রূপা, শাহিনুর...এরপর কে?

শাহিনুরসহ গণপরিবহনে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে যখন তাঁর সহকর্মীরা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তখন তাঁদের দিকেও ছিল গণপরিবহনের চালকের সহকারীর তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি। ৯ মে রাজধানীর কল্যাণপুরে।  ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
শাহিনুরসহ গণপরিবহনে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে যখন তাঁর সহকর্মীরা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তখন তাঁদের দিকেও ছিল গণপরিবহনের চালকের সহকারীর তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি। ৯ মে রাজধানীর কল্যাণপুরে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

গণপরিবহন, বিশেষ করে বাসে ধর্ষণের পর হত্যার তালিকায় রূপা, শাহিনুরসহ একের পর এক নাম যোগ হচ্ছে। ঘটনা ঘটার পর দেশজুড়ে তোলপাড় হলেও ঘটনা থামছে না।

গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গণপরিবহনে গত ১৩ মাসে ২১ নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনা করে এ তথ্য দিয়েছিল সংগঠনটি।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বললেন, ‘সংবাদপত্রে সব ঘটনা আসে না, তাই ঘটনার ভয়াবহতা আরও বেশি । প্রতিবেদন প্রকাশের পরে পরিবহনমালিকেরা কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।’

৬ মে স্বর্ণলতা পরিবহনের একটি বাসে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে শাহিনুর আক্তারকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়—এ অভিযোগে বাজিতপুর থানায় মামলা করেছেন নিহত শাহিনুরের বাবা গিয়াস উদ্দিন। ওই মামলায় বাসচালক, সহকারীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

 শুধু ধর্ষণ নয়, গণপরিবহনে নারীরা প্রতিনিয়ত যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। গত বছর বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক গবেষণা বলছে, গণপরিবহনে যাতায়াতকালে ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময়ে মৌখিক, শারীরিক বা অন্যভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

 ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি আবুল কালাম বললেন,‘চালক, হেলপারদের কত বুঝাইতাছি, কিন্তু লাভ হইল কই? বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করা যাত্রীদের মধ্যে ৩০ শতাংশ নারী যাত্রী। এখন তো আমাদেরই মাথা খারাপ।’

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বললেন, গণপরিবহনের চালক বা সহকারীদের মধ্যে জীবনবোধ, মূল্যবোধ, লেখাপড়া—সবকিছুরই অভাব আছে। চালকদের একটি বড় অংশ মাদকাসক্ত বলে পরিবহনের নেতারাই স্বীকার করেন।

প্রতিকার কতটুকু মেলে?

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে রূপা খাতুনকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে দেওয়া হয়।

গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র ১৪টি কর্মদিবসের মধ্যে রূপা খাতুন ধর্ষণ ও হত্যার মামলার রায়ে চারজনের ফাঁসির আদেশ এবং একজনের সাত বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। যে বাসে ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যার ঘটনাটি ঘটেছিল, সেই জব্দ হওয়া বাসটির মালিকানা রূপার পরিবারকে দিতে হবে—আদালত রায়ে বলেন। নিহত রূপার ভাই মো. হাফিজুর রহমান টেলিফোনে বললেন, ‘ রায়ের পর ১৪ থেকে ১৫ মাস ধরে হাইকোর্টে মামলাটি ঝুলন্ত অবস্থায় আছে। যে বাসটি পাওয়ার কথা, তা মধুপুর থানায় পড়ে আছে ।’

২০১৫ সালে মে মাসে কর্মক্ষেত্র থেকে ঘরে ফেরার পথে রাজধানীতে গণধর্ষণের শিকার হন পোশাকের দোকানে কাজ করা এক গারো তরুণী (২২)। কুড়িল বাসস্ট্যান্ড থেকে তাঁকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে ধর্ষণ করে একদল দুর্বৃত্ত।

 গারো তরুণীর এ ঘটনায় বাদীপক্ষের আইনজীবী নিপারসন আজিম মুঠোফোনে বললেন, মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ২০১৫ সালে। শুধু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষী হচ্ছে না বলে মামলাটি ঝুলছে।

কিছু সমাধানের প্রস্তাব

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল কার্যক্রমের পরিচালক আবুল হোসেন জানান, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঢাকার কয়েকটি রুটে গণপরিবহনে সিসিটিভি লাগানোসহ বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

 কোনো বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে কৌশলে মন্ত্রণালয়ের হেল্পলাইন ১০৯ নম্বরে ফোন দিয়ে সহায়তা চাওয়ার পরামর্শ দিলেন আবুল হোসেন।

ইলিয়াস কাঞ্চনের মতে, শিক্ষিত বেকার যুবকেরা উবার, পাঠাও চালনার পাশাপাশি গণপরিবহনের হাল ধরলে এই খাতের সার্বিক পরিবেশের উন্নয়ন হলে পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে।

সংবাদপত্রের এজেন্ট নিহত রূপার ভাই হাফিজুর বললেন, ‘আমি চাই না আর কোনো রূপা এভাবে মরুক। কিন্তু একটার পর একটা ঘটনা ঘটছেই। গণমাধ্যম তোলপাড় করলে তবু একটু কাজ হয়। আর আমার বোনের মামলার রায় দ্রুত বাস্তবায়ন হলে, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে চালক, হেলপাররা ধর্ষণ তো দূরের কথা, কোনো নারীর দিকেই তাকানোর সাহস পেত না।’