, আর বাকি অংশে ছিল বিদেশি পণ্য নিয়ে ব্যবসা করা উদ্যোক্তাদের জন্য। দেখা গেল, বিদেশি পণ্যের জায়গায় মানুষ গিজগিজ করছে, আর দেশি পণ্যের জায়গা একেবারে ফাঁকা। ফলে, ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
ছোট উদ্যোক্তাদের প্রসঙ্গে কাজী শবনম বললেন, ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছোট বা স্বল্প পুঁজির উদ্যোক্তাদের জন্য তিন বছর ধরে ট্রেড লাইসেন্স থাকা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থাকাসহ যেসব শর্তে ঋণ দিতে চায়, সেসব শর্ত পূরণ করতে পারলে আসলে ঋণ করারই দরকার পড়বে না। তাই এই ব্যবসায়ীদের জন্য শর্ত সহজ করতে হবে।
কাজী শবনম আগে একটি করপোরেট হাউসে চাকরি করতেন। রুটিন বাঁধা সময়ে দুই সন্তানকে সময় দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। ছেলেদের রাখার জন্য তিন মাসে ছয়টি ডেকেয়ার সেন্টার পাল্টাতে হয়েছিল। বড় ছেলে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু হওয়ায় তার সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতায় ঘাটতি আছে। বর্তমানে এক ছেলের বয়স ১১ বছর, আরেক ছেলের বয়স ৯ বছর। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার পর এক হাতে সবকিছু সামলানোর জন্য ব্যবসা শুরু করেন। শবনম বর্তমানে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। তিনি গ্র্যাজুয়েশনের পাশাপাশি চার্টার্ড সেক্রেটারি ডিগ্রিও নিয়েছেন।
শবনম বললেন, তাঁর বিভিন্ন কাজের জন্য কামরাঙ্গীরচর, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গার কারখানায় দৌড়াতে হয়। অনেক সময় ছেলেদের সঙ্গে নিয়েই বিভিন্ন কারখানায় চলে যান।
অনলাইন ব্যবসায় অনেক ক্রেতাই ঠকছেন বলে অভিযোগ করেন শবনম। নিজের ক্রেতাদের সম্পর্কে বলেন, এই ক্রেতাদের সন্তুষ্টির মাত্রা ৯৯ শতাংশ। দু–একটি ক্ষেত্রে অভিযোগ এসেছে। অভিযোগের ধরন ছিল—কেটলির হাতলের একটা দাগ একটু বড় হলে ভালো লাগত বা রঙের শেডটা পছন্দ হচ্ছে না। তবে ক্রেতার অভিযোগ যত তুচ্ছ বা ছোট হোক না কেন, পণ্য পাল্টে তাঁর চাহিদা অনুযায়ী করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আর ক্রেতা পণ্য হাতে পাওয়ার পরই দাম পরিশোধ করেন।
শবনম মনে করেন, অনলাইন ব্যবসা প্রসারের এই সময়ে ক্রেতা ও বিক্রেতা যেন না ঠকেন, তার জন্য সরকারের উচিত একটি নীতিমালা তৈরি করে দেওয়া। নিজে অনলাইন থেকে একটি পণ্য কিনে ঠকে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বললেন, অনেক বিক্রেতা ক্রেতাদের এক পণ্য দেখিয়ে অন্য পণ্য দিচ্ছেন। ক্রেতাকে ঠকানোর পর অনলাইনে ওই ক্রেতাকে ব্লক করে দেন, তখন আর ক্রেতার আর কিছু করার থাকে না। অনলাইনে কিছু বিক্রেতার পণ্যের চেয়ে নিজের প্রচারে ‘লাইভ’–এর যন্ত্রণা তো আছেই।
অনলাইনে ব্যবসা করার সমস্যাগুলো সম্পর্কে শবনম বলেন, অনলাইনে অনেক ক্রেতা অযথাই বিরক্ত করতে থাকেন। একবার এক ক্রেতা নিজের জন্য পাঞ্জাবি কিনবেন, কোন সাইজ লাগবে জানতে চেয়ে নিজের আপত্তিকর ছবি পাঠিয়ে দেন। একটি পণ্যের নানান দিক নিয়ে জানতে চেয়ে অনেক সময় নষ্ট করে পরে আর পণ্যটা কেনেন না। হাসতে হাসতে বললেন, ‘নোংরা মন্তব্য শোনা থেকে শুরু করে নিজের ব্যবসা করার অভিজ্ঞতা নিয়ে আস্ত একটি বই লেখা যাবে।’
শবনমের স্বপ্ন ভবিষ্যতে একটি নান্দনিক শোরুম গড়ে তোলা। পাশাপাশি একটি ক্যাফে চালু করা। ক্যাফেতে লেখকদের লেখার জায়গা থাকবে। দেয়ালজুড়ে থাকবে বুক শেলফ।