জীবনের স্পন্দনে সন্ধানী
অনেকক্ষণ স্ট্রেচার নিয়ে হন্যে হয়ে ছোটাছুটি করছে আসিফ। বাবা হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর অবস্থা খারাপের দিকে। হাসপাতালে যখন রক্তের সংস্থান হচ্ছে না, আসিফকে বলা হলো সন্ধানীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। মুহূর্তেই রক্তের ব্যবস্থা হয়ে যায় সন্ধানী থেকে। এ রকম প্রতিনিয়ত জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে থাকা মানুষদের বাঁচানোর জন্য যে সংগঠনটি তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে আসছে, তার নাম সন্ধানী।১৯৭৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছয় শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান, মোশাররফ হোসেন, ইদ্রিস আলী, আবদুল কাইউম, মোস্তফা সেলিমুল হাসনাইন ও খুরশীদ আহমেদ নামবিহীন যে স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম শুরু করেছিলেন, তা আজকের সন্ধানী নামের মহিরুহ।মানুষের সেবা করার ব্রত নিয়ে প্রতিবছর মেডিকেল কলেজে যাঁরা ভর্তি হন, তাঁদের মাধ্যমেই পরিচালিত হয় সন্ধানী। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে রক্ত সংগ্রহের কাজ করেন, টিকা দান করেন। সন্ধানীতে স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়া এসব তরুণ পরিচিত ‘সন্ধানীয়ান’ নামে।সন্ধানীর কাছ থেকে রক্ত পাওয়ার কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে। সন্ধানী কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আকিব জাহান বলেন, ‘পেশাদার রক্তদান ব্যাপারটিকে নিরুৎসাহিত করার জন্য সন্ধানীর পন্থা হচ্ছে, প্রতি ব্যাগ রক্ত পেতে হলে বিনিময়ে আরেক ব্যাগ রক্ত দিতে হবে। সন্ধানীতে রক্ত কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ ছাড়া স্বেচ্ছায় রক্তদানকারী যে কেউ প্রয়োজনে রক্তদানের আইডি কার্ড দেখিয়ে রক্ত জোগাড় করতে পারেন। তবে থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সন্ধানী কোনো শর্ত ছাড়াই রক্ত প্রদানের ব্যবস্থা করে থাকে।’দরিদ্র রোগীদের সাহায্য করার জন্য সন্ধানীর আছে বিনা মূল্যে ওষুধ বিতরণ কর্মসূচি। শিক্ষকদের কাছ থেকে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বারবার ধরনা দিয়ে ওষুধ সংগ্রহ করেন সন্ধানীয়ানরা।এ ছাড়া মরণোত্তর চক্ষুদানে উৎসাহিত করাও সন্ধানীর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। সময়ে সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন, বিশেষ করে শহর থেকে দূরে অবস্থিত অজপাড়াগাঁয়ের স্বাস্থ্যসেবাবঞ্চিত মানুষদের জন্য সন্ধানী প্রায়ই এই আয়োজন করে।একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দিলেই বোঝা যাবে এই সংগঠনের অগ্রযাত্রার ধরন। শুরুর বছরে ১৯৭৭-১৯৭৮ মৌসুমে ২০৭ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের মাধ্যমে সূচনা হয়েছিল যে উদ্যোগের, আজ সে সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় ৩৫ হাজারের ঘরে। ২০১১ সালে ৩৫ হাজার ১০২ ব্যাগ এবং ২০১২ সালে সন্ধানীর সংগ্রহ ৩৪ হাজার ৯৫৬ ব্যাগ, যার পুরোটাই স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতাদের কাছ থেকে পাওয়া।
মেডিকেলের কঠিন পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষার্থীদের এই যে অক্লান্ত শ্রম দিচ্ছেন, তার স্বীকৃতিও পেয়েছে সন্ধানী। ২০০৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ পাওয়ার গৌরব আছে এই সংগঠনের। আছে ২০১০ সালে ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ অ্যামেরিকা’ পুরস্কার পয় সন্ধানী। এ ছাড়া আছে কমনওয়েলথ ইয়ুথ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ডসহ আরও অনেক স্বীকৃতি।
১৯৮২ সালে ‘সন্ধানী ডোনার ক্লাব’ এবং ১৯৮৪ সালে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি ও সন্ধানী জাতীয় চক্ষুব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।
বর্তমানে ১৯টি সরকারি মেডিকেল কলেজে সন্ধানীর ইউনিট রয়েছে। বেসরকারি মেডিকেলে সন্ধানীর ইউনিট সংখ্যা চার। একটি কেন্দ্রীয় পরিষদের মাধ্যমে এসব ইউনিট পরিচালনা করা হয়।
সন্ধানী কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের মাসুদুল হক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘অনেক দিন ধরে রক্ত সংগ্রহ ও চক্ষুদান কর্মসূচি পরিচালিত হলেও সন্ধানীর কোনো নিজস্ব ভবন ছিল না। কিন্তু খুশির খবর ঢাকার নীলক্ষেতে নির্মাণ শুরু হয়েছে সন্ধানী ব্লাডব্যাংক ও সন্ধানী চক্ষু হাসপাতাল, যেখান থেকে ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয়ভাবে সন্ধানী পরিচালিত হবে।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী সন্ধানী কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক দেবাশীষ দত্ত জানান, ‘জাতীয়ভাবে কাজ করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবেও সন্ধানীর কাজকর্মকে ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা আছে আমাদের। সেই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেও কাজ করে চলেছি আমরা।’আগামী বছরে সন্ধানীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে সন্ধানী কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী আকিব জাহান বলেন, ‘আমাদের এবারের লক্ষ্য ৫০ হাজার ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করা। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো গণমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদানকে সাধারণ মানুষের মাঝে জনপ্রিয় করে তুলেছে। বাংলাদেশেও সবার মধ্যে আমরা সেই জাগরণ সৃষ্টি করতে চাই।’স্বাস্থ্যবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সব দিবস উদ্যাপন করে সন্ধানী। ১৪ জুন ছিল বিশ্ব রক্তদান দিবস। রক্তদানে সবাইকে আরও উজ্জীবিত করার জন্য আজ ১৬ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয়েছে সেমিনার, আছে র্যালি। ‘রক্তদান করো, জীবন উপহার দাও’ স্লোগান সামনে নিয়ে দিনব্যাপী চলবে এই আয়োজন।