চালকবিহীন গাড়ির সঙ্গে টক্করে পারবে টয়োটা?

চালকবিহীন গাড়ি এড়াতে পারবে দুর্ঘটনা? ছবি: এএফপি
চালকবিহীন গাড়ি এড়াতে পারবে দুর্ঘটনা? ছবি: এএফপি

চলতি বছরের মার্চে উবারের চালকবিহীন গাড়ির চাপায় প্রাণ হারান এক পথচারী। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার ওই নারীর মৃত্যুই চালকবিহীন গাড়ির জগতে প্রথম প্রাণহানির ঘটনা। এ ঘটনার পর টেম্পি, পিটার্সবার্গ, সানফ্রান্সিসকো ও টরোন্টোর সড়ক থেকে উবারের চালকবিহীন গাড়ি সরিয়ে নেওয়া হয়। দুঃখ প্রকাশও করে উবার কর্তৃপক্ষ। তবে একটিমাত্র ঘটনা হলেও এ ঘটনার ব্যাপকতা অনেক। দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে।

এই মৃত্যু প্রথমেই যে বিষয়টির ওপর আঙুল তুলছে, চালকবিহীন গাড়ি বাজারে আনতে তড়িঘড়ি করছে গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে। প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা বলছেন, রোবো-ট্যাক্সির বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে। গাড়ি নির্মাতা সব বড় বড় ব্র্যান্ড স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক গাড়ি, ট্র্যাক তৈরিতে প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। এসব গাড়ি স্মার্টফোনের কয়েকটি স্পর্শেই হাতের নাগালে চলে আসবে। চলতি বছরেই অ্যারিজোনাতে রোবো-ট্যাক্সি আনার পরিকল্পনা নিয়েছে গুগলের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ওয়েমো। জেনারেল মোটরস (জিপি) বলছে, ২০১৯ সাল নাগাদ তারা যুক্তরাষ্ট্রে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ট্যাক্সিসেবা চালু করবে। এসব গাড়িতে না থাকবে প্যাডেল, না থাকবে স্টিয়ারিং হুইল। জার্মানির প্রসিদ্ধ গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফক্সওয়াগন ২০২১ সালের মধ্যেই সহজলভ্য করবে তাদের স্বয়ংক্রিয় গাড়িসেবা। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফোর্ডও ঘোষণা দিয়েছে স্বয়ংক্রিয় গাড়ির বাজারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে তারা। প্রজন্ম ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, মোবাইলআই ও বিএমডব্লিউয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ২০২১ সালের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় গাড়ি বিপণনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে ইনটেল। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি এমন প্রযুক্তি তৈরি করবে, যা অন্য প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করতে পারবে।

মাত্র কয়েক বছর আগে প্রথম চালকবিহীন গাড়ির ধারণা পাওয়া যায়। বলা হচ্ছে, ২০২০ সালের পরই শুরু হয়ে যাবে চালকবিহীন গাড়ির যুগ। তবে চালকবিহীন স্বয়ংক্রিয় গাড়ি কি নিরাপত্তা দিতে পারবে মানুষের জীবনের? এটি একেবারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, তবে এই গাড়ি ব্যবহারে কি দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব?

উত্তর যে ‘না’, তা তো মার্চের দুর্ঘটনাই বলে দিচ্ছে। দ্য কনভারসেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড (এনটিএসবি) উবারের ওই দুর্ঘটনার বিষয়টি তদন্ত করে। তদন্ত প্রতিবেদনে তারা বলে, এখনই কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। ওই দুর্ঘটনার ভিডিওতে দেখা যায়, হার্জবার্গ নামের ওই নারী বেশ শান্তভাবেই রাস্তা পার হচ্ছিলেন। তিনি কোনো গাড়ি আসতে দেখেননি বা গাড়ি আসার কোনো শব্দও পাননি এবং গাড়িটিও দিক পরিবর্তন করার কোনো ইঙ্গিত দেখায়নি। গাড়িটির গতিবেগ ছিল তখন ঘণ্টায় ৪৩ কিলোমিটার। এ ছাড়া গাড়ির ভেতরের এক ক্যামেরায় দেখা যায়, উবারের ব্যাকআপ ড্রাইভার নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। আর অল্প সময়ের মধ্যেই এ দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

স্বয়ংক্রিয় গাড়িগুলো ‘লাইডার’ নামে এক লেজার রেঞ্জিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে। মূলত, এর মাধ্যমেই গাড়িগুলো যাত্রাপথের একটি থ্রিডি ম্যাপ তৈরি করে এবং সামনে, পাশে, পেছনে ঠিক কী কী বাধা রয়েছে, তা বুঝতে পারে। রোবো-ট্যাক্সি ফার্মগুলো শহরটির প্রতিটি অংশের লাইডার তথ্য সংগ্রহ করে, যেখানে তারা তাদের গাড়িগুলো স্থাপন করতে পারে। এনটিএসবি ওই দুর্ঘটনার তদন্তে দেখতে পায়, ছয় সেকেন্ড আগে হার্জবার্গের অস্তিত্ব টের পায় সেন্সর। তবে সেন্সর থেকে মূল সিস্টেমে সংকেত পৌঁছাতে কোনো একটি সমস্যা তৈরি হয়।

এসব দিক বিবেচনা করে জাপানের গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টয়োটা এই ইঁদুরদৌড়ে নামছে না; বরং এমন গাড়ি নির্মাণে মনোযোগী হচ্ছে তারা, যে গাড়ি সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টিই ইতিহাস করে দেবে।

চালকবিহীন গাড়ি ফক্সওয়াগন
চালকবিহীন গাড়ি ফক্সওয়াগন

প্রতিবছর প্রায় এক কোটি গাড়ি বিক্রি করে টয়োটা। এত বিক্রি অথচ স্বয়ংক্রিয় গাড়ি তৈরি করতে যেন ঢিমেতালে এগোচ্ছে তারা। গ্রাহককে কোনো ধরনের আশ্বাস না দিয়ে বরং গাড়ি তৈরিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) দিকে নজর দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি, যা গাড়ি চালনার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেবে আর ড্রাইভিং হবে আনন্দদায়ক।

আসলে কোন বয়সের গ্রাহকের দিকে নজর টয়োটার? বিষয়টি বেশ মজার। টয়োটার আশু ভাবনা হলো একটু বয়স্ক গ্রাহক নিয়ে। এমন গাড়ি তারা আনতে চাইছে, যা বয়স্ক মানুষকে গাড়ি চালনায় সাহায্য করবে। প্রযুক্তির সাহায্যে তাদের ড্রাইভিংয়ে ভুল ধরিয়ে দেবে। গাড়িতে এমন সফটওয়্যার থাকবে, যার মাধ্যমে দুর্ঘটনার বিষয়টি আগেই আঁচ করা যাবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। অর্থাৎ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এমন সম্ভাব্য বিবেচনা করে প্রয়োজনমতো ব্যবস্থা নেবে গাড়িটি নিজেই। এ ছাড়া আরেকটি সফটওয়্যার থাকবে, যা গাড়িটিকে হালকা ট্র্যাফিকের দিকে পরিচালিত করবে, চালকেরা তখন একটু আরাম করতে পারবেন। সংঘর্ষ এড়াতে পূর্বসতর্কতাভিত্তিক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থাকার ফলে গাড়িগুলো পথচারী এড়িয়ে চলতে পারবে। আর রাস্তার লেন বদলের সময় বা সংঘর্ষের পূর্বে আগাম সতর্কবার্তা পৌঁছে দেবে চালকের কাছে। মূলত দেশের বাজারটাই ধরতে চাইছে টয়োটা। জাপানে প্রায় এক-চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠীর বয়স এখন ৬৫ বছরের ওপরে।

সিলিকন ভ্যালির টয়োটা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী গিল প্যাট বলেন, ‘ভাবুন তো এমন একটি গাড়ি, যা এতই ভালো যে কখনো দুর্ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। এমনকি চালক যা-ই করুক না কেন, দুর্ঘটনা ঘটবে না।’

তবে স্বয়ংক্রিয় গাড়ির তৈরির প্রতিযোগিতায় না নেমে কি ভুল করবে টয়োটা? এর উত্তরও সেই উবারের দুর্ঘটনা থেকেই পাওয়া যায়। ওই দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রাস্তায় পুরোপুরি চালকবিহীন গাড়ি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। টয়োটা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা প্যানেলের গবেষক রডনে ব্রুকস বলেন, ‘২০৩২ সাল পর্যন্ত কোনো অনিয়ন্ত্রিত রোবো-ট্যাক্সি সার্ভিস যুক্তরাষ্ট্রের শহরে চলবে না। তাই টয়োটা যা করছে, তা হলো পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় গাড়ি তৈরির পালে হাওয়া দিচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে পুরোপুরি অটোমেটিক গাড়ি তৈরির কাজকে এগিয়ে নিচ্ছে।

প্রযুক্তি গতির ওপর নিজেদের সীমা টেনেছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টয়োটা। এতে তাঁর বর্তমান ব্যবসায় খরচও বাড়ছে। কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় গাড়ি ছাড়ার আগে, রোবো-ট্যাক্সি ফার্মগুলো ম্যানুয়ালি একটি নিখুঁত বিস্তারিত ম্যাপ তৈরি করবে। এতে খরচ বেড়ে যাবে। ওই মূল্যবান তথ্য এলাকায় মানুষের আচরণ সম্পর্কে ধারণা দেয়, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অ্যালগরিদমে ব্যবহার করা হয়। সেই সঙ্গে রাস্তার লে আউটগুলো শেখানোর জন্য ব্যবহৃত হয় ওই সব তথ্য। টয়োটা তাদের পরবর্তী ভোক্তাচালিত গাড়িগুলোয় অল্প খরচে ওই সব তথ্য জড়ো করার পরিকল্পনা করেছে। ২০২৫ সাল নাগাদ প্রায় পাঁচ কোটি গাড়ি ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। নিরাপত্তার জন্য তাদের সব গাড়িতেই এখন বাইরের দিকে মুখ করা ক্যামেরা ও রাডার লাগানো হয়েছে। রাস্তার সব তথ্য তারা জড়ো করছে, যাতে পুরোপুরি অটোমেটিক সফটওয়্যার ব্যবহার করা যায়। বিষয়টি অভিনব। টয়োটাকে অবশ্য এটি নিশ্চিত করতে হবে যে এই গাড়িগুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে রিয়েল টাইমের তথ্য পাঠাবে।

তাই এটা বলা যেতে পারে, টয়োটা হয়তো রোবো-ট্যাক্সি তৈরির স্বপ্নকে তাড়া করছে না, তবে সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে পৌঁছাতে কাজ করে যাচ্ছে।