ভবিষ্যৎ শঙ্কায় ফেলে জাকারবার্গ চুপ কেন?
যোগাযোগ প্রযুক্তি এখন আমাদের জীবনের অংশ। কিন্তু আমরা যদি ব্যক্তিগত তথ্যের নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারি, তবে প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেবে। গণতন্ত্রের উন্নতির জন্য এটা চলতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে তথ্যের অপব্যবহার নতুন কিছু নয়। দেখা যাচ্ছে যে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রভাব ফেলতে ব্যক্তিগত অনেক অগুরুত্বপূর্ণ তথ্য মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
এমনটাই মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা ব্যবহারকারীর তথ্য অনৈতিকভাবে রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছে সরবরাহের অভিযোগ করছেন ফেসবুকের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে তদন্তের পাশাপাশি ডিলিট ফেসবুক কর্মসূচির ডাক দেওয়ার কথা বলছেন রাজনীতিবিদেরা।
ফেসবুকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে ফেসবুক। কিন্তু চুপচাপ আছেন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। প্রশ্ন উঠছে, এখন তিনি চুপ কেন?
গত সোমবার ফেসবুকের তথ্য বেহাত হওয়ার খবর ছড়ালে শেয়ারের দাম ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ পড়ে যায়। এতে কোম্পানির ৩৬০০ কোটি মার্কিন ডলার দাম কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা দুশ্চিন্তায় পড়েন। ফেসবুকে জাকারবার্গের শেয়ার ১৬ শতাংশ। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সম্পদ ৫৫০ কোটি মার্কিন ডলার কমে ৬ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে আসে।
ফেসবুকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা একটি ডিজিটাল ফরেনসিক প্রতিষ্ঠানকে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করার দায়িত্ব দেবে। ওই প্রতিষ্ঠানটি ফেসবুকের কোনো তথ্য জমা রেখেছ কি না, তা যাচাই করবে ফেসবুক।
চলতি সপ্তাহে দ্য অবজারভারের প্রতিবেদনে জানানো হয়, গ্লোবাল সায়েন্স রিসার্চ নামের একটি প্রতিষ্ঠান কয়েক কোটি ফেসবুক প্রোফাইলের তথ্য সংগ্রহ করে এবং তা কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাছে বিক্রি করে। গত শনিবার নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এখনো কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাছে বেশির ভাগ বা পুরো তথ্য রয়েছে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা অনৈতিক উপায়ে ওই তথ্য হাতানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
ফেসবুক এক বিবৃতিতে বলেছে, এখনো যদি ওই তথ্য থেকে থাকে, তবে তা হবে ফেসবুকের নীতিমালার চূড়ান্ত লঙ্ঘন এবং ওই গ্রুপগুলো ফেসবুকের সঙ্গে যে বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা অগ্রহণযোগ্য লঙ্ঘন।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের রাজনীতিবিদেরা জাকারবার্গকে দ্রুত তথ্য বেহাত হওয়ার বিষয়টি তদন্ত করতে বলেছেন। গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর রন ওয়েডেন ওই তথ্য ফাঁসসংক্রান্ত তথ্য জানতে চেয়ে জাকারবার্গের কাছে কতগুলো প্রশ্ন পাঠিয়েছেন। ১৩ এপ্রিলের মধ্যেই ওই প্রশ্নের জবাব দিতে বলা হয়েছে। সিনেটের জুডিশিয়ারি কমিটির দুই সদস্য ফেসবুক, টুইটার ও গুগলের প্রধান নির্বাহীদের শুনানির জন্য ডাকার কথা বলছেন।
কনজারভেটিভ দলের এমপি ড্যামিয়েন কলিন্স বলেছেন, ফেসবুক পেজের আড়ালে মার্ক জাকারবার্গের লুকিয়ে থাকার সময় শেষ। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার অফিসে ফেসবুকের নিয়োগ করা অডিটরদের বের করে দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের তথ্য কমিশনার অফিসের কর্মকর্তারা। তাঁরা নিজস্ব তদন্ত চান। এ প্রসঙ্গে কলিন্স বলেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখবে।
গত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অবৈধভাবে প্রভাব রাখায় ও বিদেশি এজেন্টদের এসব প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগে ফেসবুক, টুইটার ও গুগলকে ওয়াশিংটনে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ওই সময় তিনটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই তাদের আইনজীবীদের পাঠানো হলে তা সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। তবে এবার কংগ্রেসের প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া এড়াতে পারবেন না জাকারবার্গ।
দীর্ঘদিন ধরেই বিশেষজ্ঞরা ফেসবুকের প্রাইভেসিসংক্রান্ত চর্চা সমালোচনা করে আসছেন। কিন্তু এ সমালোচনা ফেসবুক গ্রাহ্য করেনি। বর্তমানে ২০০ কোটির বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী আছে ফেসবুকে।
ফেসবুক কর্তৃপক্ষ একজন মনোবিজ্ঞানীকে নিয়োগ দিয়েছিল, যাঁর প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে তথ্য বিক্রি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এখন এ কেলেঙ্কারিতে ব্যবহারকারীর আস্থার সংকট তৈরি হবে কি না, তা দেখার বিষয়। তবে বিশ্লেষকেরা অনুমান করছেন, নতুন অভিযোগে অস্তিত্বের সংকটে পড়তে পারে ফেসবুক। এতে একদিকে যেমন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটির ওপর ব্যবহারকারীদের আস্থা কমে যেতে পারে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ব্যবসায়িক সুনাম। ইতিমধ্যে গতকাল টুইটারে হ্যাশট্যাগ ডিলিট ফেসবুক (#DeleteFacebook) নামে ফেসবুক ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করার কথা জানান অনেকেই। অনেকেই আবার জাকারবার্গের চুপ থাকা নিয়ে হ্যাশট্যাগ হোয়ারসজাক (#WheresZuck) নামে টুইট করেন।
সোমবার আরেকটি ঘটনা ঘটেছে ফেসবুকের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা অ্যালেক্স স্ট্যামোসকে কেন্দ্র করে। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেসবুকে রাশিয়ান হস্তক্ষেপের বিষয়টির তদন্ত নিয়ে ফেসবুকের অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে একমত হতে পারেননি স্ট্যামোস। তিনি ফেসবুক ছেড়ে দিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে স্ট্যামোস বলেছেন, গুঞ্জন সত্ত্বেও বলতে পারি, ‘এখনো ফেসবুকের সঙ্গে আছি। আমার দায়িত্ব বদলাতে পারে। আমি এখন নতুন নিরাপত্তা ঝুঁকিগুলোর পাশাপাশি নির্বাচনসংক্রান্ত নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে বেশি কাজ করছি।’
অবশ্য ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বরে স্ট্যামোসের দায়িত্ব বদল হয় এবং তাঁর অধীনে থাকা ১২০ জন কর্মীর পুরো দলটিকে অন্য বিভাগে বদলি করা হয়। তিনি আগস্ট পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যেতে চেয়েছেন।
ফেসবুকের এক মুখপাত্র বলেছেন, স্ট্যামোস ফেসবুকের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব চালিয়ে যাবেন। তিন বছরের বেশি সময় ধরে তিনি আছেন এবং নতুন ঝুঁকিগুলো নিয়ে কাজ করছেন। তিনি ফেসবুকের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। প্রতিদিন তিনি যা করছেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞ।
ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ ও প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা শেরিল স্যান্ডবার্গ এ বিষয়ে চুপ থাকলেও স্ট্যামোস একমাত্র কর্মকর্তা, যিনি তথ্য বেহাত হওয়ার বিষয়টি ধরতে পেরেছেন।
দ্য গার্ডিয়ান ও ব্লুমবার্গ অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন