ভালোবাসার ইমোগুলো
নায়িকার সামনে নায়ক দাঁড়িয়ে আছে নিজের রক্তাক্ত হৃদয় হাতে নিয়ে, সেখানে শুধু নায়িকারই ছবি। আক্ষরিক অর্থেই হৃদয় চিরে দেখানো যাকে বলে আরকি? অনন্ত জলিল ও বর্ষা অভিনীত নিঃস্বার্থ ভালোবাসা চলচ্চিত্রের বড় আবেগঘন দৃশ্য এটি।
নায়কের দিক থেকে ‘হৃদয় চিরে দেখানো’র এ হুমকি বা আকুতি যুগের পর যুগ ধরে কী সিনেমা, কী বাস্তবজীবনে চলেই আসছে। যদিও প্রেম বা ভালোবাসার ব্যাপারে হৃদয় বস্তুটি একেবারে নাচার। এ বিষয়ে সত্যি বলতে কী, তার না আছে কোনো অভিজ্ঞতা, না আছে কোনো আগ্রহ। সময়ই বা কই, রক্ত পাম্প করতেই তো জীবন গেল। তবু মানুষের ধারা এই যে ভালোবাসা বললেই হৃদয়ের কথা তুলবেই। ব্যাপারটা প্রেম-ভালোবাসার মতোই গোলমেলে।
ভালোবাসার প্রতিকার কিংবা প্রকাশ
আধুনিক বিজ্ঞান জানে হৃদয় নিয়ে যত বাড়াবাড়িই হোক না কেন, মানুষের যাবতীয় অনুভূতির আকর আদতে মস্তিষ্ক। আজকের মানুষ এ সত্য জানেও। কিন্তু ওই যে ঐতিহ্য। অনেক সময় অনেক কিছুই ঢুকে পড়ে এ ঐতিহ্য বস্তুটিতে। আর মানুষ তা অনুসরণ করে চলে। তা না হলে হয়তো ভ্যালেন্টাইনস ডের প্রতীক হয়ে উঠত মস্তিষ্ক কোষ বা ঘিলু। অবশ্য এটা খুব একটা দৃষ্টিসুখকর হতো না। সে ক্ষেত্রে হৃদয় চিহ্নটিই সই। অবশ্য হৃদয়ের যে প্রতিরূপ হরহামেশা ব্যবহার করা হয়, তা আদতেই হৃদয়ের কি না, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।
এই অঞ্চলের প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার কিছু নিদর্শনেও এই হৃদয় চিহ্নের অস্তিত্ব রয়েছে। ভক্তি ও আবেগের সঙ্গে এর যোগ রয়েছে। ফলে সময়ের সঙ্গে এই অঞ্চলেও প্রতীক হিসেবে এই আকৃতি যাত্রা করে। আর যেহেতু অধিকাংশ অঞ্চলেই আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে হৃদয়ের যোগটিকে বহু আগেই অকাট্য ধরে নেওয়া হয়েছে, সেহেতু ভালোবাসার প্রতীক হিসেবেও এটি স্থান করে নিয়েছে সহজেই। আর সপ্তদশ শতকে শুরু হওয়া ও গত শতকের মাঝামাঝি এসে ভ্যালেন্টাইনস ডে উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে এর বাণিজ্যিক প্রসার হয়।
প্রেমে দূতিয়ালি থেকে শুরু করে বিরহ কিংবা শুভ পরিণয় কিংবা চূড়ান্ত বিচ্ছেদ—সবকিছুতেই ‘হৃদয়’ তার দায়িত্ব পালন করে আসছে বহুকাল ধরে। ঠিক কবে কোথায় এর শুরু, তা কেউ হলফ করে বলতে না পারলেও ব্যবহার করে যাচ্ছে হরদম। বর্তমানে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই হৃদয়ের ব্যবহার রয়েছে বিস্তর। কোনোটি অনন্ত জলিলের সেই রক্তাক্ত হৃদয়ের মতো, কোনোটি আবার পটোলের সবুজ, কোনোটির গায়ে লেপ্টে আছে তারার দল, কোনোটি আবার রীতিমতো হৃদয়ের হাট নিয়ে বসে আছে। হ্যাঁ, ইমোজির কথাই বলা হচ্ছে। সামাজিক যোগযোগ এই যুগে বাস্তবের চেয়ে ভার্চ্যুয়ালেই বেশি হয়। আর এই ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগে ইমোজির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। কারণও আছে। খুব সহজে মাত্র একটি চিহ্ন দিয়েই অনেক কথা বলে ফেলা যায়। এতে দুই পক্ষেরই লাভ। কারণ, যে বলছে এবং যার জন্য বলছে, দুজনেরই তো সময়ের অভাব।
সে যাক। বর্তমানে বিভিন্ন মাধ্যমে ইমোজির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এই ইমোজিগুলোর মধ্যে রয়েছে একগাদা হৃদয়, যেগুলোর একটি ‘অনন্ত প্রেম’ বোঝালে অন্যটি বোঝাতে পারে প্রেমহীনতাও। এমনকি তথাকথিত ‘প্রেম’ না হলেও ‘হৃদয়’ পাঠাতে ক্ষতি নেই। কারণ, হৃদয় দিয়ে বন্ধুত্বের প্রকাশও হয়। ফলে কোন ঘটনায়, কাকে কী কারণে ‘হৃদয়’ ইমোটি পাঠানো হচ্ছে, তা জানা-বোঝার জন্য আগে এই ইমোগুলোর অর্থটা জানা থাকা জরুরি।
হৃদয়ঘটিত যত ইমো
কাউকে ইমোজি পাঠানোর সময় একটু সচেতন থাকা জরুরি। কারণ, সবাইকে সব ইমোজি পাঠানো যায় না। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে না বুঝেই অনেকে হৃদয় দিয়ে বসেন। দেখতে ভালো লাগছে, ব্যস, পাঠিয়ে দেওয়া গেল। কিন্তু যাকে পাঠানো হলো, সে যদি এ বিষয়ে টনটনে হয়, তবে তার কাছে অর্থই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তাই ইমোজি পাঠানোর ক্ষেত্রে জেনেবুঝেই পাঠানো উচিত। এই যেমন লাল টুকটুকে হৃদয় শুধু প্রেম নিবেদনেই নয়, কাউকে কৃতজ্ঞতা জানাতেও ব্যবহার করা যায়। হঠাৎ প্রেমানুভূতি বোঝাতে ‘স্মাইলিং ফেস উইথ হার্টস’ ইমো ব্যবহার করা যায়। আর ‘প্রেম আমার ওপর পড়েছে’ বোঝাতে হলে অবশ্যই হৃদয়ের চোখসংবলিত হাস্যোজ্জ্বল মুখের ইমোই দস্তুর। এ ক্ষেত্রে অবশ্য পশ্চিমের কিউপিড আর আমাদের মদন রাজার স্মরণে তৈরি ইমো শরবিদ্ধ হৃদয়ের ইমোও খাটে বেশ ভালো। তবে ফিতায় বাঁধা হৃদয় পাঠানোর আগে ভাবুন প্রেমাস্পদকে ঠিক কী উপহার দিতে চান। এই ইমো পাঠিয়ে চুপচাপ বসে থাকলে কিন্তু চলবে না। কারণ, অন্য অনেক কিছু হলেও ‘প্রেম উপহারে’র স্থান ইমোর পক্ষে নেওয়াটা এখনো সম্ভব হয়নি।
কারও দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কিংবা বিশ্ব শান্তি বা বৃহত্তর মানবতার সমর্থনে দিতে পারেন স্পার্কলিং হার্ট ইমো। সুখ ও শান্তি কামনায় এই ইমো দেওয়া হয়। হৃদয়াবেগ আর ধারণ করা যাচ্ছে না? গর্ব কিংবা আনন্দ-অনুভূতি যা-ই হোক না কেন, এ ধরনের পরিস্থিতি প্রকাশের জন্য রয়েছে ‘গ্রোয়িং হার্ট’ ইমো। আর ঠিক বিপরীত অবস্থাটি হচ্ছে কম্পমান হৃদয় বা বিটিং হার্ট। দিলেন তো, সবাই জেনে গেল, আপনার বুক ঢিপঢিপের কথা। হতে পারে ভয়ে, হতে পারে অজানিত প্রেমের পদধ্বনি শুনে। রয়েছে দুটি বা চারটি ঘূর্ণমান হৃদয়ের ইমো। এটি মূলত পরস্পরকে সমানভাবে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে পাঠানো হয়। অর্থাৎ আমায় যতটা ভালোবাসো, আমিও ততটাই ভালোবাসি; অনেকটা পাড়ার মুদিদোকানির মতো টনটনে হিসেবি। দুটি হৃদয়ের ইমো মূলত রোমান্টিক অবস্থা বোঝাতে পাঠানো হয়।
ভাঙা হৃদয়ের অর্থ কে না বোঝে। তবে ইমো পাঠানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকতে হয় রং নির্বাচনের ক্ষেত্রে। কারণ, সব রঙের অর্থ এক নয়। লাল রঙের হৃদয় প্রেমের প্রকাশ হিসেবেই পাঠানো হয়। কিন্তু কালো হৃদয়টি ‘দাও দুঃখ, দুঃখ দাও—আমি দুঃখ পেতে ভালোবাসি’ বলে নিজের বিরহপ্রেমী সত্তাটির জানান দিতেই পাঠাতে হয়। আর গোলাপি হৃদয়টি প্রেমের প্রকাশ হিসেবে পাঠানোর আগে ভাবুন, আপনি নারী কি না এবং আরেক নারীকেই পাঠাচ্ছেন কি না। কিংবা পুরুষ হয়ে আরেক পুরুষকে।
‘পড়ে নিও তুমি তাকে, দেখে নিও আকাশে নয়তো/ সেই শব্দ “ভালোবাসি” নক্ষত্রের মতোই হয়তো’—এই যদি হয় অবস্থা তবে উদ্দীষ্টকে নীল হৃদয়টি পাঠানোই ভালো। তবে অনেক সময় বন্ধুর বিচ্ছেদে তাকে সান্ত্বনা দিতেও কষ্টের রং নীলে ভরা এ হৃদয় পাঠানো হয়। আর হলদে হৃদয় হচ্ছে প্রেম প্রেম খেলার স্মারক। এটি কোনো সত্যিকারের ভালোবাসার বার্তা দেয় না। আর ‘লাভ হোটেল’ ইমোটি পাঠানোর আগে নিশ্চিত হওয়াটা ভালো যাকে পাঠানো হচ্ছে, রাতের ডেটে তাকে ডাকা যায় কি না।
ঠিক একইভাবে হৃদয়খচিত গির্জা বা মন্দির পাঠানোর আগে বিয়ের সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত হয়েছে কি না তা আরেকবার ভেবে নিন। তবে এসব বৃত্তান্ত শুনে ভড়কে যাওয়ার কিছু নেই। কারণ, কোন ইমো কার কাছে কী অর্থ বহন করবে, তা ওই ব্যক্তিদের মধ্যকার সম্পর্ক ও পরিস্থিতিই অনেকাংশে ঠিক করে দেয়। এ ক্ষেত্রে ‘খাতা দেখে গান না গাওয়াই ভালো’।