বৃষ্টি শিকদার, জ্যেষ্ঠ সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন গুগলে। কিছুদিন আগে দেশে এসেছিলেন তিনি। প্রথম আলো স্টুডিওতে উপস্থিত হয়ে শুনিয়েছেন নিজের অভিজ্ঞতা ও সাফল্যের কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুনির হাসান। সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হলো—
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: তোমার প্রোগ্রামিংয়ে কখন আগ্রহ তৈরি হলো?
বৃষ্টি শিকদার: আমি প্রোগ্রামিং শুরু করেছি ২০০৮ সালে। তখন শুনলাম যে একটা প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা হবে। ড. জাফর ইকবাল স্যারকে দেখার জন্যই প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম। এভাবেই শুরু, তারপর ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ স্যার বললেন, প্রোগ্রামিংয়ে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। দেশকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার কথা শুনে অনুপ্রাণিত হলাম। তার পর থেকেই প্রোগ্রামিং করা। এরপর ২০১২ সালে ইতালিতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াড ইন ইনফরমেটিকসে (আইওআই) অংশ নিয়ে ব্রোঞ্জ পদক পেলাম।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সে বছর হাইস্কুলে মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান তোমার ছিল। তাই না?
বৃষ্টি শিকদার: হ্যাঁ।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: তারপরই তো তুমি এমআইটিতে পড়তে গেলে।
বৃষ্টি শিকদার: হ্যাঁ, তারপর এমআইটি পড়তে গেলাম।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এমআইটিতে কম্পিউটারবিজ্ঞানে পড়েছ?
বৃষ্টি শিকদার: হ্যাঁ। আমি কম্পিউটারবিজ্ঞানে পড়েছি। ২০০৮ সালে আমি এমআইটিতে থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: তোমার এমআইটি–জীবন আরেকটু শুনতে চাই। তুমি কোথায় ইন্টার্নশিপ করেছ?
বৃষ্টি শিকদার: আমি চারটা সামারেই ইন্টার্নশিপ করেছি। প্রথম ইন্টার্নশিপ করলাম ২০১৫ সালে গুগলে। তারপর ২০১৬ সালে করলাম কোরাতে। ২০১৭ সালে ব্রিজওয়াটারে করার পর ২০১৮ সালে ইন্টার্নশিপ করলাম লন্ডনে অবস্থিত গুগলের ডিপমাইন্ডে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: ইন্টার্নশিপের জন্য ওরা কীভাবে নির্বাচন করে? মানে বাংলাদেশ থেকে কি কেউ ইন্টার্ন করতে পারবে?
বৃষ্টি শিকদার: অবশ্যই। অনলাইনে প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক চাকরির বিজ্ঞপ্তি থাকে। সেগুলোতে অনলাইনে আবেদন করতে হয় বা লিংকডইনে গুগল রিক্রুটার বা ফেসবুক রিক্রুটারের সাহায্য নিয়ে নিজেদের জীবনবৃত্তান্ত দেওয়া যেতে পারে। সাক্ষাৎকারে সাধারণত কোডিং নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়, যা আমরা আইওআইতে যে ধরনের কোডিং প্রশ্ন সমাধান করেছি, তার থেকে অনেক সহজ। ইন্টার্নশিপে যাওয়ার সুবিধা হচ্ছে যে ইন্টার্নশিপের জন্য যে কোডিংগুলো প্রয়োজন, সেগুলো লিডকোড নামে একটা ওয়েবসাইটেও অনুশীলন করা যায়। ইন্টার্নশিপে ভালো করলে সরাসরি রিটার্ন অফার বা কাজের অফার দেয়।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: তুমি কি পাস করে গুগলে যোগ দিয়েছ?
বৃষ্টি শিকদার: না, আমি পাস করে রুব্রিতে যোগ দিয়েছি। কিন্তু আমার প্রতিটা ইন্টার্নশিপের সময়ই রিটার্ন অফার ছিল।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: তোমার কোন কোন গুণের জন্য তোমাকে প্রতিষ্ঠানগুলো রিটার্ন অফার দিয়েছে বলে মনে হয়?
বৃষ্টি শিকদার: চাকরিতে নতুন জিনিস দেখে শিখতে পারছি কি না, শেখার পর তা কাজে লাগাতে পারছি কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ। সব ইন্টার্নের জন্যই প্রকল্প থাকে। মেন্টর ম্যানেজার থাকে। প্রকল্প কেন করা হচ্ছে? কেন কোড লিখছি? এগুলো প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে সহায়তা করবে, সে বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে। শিখতে পারা, বোঝা, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারা, নিজের পরিকল্পনার সমাধান উপস্থাপন, অন্যের সাহায্য নেওয়া, সহযোগিতার মাধ্যমে প্রকল্প শেষ করতে পারলেই রিটার্ন অফার দেয় প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: তুমি রুব্রিকে যোগ দিলে। সেটা পাস করার পরপরই।
বৃষ্টি শিকদার: হ্যাঁ, পাস করার পর আমি লন্ডনে গেলাম। তারপর ২০১৮ সালের অক্টোবরে আমি রুব্রিকে পূর্ণকালীন কর্মী হিসেবে যোগ দিলাম।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: রুব্রিকে তোমার কাজ কী ছিল?
বৃষ্টি শিকদার: রুব্রিকে আমি কাজ করেছি ডিসট্রিবিউটেড ফাইল সিস্টেম দলে। রুব্রিক হলো ক্লাউড ডেটা ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান। আমাদের যত ডেটাবেইস আছে, সেগুলো ক্লাউডে থাকে। ফলে ডেটাবেইসগুলোর কিছু ব্যাকআপ নিতে হয়। ধরুন, জিমেইলে লগইন করতে চাচ্ছি। তাহলে আমি কিন্তু জিমেইলে যখনই লগইন করতে চাচ্ছি, তখনই লগইন করতে পারছি। কারণ, জিমেইলের অনেক তথ্যের ব্যাকআপ স্টোর করা আছে। একটা চলে গেলেও আরেকটা থেকে আমি লগইনের তথ্য পাচ্ছি। এই তথ্যগুলো কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে, কীভাবে কম জায়গায় রাখা হবে বা ক্লাউড থেকে কত দ্রুত ডেটাগুলো ব্যবহার করা যাবে, তা নিয়ে কাজ করে রুব্রিক। আমি কাজ করতাম ফাইল সিস্টেম টিমে, যেখানে ডেটা সংগ্রহ ও সরবরাহ নিয়ে কাজ করা হতো।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: যত দূর জানি যে পাঁচ-ছয় বছর না হলে গুগলে জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী হওয়া যায় না। তুমি পাস করছে চারটা বছরও হয়নি। কেন তোমাকে ওরা নিয়োগ দিয়েছে বলে মনে করো?
বৃষ্টি শিকদার: আমি গুগলের জ্যেষ্ঠ সফটওয়্যার প্রকৌশলী, যাকে বলা হয় এল ফাইভ এ। আপনি ঠিকই বলেছেন, ৫ থেকে ১০ বছরের কমে গুগলে এল ফাইভে কাজের জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় না। প্রথমে আমি এল ফোরের জন্য সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম। সাক্ষাৎকার অনেক ভালো হলো। বিহেভিয়ার সাক্ষাৎকার যখন আমাকে প্রকল্প নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, তখন আমি সেগুলো ভালোভাবে বলতে পেরেছিলাম। তো এই দুটো কারণে আমাকে নিয়োগকর্তা বললেন যে এল ফাইভের জন্য একটা সাক্ষাৎকার দিতে। শুনে একটু ভয় পেয়েছিলাম। গুগলে জ্যেষ্ঠ সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করা বাংলাদেশি বড় ভাইদের পরামর্শ নিলাম। রুব্রিকে ডিসট্রিবিউটেডে ফাইল সিস্টেম প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করায় কোডিংয়ের পাশাপাশি সিস্টেম কীভাবে কাজ করে, তা আমি বুঝতাম। এমআইটিতে আমি গ্র্যাজুয়েট ক্লাস নিতাম। সেখানে সিস্টেম ডিসট্রিবিউটেড সিস্টেম পড়ানোর জন্য গুগল বা আমাজনের বিভিন্ন ফাইল সিস্টেম কীভাবে বানানো হয়েছে, সে বিষয়েও আমার ভালো ধারণা ছিল। এসব কারণে আমার সাক্ষাৎকার বেশ ভালো হয়। ফলে গুগল আমাকে এল ফাইভ এ বা জ্যেষ্ঠ সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ দেয়।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বাংলাদেশ থেকে অনেকেই গুগলে সরাসরি সফটওয়্যার প্রকৌশলী, জুনিয়র সফটওয়্যার প্রকৌশলী, জ্যেষ্ঠ সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছে। গুগল বা এ রকম কোনো প্রতিষ্ঠানে সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করতে আগ্রহীদের জন্য তোমার পরামর্শ কী?
বৃষ্টি শিকদার: গুগলে যেতে হলে কোডিং জানতে হবে। কম্পিউটারবিজ্ঞানের মৌলিক জিনিস যেমন অ্যালগরিদম, ডেটা স্ট্রাকচার, কম্পিউটার সিস্টেম জানার পাশাপাশি সাক্ষাৎকারের জন্য অনুশীলন করতে হবে। কোডিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ দক্ষতাও বৃদ্ধি করতে হবে। আমি যে সমাধান লিখলাম, সেটা আমি কাউকে বোঝাতে পারছি কি না, তা–ও জানতে হবে। প্রিপারেশন কোডিং, কমিউনিকেশন ও টেস্টিং—এই তিন বিষয় লক্ষ করে অনুশীলন করার পর বিভিন্ন স্থানে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে হবে।