ফটোশপ! ফটোশপ!
ফটোশপ সফটওয়্যারটি কমবেশি সবারই চেনা। ছবি সম্পাদনার জনপ্রিয় একটি সফটওয়্যার এটি। ১৯ ফেব্রুয়ারি এ সফটওয়্যারটির রজতজয়ন্তী পালন করল অ্যাডোবি সিস্টেমস।
২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ফটোশপ সফটওয়্যারটির নির্মাতা থমাস নোল এর নৈতিক ব্যবহারের জন্য সবার প্রতি অনুরোধ করেছেন।
থমাস নোল জানিয়েছেন, ফটোশপ শব্দটি ইংরেজি ভাষায় স্থান করে নিয়েছে, এতে আমি গর্বিত। আপনারা যখন টিভি দেখেন বা ছবি উপভোগ করেন, তখন ফটোশপ শব্দটিকে ভার্ব (ক্রিয়া) হিসেবে ব্যবহার করেন। অ্যাডোবি হয়তো ট্রেডমার্কের কারণে ফটোশপকে ক্রিয়াবাচক শব্দ হিসেবে শুনতে পছন্দ করে না, কিন্তু আমি যখনই এটা শুনি, আমার রোমাঞ্চ বোধ হয়।
ফটোশপের অবশ্য একটা খারাপ দিকও রয়েছে, আর তা হচ্ছে মূল ছবিকে ফটোশপের সাহায্যে বিকৃত করে উপস্থাপন করার বিষয়টি। নোল বলেন, ‘ফটোশপ ব্যবহার করে ছবি বিকৃত করার বিষয়টি আমার মূল উদ্বেগের জায়গা।’
অন্যান্য টুলের মতোই ফটোশপ এমন একটি টুল বা সফটওয়্যার, যা খারাপ কাজে লাগানো যায়। আমি ফটোশপ ব্যবহারের অনেকগুলো দিক নিয়ে খুব বেশি খুশি নই। বিশেষ করে নারীর শারীরিক বিভিন্ন দিক এই সফটওয়্যার দিয়ে পরিবর্তন করা হয়, সে বিষয়টি। আমি খুশি হতাম, যদি ফটোশপ ব্যবহারকারীরা নারীর শরীর বিকৃত করা থেকে বিরত থাকতেন। আরেকটি বিষয়ে আমি উদ্বিগ্ন, আর তা হচ্ছে সংবাদপত্র ব্যবসায় এ সফটওয়্যারটির অনৈতিক ব্যবহার, যাতে মানুষকে ধোঁকা দেওয়া হয়।
নোল আরও বলেন, আলোকচিত্রের অনেক দিক আছে, যেখানে একই বিষয় অনেক সৃজনশীল ও কার্যকর উপায়ে তুলে আনা যায় এবং সৌন্দর্য বাড়ানো যায়। এই সফটওয়্যারটি খারাপ কাজে লাগানো যায়, আবার খুব ভালোভাবে ব্যবহারও করা যায়। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির নিজস্ব নৈতিকতার ওপর এবং তাকে নৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলন দেখাতে হবে।
ফটোশপের ইতিহাস
ফটোশপ তৈরির প্রথম পর্যায়টি ছিল কৌতূহল জাগানিয়া। মার্কিন প্রকৌশলী থমাস নোল ব্যক্তিগত একটি প্রকল্প হিসেবে ফটোশপ তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। সেটা ১৯৮৮ সাল। ফটোশপ তৈরির শুরুতেই থমাস নোল তার ভাই জন নোলকে এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করেন। এ সময় এই প্রকল্পের নাম ছিল ডিসপ্লে। এরপর একে একে এই প্রকল্পটিতে অনেক ফিচার যুক্ত হতে থাকে। ১৯৮৯ সালে অ্যাডোবির কাছে এই সফটওয়্যারটি বিক্রি করে দেন তাঁরা। ১৯৯০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ফটোশপ নাম দিয়ে ছবি সম্পাদনা করার সফটওয়্যারটি উন্মুক্ত করে অ্যাডোবি। ওই সময় অবশ্য ছবি ডিজিটাইজ করা খুব সহজ ছিল না। ছবি ডিজিটাইজ করা গেলেও তা বের করা ছিল আরও কঠিন কাজ। নোল বলেন, প্রথম প্রিন্ট করতে দুই হাজার ডলার খরচ হয়েছিল তাঁর। প্রথমদিকে এই সফটওয়্যারটির ক্রেতা আলোকচিত্রীদের পরিবর্তে গ্রাফিকস শিল্পী ও সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত পেশাদার ব্যক্তিরা ছিলেন।
ফটোশপে সম্পাদনা করা প্রথম ছবির গল্প
ছবি এমন আহামরি কিছু নয়। এটি যে পৃথিবী কাঁপানো কোনো ছবি হতে পারে, তা ছবি দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এই ছবিই তৈরি করেছে ইতিহাস। ১৯৮৭ সালে বোরা বোরা দ্বীপে বান্ধবী জেনিফারের (বর্তমান স্ত্রী) একটি টপলেস ছবি তুলেছিলেন প্রকৌশলী জন নোল। তাঁরা দুজন সে সময় কাজ করতেন লুকাস ফিল্মের স্পেশাল ইফেকটস কোম্পানি ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইট অ্যান্ড ম্যাজিক প্রকল্পে। ওই ছবি তোলার সময় দুজন ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন।
ওই ছবি তোলার ঘটনা স্মরণ করে জেনিফার বলেন, ‘সত্যিই আমাদের জন্য জাদুকরি সময় ছিল তখন। ওই দিন ছবি তোলার পরে কোনো একসময় আমার স্বামী আমাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল। সম্ভবত ওই ছবি তোলার পরপরই। আর আশ্চর্যের বিষয় নোল ওই ছবির নাম দিল জেনিফার ইন প্যারাডাইস।’
কিন্তু ছবি তোলার পর সমস্যায় পড়ে গেলেন নোল। ছবিটি ডিজিটাইজ করতে গিয়ে তিনি মুখোমুখি হলেন কারিগরি সমস্যায়। ওই সময়ের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির হার্ডওয়্যার পিক্সার ইমেজ কম্পিউটারে ছবিটি সম্পাদনা করতে গিয়ে তিনি বের করলেন ইমেজ প্রসেসিং সফটওয়্যারটির জটিলতার বিষয়টি। তিনি সেই সময় সাক্ষাৎ করলেন তাঁর বড় ভাই থমাস নোলের সঙ্গে। থমাস ওই সময় (১৯৮৭) মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ভিশন নিয়ে ডক্টরেট করছিলেন এবং অ্যাপলের সাশ্রয়ী ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারে ব্যবহার উপযোগী ইমেজ প্রসেসিং সফটওয়্যার তৈরিতে কাজ করছিলেন। থমাসের ওই সফটওয়্যারে তখন ছবি সম্পাদনা করার নানা ফিচার যুক্ত করতে উৎসাহ দিলেন তিনি।
নোল বলেন, ‘প্রথমদিকে শখের বসে শুরু হলেও আমি পরে আরও নতুন নতুন ফিচার যুক্ত করার পরামর্শ দিতে থাকি। একসময় মনে হতে থাকে, এই সফটওয়্যারটি আমরা বিক্রি করতে পারব। কিন্তু সমস্যা হলো ওই সময় ডিজিটাল ছবি ছিল অপ্রতুল। তাই আমাদের সফটওয়্যারের কারিকুরি বোঝানো অসম্ভব ছিল। তখন অ্যাপলের অ্যাডভান্সড টেকনোলজি গ্রুপ ল্যাবে কাজ করতেন আমার এক বন্ধু। তখন ফ্ল্যাটবেড স্ক্যানার ছিল দুর্লভ জিনিস। অ্যাপলের ওই গবেষণাগারে ছিল একটি স্ক্যানার। সেটিই ব্যবহার করলেন তিনি। তখন তাঁর হাতে ছিল তাঁর স্ত্রী ৬ ইঞ্চি বাই ৪ ইঞ্চি মাপের প্রিন্ট করা একটি ছবি আর এভাবেই ফটোশপের কল্যাণে জেনিফার ইন দ্য প্যারাডাইজ হয়ে উঠল প্রথম রঙিন ছবি।’
নোল বলেন, ‘জেনিফারের ছবিটিকে ডেমো হিসেবে ব্যবহার করার জন্য উপযুক্ত ছিল। এটা দেখে খুব ভালো লাগল যে এই সফটওয়্যরাটি দিয়ে ছবি নিয়ে নানা কাজ করা যায়। এ ছাড়া ফটোশপ নিয়ে নিখুঁত ছবি পাওয়ার বিষয়টিও মাথায় গেথে গেল। এরপর নোল যখন কোনো প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে যেতেন, তখন এই সফটওয়্যারটির একটি প্যাকেজ জেনিফারের ছবিসহ রেখে আসতে হতো। ফিরে এসেই নোল দেখতে পেতেন যে প্রোগ্রামাররা তাঁর স্ত্রীর আরেকটি ক্লোন তৈরি করে ফেলেছে!’