৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী পরিস্থিতি, ইশতেহার, ভবিষ্যৎ সরকার গঠন-এসব নিয়ে কথা বলেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন আহমদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারুন-অর-রশিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।
প্রথম আলো: অবাধ নির্বাচন করা নিয়ে আমরা এতটা সংকটে কেন পড়লাম?
এমাজউদ্দীন আহমদ: আমি উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাদের সমাজ প্রাচীন। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের ৫০ বছর আগে আমরা অন্যের পায়ের তলায় ছিলাম। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল না। হেনরি কিসিঞ্জার জেনারেল ইয়াহিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কেন এত কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছ? শেখ মুজিবের সঙ্গে একটা আপসরফা করে নিলেই হলো? ইয়াহিয়া জবাবে বলেছিলেন, আমি বাঙালিদের জানি। তারা কিছুদিনের মধ্যেই ঝগড়াঝাঁটিতে নিজেদের বিভক্ত করবে। তবে প্রায় ৫০ বছরে ঝগড়াবিবাদ করেও আমরা নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছি। প্রশ্ন হলো, মাথা উঁচু করে আমরা থাকতে পারছি না কেন? আমাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার মনোভাবটা কেন এল না? এখন যেটুকু প্রদীপ জ্বলছে, তা এক ফুৎকারে নিভে যেতে পারে। হতাশা নিয়ে মরতে চাচ্ছিলাম না। অথচ রাজনীতিতে ঝগড়া ছাড়া যেন আমাদের একমুহূর্ত কাটে না।
প্রথম আলো: গ্রেপ্তার-হয়রানি সত্ত্বেও বিএনপি নির্বাচনে, বিরোধী দলে গেলে সংসদে পাব?
এমাজউদ্দীন আহমদ: সংলাপের সময় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এখন থেকে আর গ্রেপ্তার হবে না। তা হয়নি। কিন্তু যেকোনো পরিস্থিতি হোক, বিএনপি মাঠ ছাড়বে না। দুটি কারণে তাদের নির্বাচনী মাঠে থাকতে হবে। হয় তারা জয়লাভ করবে, নাহয় সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে থাকবে।
প্রথম আলো: একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির থাকার সম্ভাবনাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০টি আসন পাওয়া দরকার। এর থেকে কম হলে কিন্তু সংসদে থাকা যাবে না। ওখান থেকে বিদায় নিয়ে যেতে হবে।
প্রথম আলো: এর চেয়ে কম আসন পেলে কি বিএনপি জাতীয় সংসদ বয়কট করতে পারে?
এমাজউদ্দীন আহমদ: তখন সংসদ বয়কট ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না। প্রথমত বিজয়, দ্বিতীয়ত কোনো অবস্থাতেই ৭০ বা ৮০-এর নিচে নামানো সম্ভব হবে মনে করি না। মানুষ বিএনপি সম্পর্কে অত্যন্ত উৎসাহী। এর ব্যত্যয় ঘটলে অতীতের মতো একটি অকার্যকর সংসদ চলতে থাকবে।
প্রথম আলো: সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এবারে বিএনপির দুর্বলতা হচ্ছে কোনো পিএম ফেস নেই, মানে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তার ঠিক নেই। কীভাবে দেখছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: যদি বিএনপির হাতে ১৫১টি আসন আসে, তাহলে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবেন। আমরা
তাঁকে বের করে আনতে সক্ষম হব। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর ফেস নেই, কথাটাকে আমরা এভাবে নিই না। ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে কিছু মশকরা করা হচ্ছে। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে, তিনি কখনোই বিএনপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, বিএনপির রাজনীতিতে তিনি এখনো নেই। তিনি কেন প্রধানমন্ত্রী হতে আসবেন?
প্রথম আলো: ১৫১ আসন না পেলে কে হবেন বিরোধী দলের নেতা?
এমাজউদ্দীন আহমদ: খন্দকার মোশাররফ হোসেন কিংবা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সম্ভাবনা থাকবে।
প্রথম আলো: দুজনের মধ্যে সিনিয়র কে? কে দলে আগে এসেছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: ড. মোশাররফ হোসেন।
প্রথম আলো: বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি কম আশা করা হচ্ছে।
এমাজউদ্দীন আহমদ: কিছুটা ফেলবে। এ সময়ে তাঁরা উৎসবেও ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু তাঁদের চোখ খোলা থাকবে। তাঁদের নজর এড়াবে না যে জোরজবরদস্তি করা কী করে এখানে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এই বয়সে আমি শুধু এটাই বলব যে আল্লাহ একজন আছেন। তিনি দেখবেন। তাদের অবশ্যই মূল্য দিতে হবে। হয়তো আজ নয়, কাল।
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের কোনো ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক?
এমাজউদ্দীন আহমদ: গত ১০ বছরে তারা যেটা করছে, তা হলো গণতন্ত্রকে বিধ্বস্ত করা। গণতন্ত্রকে বিধ্বস্ত করার জন্য দুটি পদক্ষেপই যথেষ্ট। দুটি পদক্ষেপই তারা খুব ভেবেচিন্তে নিয়েছে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্র, সরকার ও দলের পার্থক্য মানা হয়। আমি রাষ্ট্রের অংশ। তাই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার রেওয়াজ রয়েছে। দেশে তিনটিই এক হয়ে গেছে। এখন প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা রাষ্ট্রদ্রোহিতা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ রাষ্ট্রের প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তা মুখ্যত মেধার ভিত্তিতে হয়নি, সেটা হয়েছে আনুগত্যের ভিত্তিতে। গ্রামকে শহরে পরিণত করা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে যাওয়া, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু—এগুলো ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু এ উন্নয়নকে স্থিতিশীল করা দরকার হয়। দরকার হয় সুশাসনের। এসব উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে সংরক্ষিত করার জন্য সুশাসন থাকতে হবে।
প্রথম আলো: নির্বাচন কমিশনের বিরোধকে কীভাবে দেখছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: নির্বাচন কমিশন পাঁচজনের একটি ছোট্ট কমিশন। এই পাঁচজনের মধ্যে যদি কোনো বিতর্কিত বিষয় বা ভিন্নমত থেকে থাকে, তাহলে তা নিজেদের ঘরের মধ্যে থেকে তা সমাধান করা সমীচীন। সেটা না করে তারা বাইরে নিয়ে এসেছে। তাদের উচিত পদত্যাগ করা। এটা সোজা কথা।
প্রথম আলো: আপনি কি পাঁচজনকেই বলছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: যাঁরা সেটেল করতে পারছেন না, তঁারা কেন দায়িত্বে থাকবেন? প্রধান নির্বাচন কমিশনার কিংবা মাহবুব তালুকদার, তাঁরা কেন ভেতরের তর্ক বাইরে নিয়ে আসবেন?
প্রথম আলো: ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তালুকদার বিএনপির মনোনীত।
এমাজউদ্দীন আহমদ: বিএনপি মনোনীত কেউ আছে কি না কিংবা যদি কেউ থেকে থাকেন, তাহলে আমি বলব, বিতর্কের বিষয় যা-ই থাকুক না কেন, তা তাঁরা নিজেদের মধ্যে কেন আলোচনা করবেন না?
প্রথম আলো: মাঠ সমতল হলো?
এমাজউদ্দীন আহমদ: মাঠ সমতল করার প্রথম শর্ত হচ্ছে বিদ্যমান সংসদ ভেঙে দেওয়া। গত পাঁচ বছরে প্রায় ৮৫ হাজার মামলায় প্রায় ২৫ লাখ নেতা-কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ভোটের দিন পর্যন্ত তাঁদের মামলা স্থগিত না রাখলে মাঠ সমতল হবে না। তাঁদের ভোটাধিকার আছে। কারণ, তাঁরা দেশের নাগরিক। তাঁরা ভোট দিতে পারবেন না। এখন আমরা মারাত্মক সেপ্টেম্বরের কথা জানতে পারছি।
প্রথম আলো: বিএনপি তার ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার কথা বলেছে। এটা কী?
এমাজউদ্দীন আহমদ: আমাদের সংবিধানে লেখা আছে, প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যস্ত থাকবে, যা অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না। নির্বাহী ক্ষমতা কেবিনেটের কাছে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে থাকে না। এখন যেটা হচ্ছে, সব সাংবিধানিক পদধারীদের প্রধানমন্ত্রী টিক চিহ্ন দেওয়ার পর রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। এটা পাল্টে দিলেই রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অনেকখানি কমে যাবে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব অবশ্য থাকতেই হবে।
প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি মনোনয়ন-বাণিজ্য করেছে এবং তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, টাকা নেবেন বিএনপির, ভোট দেবেন নৌকায়।
এমাজউদ্দীন আহমদ: তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী যখন কথা বলেন, তখন জাতি কথা বলে। আমি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলব, এমন কথা আমরা তাঁর কাছে আশা করি না।
প্রথম আলো: জামায়াতের প্রার্থীরা ধানের শীষে নির্বাচন করছেন...
এমাজউদ্দীন আহমদ: ২০-দলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামী আছে। জামায়াত সম্পর্কে অবশ্য আমার চিন্তাভাবনা ভিন্ন। জামায়াত বিএনপির কাছাকাছি না থাকাই ভালো। কিন্তু তাদের তো একটা দলের সঙ্গে নির্বাচনে যেতে হবে। এমন আইন দেশে হয়নি যে তাদের কেউ ভোট করতে পারবেন না।
প্রথম আলো: গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এজেন্টরা ভয়ভীতির কারণে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। ৩০ ডিসেম্বরে এর পুনরাবৃত্তি হবে?
এমাজউদ্দীন আহমদ: সিটি নির্বাচন হয়েছিল বিচ্ছিন্নভাবে। এবারে এক দিনে ৩০০ আসনে নির্বাচন হওয়ার কারণে পুলিশি শক্তিকে ততটা ব্যবহার করতে পারবে না।
প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রী ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি এবং বিএনপি হিংসার রাজনীতি ভুলে রিকনসিলিয়েশনের অঙ্গীকার এসেছে। আপনার মূল্যায়ন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হোক, সেটা আশা করি। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা যেখানে জড়িত আছেন, তাঁরা যেন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দায়িত্ব পালনে ব্রতী হন। বাংলাদেশের যেমন উন্নয়নের প্রয়োজন আছে, সেই উন্নয়নকে স্থিতিশীল করার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন অপরিহার্য। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া কোনো উন্নয়ন স্থায়িত্ব লাভ করে না। দলীয়ভাবে দলীয় সংকীর্ণ চিন্তাধারার কারণে জাতি বিভক্ত হয়ে পড়ছে। আমরা সুন্দরভাবে ভোট করি। যাতে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের দ্বারা তা প্রশংসিত হয়। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি এবং বিএনপি রিকনসিলিয়েশনের কথা বলেছে। ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট কাজ থেকে অনেক বড় কিছু হয়। বৃহৎ কিছুর একটা সৃষ্টি হয়। অতীতের বড় বড় অর্জন সেভাবেই হয়েছে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
এমাজউদ্দীন আহমদ: ধন্যবাদ।