শুভ জন্মদিন, স্টিফেন হকিং

স্টিফেন হকিং
ছবি: সংগৃহীত

আজ ৮ জানুয়ারি। আজ থেকে ঠিক ৮০ বছর আগে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের এই দিনে অক্সফোর্ড শহরে আলাদা কোনো চমক ছিল না। ১৪ হিলসাইড রোডের ফ্রাঙ্ক হকিং ও তাঁর স্ত্রী ইসাবেলা অবশ্য খুশি ছিলেন অন্য কারণে। ওই দিন ইসাবেলার কোলজুড়ে এসেছে হকিং জুনিয়র। ঝটপট নাম রাখা হয়েছে স্টিফেন-স্টিফেন উইলিয়াম হকিং।

কিন্তু যাঁরা দিনক্ষণের কাকতালীয় ব্যাপারে খোঁজ রাখেন, তাঁরা ওই দিনটার তাৎপর্য জানেন। কারণ, ওই দিনের ঠিক ৩০০ বছর আগে (১৬৪২) ধরাধাম ত্যাগ করে যান আধুনিক বিজ্ঞানের স্থপতি গ্যালিলিও গ্যালিলি। আর পুরোনো ক্যালেন্ডার অনুসারে সেই বছরই কিন্তু নিউটনের জন্ম। হকিংকে কেউ এ কথা মনে করিয়ে দিলে হাসতেন তিনি—ওই দিন কমপক্ষে আরও দু‌ই শ শিশুর জন্ম হয়েছিল খোদ ইউকেতে!
স্কুলের শিক্ষকেরা তাঁকে সাধারণের ওপরে স্থান দিতেন। হকিং কেন জানি উচ্চাঙ্গসংগীত পছন্দ করতেন! অক্সফোর্ডে পড়তে এসে হকিং মোটামুটি জনপ্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। ছাত্রটি বাচাল ও দুষ্ট। কিন্তু পড়াশোনায় ভালো। কাজেই শিক্ষকেরাও তাঁকে পছন্দ করতেন। অনার্স শেষে কেমব্রিজে যান।

হকিংয়ের যে ছবি আমরা দেখি, সেটি হুইলচেয়ারে বসা একজন বিজ্ঞানীর। ১৯৬২ সালে পিএইচডির ছাত্র থাকাকালে তাঁর মটর নিউরন ডিজিজের কথা জানা যায়। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন বেশি দিন বাঁচবেন না হকিং। কিন্তু টিকে গেলেন। পিএইচডি থিসিসের কাজটা ছিল সহজ।

১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ করেন। ১৯২২ সালে ফ্রিডম্যান আপেক্ষিকতার সমীকরণের সমাধান করেন। তাতে দেখা যায়, এই দুনিয়া ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নিউটনের স্থির দুনিয়া তত্ত্বের লোকজন এতে আঁতকে ওঠেন, খোদ আইনস্টাইনও এই সমাধান নাকচ করেন। কিন্তু ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল দুরবিন দিয়ে সত্যটা দেখে ফেলেন—দুনিয়া আসলেই সম্প্রসারিত হচ্ছে! গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যদি আমি পেছনে যাই, তাহলে একসময় দেখা যাবে এই দুনিয়ায় সবকিছু এক বিন্দুতে ছিল। কোনো এক সন্ত্রাসী ঘটনায় সবাই দিগ্‌বিদিক হয়ে ছুটে চলেছে। এ থেকে উদ্ভব বিগ ব্যাং তত্ত্বের, যা আজকের কসমোলজির প্রাণ।

বিগ ব্যাংয়ের সমস্যা অন্যত্র। দুনিয়ার সবকিছু এক জায়গায় জড়ো করলে যা হয়, তাতে বিজ্ঞান একটু অস্বস্তিতে পড়ে। কারণ, এক বিন্দুর দুনিয়ার নাম সিঙ্গুলারিটি, যাতে জানা সমীকরণগুলোর ভগ্নদশা। ষাটের দশকে রজার পেনরোজের সঙ্গে হকিং দেখালেন তাঁর প্রথম খেল। বললেন, যতই আপত্তি থাকুক, সিঙ্গুলারিটি থেকেই দুনিয়ার শুরু। শুধু তা-ই নয়, বিগ ব্যাং থেকেই সময়ের শুরু। অর্থাৎ বিগ ব্যাংয়ের আগে বলে কিছু নেই। খ্যাপা, লোকজনের অনেকে হকিংয়ের কাছে জানতে চাইত, বিগ ব্যাংয়ের আগে ঈশ্বর কী করেছিলেন?

মুচকি হেসে হকিং বলতেন, অবিশ্বাসীদের জন্য নরক বানাচ্ছিলেন! সময়ের শুরুর ধারণা জেনে হকিং এগোলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। এরই মধ্যে জানা হয়েছে, বস্তুজগতে এমন বস্তু সম্ভব, যার থেকে দুনিয়ায় সবচেয়ে দ্রুতযান আলোও বের হতে পারে না—ব্ল্যাকহোল। ব্ল্যাকহোল কি আসলেই ব্ল্যাক? কিছুই কি সেখান থেকে বের হতে পারে না?
হুইলচেয়ারের বিজ্ঞানী ভাবেন। ভাবেন কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের অনিশ্চয়তার তত্ত্ব নিয়ে।

আরও পড়ুন

পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুটো কোয়ান্টাম রাশির যুগপৎ নিশ্চয়তা নেই। শূন্যস্থানে এই তত্ত্বের প্রয়োগ এরই মধ্যে বলে ফেলেছে, শূন্যস্থান আসলে শূন্য নয়। সেখানে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে কণা ও প্রতিকণা, আবার তা লয়ও পাচ্ছে। হকিং এই ঘটনাকে প্রয়োগ করলেন ব্ল্যাকহোলের আশপাশে এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলেন ব্ল্যাকহোল থেকেও বের হয়ে আসছে অবিরল কণাস্রোত। ১৯৭৩ সালে হকিং প্রকাশ করলেন তাঁর ধারণা এবং অচিরেই তা গৃহীত হলো। বিজ্ঞানজগৎ ওই বিকিরণকে অভিহিত করল হকিংয়ের নামে—হকিং রেডিয়েশন। ১৯৭৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হকিংকে বানাল গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর, একসময় যে পদ অলংকৃত করেছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন।

মধ্য-আশিতে এক অপারেশনের ফলে হকিং সম্পূর্ণভাবে বাক্শক্তি হারান। আগে থেকেই তাঁর কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। ছোট ছেলে টিমোথির বন্ধুর বাবা ডেভিড মেসন হকিংকে একটি কম্পিউটার বানিয়ে দেন, যা তাঁর হুইলচেয়ারের হাতলে ফিট করা। ক্যালিফোর্নিয়ার এক কম্পিউটারবিদ তৈরি করেছেন একটি বিশেষ সফটওয়্যার। শুধু আঙুল নাড়িয়ে হকিং কম্পিউটারের পর্দায় ফুটে ওঠা শব্দ নির্বাচন করেন। এভাবে তৈরি করেন বাক্য। ভয়েস সিনথেসাইজারের মাধ্যমে ওই বাক্য স্পিকার থেকে বের হয়ে আসে। আজকের গুগল ডুডলে ঢুকলে হকিংয়ের এই যান্ত্রিক স্বরই আপনি শুনতে পাবেন।

১৯৮৮ সালে স্টিফেন হকিংয়ের ‘A Brief History of Time: From the Big Bang to Black Holes’ প্রকাশিত হয়। বিশ্বজুড়ে আজ পর্যন্ত এক কোটি কপির বেশি বিক্রি হয়েছে এই বই। এখনো প্রতি মাসে সারা বিশ্বে এর প্রায় পাঁচ হাজার কপি বিক্রি হয়। প্রকাশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমেরিকায় ৪০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। ফলে দুটো উল্টো ছাপানো ছবিসহ ওই মার্কিন সংস্করণ সংশোধনের আগেই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়! বিজ্ঞানের দুরূহতম বিষয়ের এমন সহজবোধ্য বই এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি বলে ধারণা করা হয়। যদিও জটিল বিষয়বস্তুর কারণে অনেকেই বেশি দূর এগোতে পারেন না। এই বইয়ের শেষে হকিং তিনজন বিজ্ঞানী সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। গ্যালিলিও, নিউটন ও আইনস্টাইন। দুর্জনেরা বলেন, আগামী দিনের ব্রিফ হিস্ট্রিতে থাকবে চারটি জীবনী। চতুর্থটি হবে হকিংয়ের।

হকিংয়ের কাছে বিজ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ঈশ্বরের মন বুঝতে পারা। কীভাবে? এই বস্তুজগতের নিয়মাবলির সাধারণ, সহজ ও সরল সূত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই তত্ত্ব হবে সব পেয়েছির তত্ত্ব। হকিং তাঁর জীবনের শেষ সময়ে বেশি মাথা ঘামিয়েছেন কাল্পনিক সময়, ওয়ার্মহোল প্রভৃতি নিয়ে। বস্তুজগতে মোট চার ধরনের বল ও তাদের মিথস্ক্রিয়া আমরা অনুভব করছি প্রতিনিয়ত। মহাকর্ষ, বিদ্যুৎ- চৌম্বক, ক্ষীণ ও সবল পারমাণবিক বল। প্রকৃতি জগতের এই চারটি বলকে একত্র করে একটি সমন্বিত তত্ত্ব দাঁড় করানোই হলো এখনকার তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যে সবল, ক্ষীণ ও তড়িৎ-চৌম্বকত্বের এককত্ব প্রমাণিত। বাকি রয়েছে মহাকর্ষ। মহাকর্ষ সম্পর্কে সবচেয়ে সুন্দর তত্ত্বটি হলো আইনস্টাইনের সাধারণ তত্ত্ব। আর অন্যদিকে মাইক্রোওয়ার্ল্ডের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের কণারা মেনে চলে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কাজেই মেলাতে হবে এই দুই তত্ত্বকে—পেতে হবে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির সন্ধান। পরিণয়ের আগে পরিচয়ের পালাটি করিয়ে দিয়েছেন হকিং। ব্ল্যাকহোলের আচরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহাকাশে সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের।

হকিংকে বলা হয় আইনস্টাইনের পরে দুনিয়ার সবচেয়ে মেধাবী বিজ্ঞানী। কিন্তু তিনি আর দশজনের মতোই ছিলেন। আজকে গুগল ডুডলের সঙ্গে তাঁর পরিবারের বক্তব্য পড়লে আপনি জানবেন এই বিজ্ঞানী নিজের শারীরিক চ্যালেঞ্জের কাছে কখনো নত হননি। নিজের মনোজগতে এক আশ্চর্য দক্ষতায় ঘুরে বেড়াতেন। কেমব্রিজে তাঁর কক্ষে অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোর ছবি মনে করিয়ে দেয় আমাদের কালের নায়ক হলেও তিনি ছিলেন আমাদেরই লোক।

২০১৮ সালের ১৪ মার্চ হকিং দুনিয়ার মায়া কাটিয়েছেন। এই দিনটি ছিল (১৪ মার্চ) আইনস্টাইনের জন্মদিন। বেঁচে থাকলে আজ হকিংয়ের বয়স হতো ৮০ বছর।
শুভ জন্মদিন, স্যার স্টিফেন উইলিয়াম হকিং।