টিকটকে অসম্ভবকে সম্ভব করাই খাবি লামের কাজ
করোনাকালে কারখানার কাজ হারিয়ে খাবি লামে পড়ে রইলেন টিকটক নিয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয়ে খুদে ভিডিও বানাতে শুরু করেন। নির্বাক ভিডিওগুলো তাঁকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিল। অর্থ দিল, খ্যাতি দিল। তবু দুঃখের পুরোটা ঘোচাতে পারল না।
উত্তর ইতালির শহর কিবাসোর এক কারখানায় কাজ করতেন খাবানে লামে। যেভাবেই হোক, দিন চলে যেত। তবে গত বছর করোনাকালের শুরুতে সে কাজটিও হারান।
এরপর ফিরে যান মা–বাবার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে। বাবা বারবার নতুন কাজ খুঁজতে বললেও খাবানে পড়ে রইলেন টিকটক নিয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করে ভিডিও বানিয়ে পোস্ট করা শুরু করেন ‘খাবি লামে’ নামে।
যেভাবে পৌঁছে গেলেন বিশ্ববাসীর কাছে
টিকটকে ডুয়েট এবং স্টিচ নামে দুটি অপশন খুদে ভিডিও নির্মাতাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। ডুয়েটে মূল নির্মাতার ভিডিওর সঙ্গে নতুন ভিডিও যুক্ত করা যায়। দুটি একই সঙ্গে পাশাপাশি চলে। আর স্টিচে মূল ভিডিও দেখানোর পর নির্মাতা তাঁর ভিডিও যুক্ত করেন।
খাবি লামে এই দুই অপশন ব্যবহার করে ভিডিও বানাতে শুরু করেন। ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়েছে, এমন ভিডিওগুলো বেছে নিলেন তিনি। এরপর মূল ভিডিওতে দেখানো একই কাজ নিজের মতো করে কত সহজভাবে করা যায়, তা দেখাতে শুরু করেন ফলোয়ারদের। অনেকটা রিঅ্যাকশন ভিডিওর তরিকায়। টিকটক ব্যবহারকারীরাও সাদরে গ্রহণ করলেন খাবি লামের মজার ভিডিওগুলো।
কখনো কলার খোসা ছাড়িয়ে দেখান। কখনো মোজা পায়ে দেন। কখনো টিউব থেকে টুথপেস্ট বের করেন। নির্বাক সে ভিডিওগুলোতে ২১ বছর বয়সী খাবি লামে কিছু বলেন না ঠিকই, তবে অভিব্যক্তি দিয়েই যা বোঝানোর বুঝিয়ে দেন—‘এমন সহজ কাজটিও পারো না?’ যেন তিনি টিকটকের মুশকিল আসান বাবা। সব সমস্যার সমাধান তাঁর কাছে।
শুরুর দিকে ভিডিওগুলো অবশ্য নির্বাক ছিল না। ইতালীয় ভাষায় তৈরি ভিডিওগুলোতে ইতালীয় সাবটাইটেল যোগ করতেন। তবে নির্বাক ভিডিও দিয়েই পৌঁছান মানুষের কাছে। এখন টিকটকে লামের অনুসারী ৭ কোটি ৩৬ লাখ।
যে হারে সংখ্যাটি বাড়ছে, আর তা যদি বজায় থাকে, তবে অচিরেই সবচেয়ে বেশি অনুসারী তাঁরই হবে। বর্তমানে শীর্ষে আছে চার্লি ডামেলিও—টিকটকে ১৭ বছরের এই তরুণীর অনুসারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৭৯ লাখ।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খাবি লামে বলেছেন তাঁর চেহারা এবং অভিব্যক্তিই মানুষকে হাসায়। নিজের নির্বাক ভাব প্রকাশকে ‘সর্বজনের ভাষা’ হিসবে উল্লেখ করেন।
তা তিনি ঠিকই বলেছেন। অন্যান্য টিকটক তারকার ভিডিও যেমন সুসম্পাদিত, খাবি লামের তেমন নয়। অন্যান্য তারকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভিডিও বানিয়েছেন, তবে খুব কম। আবার নকল অনুসারী কিনতে অর্থ খরচ করেননি। তাঁর শীর্ষপানে এগিয়ে যাওয়ার পুরোটাই অরগানিক।
খাবি লামের ভাষায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সফল হওয়ার মূলমন্ত্র হলো ধৈর্য। প্রায় প্রতিদিন নতুন ভিডিও নিয়ে হাজির হন টিকটকে ও ইনস্টাগ্রামে।
কারখানায় শ্রমিকের কাজ হারিয়ে শুরু করেছিলেন টিকটকে ভিডিও তৈরি। এখন এটাই তাঁর পূর্ণকালীন কাজ। একটু ঘাঁটলেই তাঁর ইংরেজি, জার্মান, আরবি, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ এবং অন্যান্য ভাষাভাষী ভক্তদের ফ্যান পেজ পাওয়া যাবে।
টিকটকের ক্রিয়েটর ফান্ডের মাধ্যমে আয় করা শুরু করেছেন লামে। আবার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছেন। অনেক জনপ্রিয় তারকার সঙ্গে যৌথ ভিডিও বানানোর প্রস্তাব পাচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন।
এমনকি বাংলাদেশেও তাঁর ভক্ত কম নেই। এখন পর্যন্ত দুজনের ভিডিও চোখে পড়েছে, যারা খাবি লামের চেয়ে আরেক কাঠি সরেস।
ইতালিতে তিনি ইতালীয় হিসেবে স্বীকৃত নন
খাবি লামে আন্তর্জাতিকভাবে ‘ইতালীয় টিকটকার’ হিসেবে সমাদৃত হলেও দ্য নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, তিনি ইতালিতেই ইতালীয় হিসেবে স্বীকৃত নন। বয়স এক বছর থেকেই তাঁর ইতালিতে বসবাসের শুরু, পড়েছেন ইতালীয় স্কুলে, ইতালীয় ফুটবল ক্লাব জুভেন্টাসের পাঁড় ভক্ত। তবু তিনি ইতালির নাগরিক নন। আর তা কোনোভাবেই মানতে পারেন না খাবি লামে। বলেছেন, ‘সত্যি বলতে নিজেকে ইতালীয় হিসেবে প্রমাণ করতে আমার এক টুকরা কাগজের প্রয়োজন নেই।’
ইতালীয় পাসপোর্ট না থাকায় দীর্ঘদিন কোনো সমস্যায় পড়েননি ঠিকই। তবে সেটা খ্যাতির চূড়ায় ওঠার আগে। তাঁর সেনেগালের পাসপোর্টে এখন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তাতে তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। তারকা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নজরে আসতে শুরু করেছেন লামে।
দিন কয়েক আগে ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গকে খাবি লামের ইনস্টাগ্রাম ভিডিওতে কমেন্ট করতে দেখা গেছে। প্রাণের ফুটবল ক্লাব জুভেন্টাসের সাবেক ১০ নম্বর জার্সিধারী খেলোয়াড় আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরোকে সঙ্গে নিয়ে ভিডিও পোস্ট করেছেন গত মাসে।
ইতালির চেয়ে বাইরের দেশেই খাবানে লামের অনুসারী বেশি বলে মনে করেন তিনি। তাঁর পরিবারের আদিনিবাস সেনেগালে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের উল্লেখ বিশেষভাবে করতে হয়।
তারকাখ্যাতি থাকলেও খাবি লামে এখনো তাঁর ছোট্ট কক্ষে বড় ভাইয়ের সঙ্গেই থাকেন। ঘরের দেয়ালে সেনেগালের পতাকার পাশাপাশি জুভেন্টাসের স্কার্ফও নজরে আসে। আর ভিডিও করেন পুরোনো এক মোবাইল ফোনে। ঘরের আলোকসজ্জাও তেমন জুতসই নয়। তবু মানুষ তাঁকে ভালোবাসে।
সবচেয়ে বড় কথা, টিকটকের প্রতিযোগিতার মনোভাব তাঁকে স্পর্শ করেনি। আপন গতিতে এগিয়ে একে একে সবাইকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন ঠিকই, তবে অন্যান্য টিকটক তারকাদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল।
মানুষকে হাসাতে চেয়েছিলেন। তা তিনি করছেন। সঙ্গে দুহাত ভরে অর্থ আয় করছেন। তবু সেটা স্বপ্ন পূরণের মতো যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন। মাকে নিজেদের একটি বাড়ি উপহার দিতে চান। সেটা এখনো সম্ভব হয়নি ঠিকই, তবে এখন আর বেশি দূরের স্বপ্ন বলে মনে হয় না।
সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস