মোস্তাফিজুর রহমান জন্ম গ্রহণ করেছেন ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ সালে, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেই একের পর এক বিস্ময় উপহার দেওয়া মোস্তাফিজ পরিচিতি পেয়েছেন কাটার মাস্টার হিসেবে। বাঁহাতি পেসার চমকে দিয়েছেন আইপিএল খেলেও। যে কাটার দিয়ে মোস্তাফিজ বিখ্যাত হয়েছেন সেই গল্পও বেশ মজার। একদিন নেটে জাতীয় দলের ওপেনার এনামুল হক বিজয় মোস্তাফিজের এই ডেলিভারিটা খেলতেই পারছিলেন না। বলেছিলেন, এই বলটা আবার করে দেখাও। সেই থেকে কাটার ভালোভাবে রপ্ত করা শুরু করেন মোস্তাফিজ।
মোস্তাফিজের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর সেজো ভাই মোখলেছুর রহমানের অনেক অবদান। মোটরসাইকেলে চড়িয়ে বাড়ি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের সাতক্ষীরা শহরে দিয়ে আসতেন তাঁকে অনুশীলনের জন্য! সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে একসময় ফাইভ স্টার বলে ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেছেন। অনূর্ধ্ব-১৭ ক্রিকেটারদের ক্যাম্পে অংশ নিয়ে প্রথম ঢাকার ক্রিকেট দেখা সেই মোস্তাফিজ এখন বাংলাদেশ দলের অপরিহার্য সদস্য।
২০১২ সালে পেস ফাউন্ডেশনে সুযোগ পেয়েছিলেন মোস্তাফিজ। সুযোগ পেয়েছিলেন ২০১৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে যুব বিশ্বকাপে খুব একটা ভালো করতে পারেননি, উইকেট পেয়েছিলেন ৮টি। কিছুটা অবাক করে দিয়ে ২০১৪ সালের মে মাসে মোস্তাফিজকে অন্তর্ভুক্ত করা হলো বাংলাদেশ ‘এ’ দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। যদিও ওই সফরে ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি খুব একটা। মোস্তাফিজের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক খুলনার হয়ে ২০১৩-১৪ মৌসুমে। শুরুতে খুব একটা গতি ছিল না বলে। তবে ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২০১৪-১৫ মৌসুমটা মোস্তাফিজ অন্যভাবে চিনিয়েছিলেন। ১৯.০৮ গড়ে নিয়েছিলেন ২৬ উইকেট। বয়সভিত্তিক ও ঘরোয়া ক্রিকেটে এই সামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে মোস্তাফিজের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে গেল ২০১৫ সালের ২৪ এপ্রিল। মোস্তাফিজের দ্রুত ও আকস্মিক জাতীয় দলে সুযোগ পেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ চণ্ডিকা হাথুরুসিংহের। নেটে মোস্তাফিজের বোলিং দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন হাথুরু। তেমন ক্রিকেট ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াই পাকিস্তানের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক অভিষেক হওয়ার প্রধান কারণ অবশ্যই তাঁর ব্যতিক্রমী প্রতিভা। একজন অচেনা বোলারকে খেলতে হয়তো প্রতিপক্ষের অসুবিধা হতে পারে, এ ভাবনা থেকেও তাঁকে একাদশে রাখা হয়।
মোস্তাফিজ সবচেয়ে আলোড়ন তৈরি করে ২০১৫ সালের জুনে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে তাঁর ওয়ানডে অভিষেক। অভিষেকেই পেলেন ৫ উইকেট। পরের ম্যাচে ৬ উইকেট। কাটার আর কাটারে নাকাল করেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের। মোস্তাফিজের দুর্দান্ত বোলিংয়ে বাংলাদেশ এক ম্যাচ বাকি থাকতেই জিতে যায় সিরিজ। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে চট্টগ্রামে মোস্তাফিজের টেস্ট অভিষেকটাও হলো দুর্দান্ত। ৩৭ রানে পেলেন ৪ উইকেট। ক্রিকেটের তিন সংস্করণেই দুর্দান্ত অভিষেক হওয়া মোস্তাফিজ পরে মাতিয়েছেন আইপিএলও। ২০১৬ সালে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে আইপিএল-অভিষেক মোস্তাফিজের। হায়দরাবাদের শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মোস্তাফিজ। প্রথম বিদেশি হিসেবে আইপিএলের ‘সেরা উদীয়মান’ ক্রিকেটারের পুরস্কার জেতেন। ১৬ ম্যাচে ২৪.৭৬ গড়ে নেন ১৭ উইকেট, ইকোনমি রেট ৬.৯০। বাংলাদেশের দর্শকের কাছে আইপিএল হয়ে ওঠে মোস্তাফিজের ৪ ওভার! ২০১৭ এপ্রিলে হায়দরাবাদের হয়ে মাত্র একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান মোস্তাফিজ। ২০১৮ আইপিএলে দল বদলে মোস্তাফিজের নতুন ঠিকানা মুম্বাই ইন্ডিয়ানস। শুধু আইপিএলই নয়, মোস্তাফিজ ভালো করেছেন কাউন্টি দলে, ভালো খেলেছেন পিএসএলেও।
মোস্তাফিজের অগ্রযাত্রা বারবার ব্যাহত হয়েছে চোটে পড়ে। ২০১৫ সালটা দুর্দান্ত খেলার পর প্রায় পুরো ২০১৬ সালটাই মোস্তাফিজের কেটেছে চোটের সঙ্গে লড়াই করে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে খুলনায় জিম্বাবুয়ে সিরিজে চোট পান বাঁ কাঁধে। সেটি কাটিয়ে মার্চে এশিয়া কাপে ফিরতেই আবার নতুন চোটের হানা। এবার চোট ডান পাঁজরে। মে মাসে আইপিএল থেকে ফেরেন জোড়া চোট নিয়ে। তবে তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে ওই বছরের জুলাইয়ে সাসেক্সের হয়ে ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়ে পাওয়া বাঁ কাঁধের চোট। চোট সারিয়ে তুলতে যেতে হয়েছে শল্যবিদের ছুরির নিচে। চিকিৎসা, পুনর্বাসন—প্রায় পাঁচ মাসের লম্বা বিরতির পর দলে ফেরেন ২০১৬ সালের একেবারে শেষ দিকে নিউজিল্যান্ড সফরে। কিন্তু তাতেও কি স্বস্তি মিলছে মোস্তাফিজের? বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে খেলেও চোট থেকে মুক্তি মেলেনি। নিউজিল্যান্ডে নতুন করে চোট পান কোমরে। ২০১৭ সালের মার্চে শ্রীলঙ্কা সফরে ফিরে টানা ছয় মাস খেলেন চোটমুক্ত হয়ে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে নতুন করে চোট পান অ্যাঙ্কেলে। এই চোট কাটিয়ে মোস্তাফিজ ফিরেছেন ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। এখনো পর্যন্ত চোটমুক্ত হয়েই খেলছেন মোস্তাফিজ।
দুর্দান্ত খেলায় মোস্তাফিজ কিছু স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে একাদশে জায়গা পেয়েছেন। পরের বছর হয়েছেন আইসিসির বর্ষসেরা উদীয়মান ক্রিকেটার। মোস্তাফিজ কত দূর এগোবেন, সময়ই বলে দেবে। তবে ১০ টেস্ট, ২৭ ওয়ানডে ও ২৪ টি-টোয়েন্টি খেলা মোস্তাফিজ যেভাবে এসেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটে সেটি বিরল!