২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

গভীর রাতে খাবার, ওষুধ পৌঁছে যাবে আপনার বাড়ি

মাঞ্চিসের চার উদ্যোক্তা—(বাঁ থেকে)  নাফিসা আনজুম, তামিম মৃধা, মোহাম্মাদ মাজ ও অনিত কুমার দাস
ছবি: সংগৃহীত

‘রাত যত বাড়ে, অপেক্ষা তত গভীর হয়’—কবির ভাষায় কথাটি বেশ মধুর শোনালেও, বাস্তবে কিন্তু রাতে অপেক্ষার সময় অতটা মধুর নয়। অন্তত ঢাকা শহরে তো নয়ই। ঢাকা শহরে রাতজাগা মানুষের সংখ্যা নেহাত কম না। কেউ পেশাগত কারণে, কেউ পড়াশোনার জন্য, কারও আবার রাতজাগা হয় বন্ধু আর পরিবারের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে। এই রাতজাগার সময় যখন খিদে পায়, তখন মন চাইলেও রেস্তোরাঁ থেকে পছন্দের খাবার আনা যায় না। ফলে ঘরে থাকা গড়পড়তা খাবার খেয়েই ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায় রাত কাটাতে হয় নিশাচরদের।
তবে এখন নিশাচরদের খিদা মেটাতে কাজ করে যাচ্ছে ‘মাঞ্চিস’ (https: //munchies.now.com.bd)। ধরুন, রাত দুইটার সময় ইউটিউবে একটা বিরিয়ানির ভিডিও দেখে আপনার বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছা করল। কিন্তু এই মধ্যরাতে কে আপনার জন্য বিরিয়ানি নিয়ে বসে আছে? কয়েক মাস আগে হলেও পুরান ঢাকায় গিয়ে বিরিয়ানির দোকান খোঁজা ছাড়া তেমন একটা উপায় ছিল না। এখন এই সমস্যার সমাধান নিয়ে এসেছে মাঞ্চিস।

মাত্র এক বছর বয়সী খাবার সরবরাহকারী অনলাইন উদ্যোগ মাঞ্চিস ঢাকা শহরের নিয়ে এসেছে রাতভর খাওয়াদাওয়ার বিরাট পসরা। রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত এই উদ্যোগ ঢাকা শহরের কোনায় কোনায় পৌঁছে দিচ্ছে মজার মজার খাবার। বিরিয়ানি হোক বা পিৎজা, আইসক্রিম বা কাবাব-পরোটা, মাঞ্চিসের মেনু থেকে বেছে গ্রাহকেরা যা অর্ডার করে থাকেন, রাতের আঁধার পেছনে ফেলে ঢাকার যেকোনো প্রান্তে মাঞ্চিসের রাইডাররা সেই খাবার পৌঁছে দেন।

করোনাকালে শুরু

২০২০ সালের নভেম্বর। করোনার প্রকোপ ঠেকাতে দেশজুড়ে চলছিল লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ। দিন নেই, রাত নেই—ঘরবন্দী মানুষদের সময়ে–অসময়ে দরকার পড়ছিল নানা প্রয়োজনীয় পণ্যের। কিন্তু ঘরের বাইরে যাওয়ার বিধিনিষেধ থাকায় বিপদে পড়তে হতো অনেককে। কঠিন সেই সময়ে অনিত কুমার দাস, নাফিসা আনজুম, তামিম মৃধা এবং মোহাম্মাদ মাজ নিজেদের আলাদা আলাদা ফেসবুক পেজ থেকে নেহাতই বিপদে পড়া মানুষের সাহায্যের জন্য তাৎক্ষণিক পণ্য সেবা শুরু করেন। একপর্যায়ে চারজন মিলে শুরু করেন অনলাইন সরবরাহ উদ্যোগ ‘নাউ’। এরপর আর নতুন কী করা যায়, ভাবতে ভাবতেই রাতের ঢাকার কাঙ্ক্ষিত সেবাটি চালুর কথা মাথায় আসে তাঁদের। আর সেই থেকেই শুরু মাঞ্চিসের।

মাঞ্চিসের কয়েকজন কর্মী

২০২১ সালে ১১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে মাঞ্চিস। ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ আর হটলাইন ফোন নম্বরের মাধ্যমে চাহিদা নিয়ে নিজেদের কাজ চালাচ্ছে তারা। সামনে কাজের পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে মাঞ্চিস। তাদের পরিকল্পনা ধীরে ধীরে শহরের গণ্ডি পেরিয়ে সিলেট, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বড় শহরে ছড়িয়ে পড়া। ২০২২ সালে ভারতের কলকাতাতেও নিজেদের কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে মাঞ্চিসের তরুণ উদ্যোক্তাদের।

শুধু খাবার সরবরাহই নয়

বর্তমানে প্রায় ৫০টি রেস্তোরাঁর খাবার সরবরাহ করেছে মাঞ্চিস। শতাধিক ফ্রিল্যান্স রাইডার ও ৩০ কর্মী নিয়ে ঢাকার প্রতিটি প্রান্তে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে তারা। শুধু খাবারই নয়, প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জার থেকে শুরু করে, সুরক্ষা সরঞ্জাম ও চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ কিনে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয় মাঞ্চিস।

মাঞ্চিসের সেবা নিয়ে একটি ঘটনা শোনালেন এর অন্যতম উদ্যোক্তা অনিত কুমার দাস। ঘটনাটি গত এপ্রিলের। দেশজুড়ে কঠোর বিধিনিষেধ চলছে। হঠাৎ এক রাতে মাঞ্চিসের হটলাইন নম্বরে এক নারী ফোন করেন। ওই সময় লোকবল কম থাকায় উদ্যোক্তারা নিজেরাই কখনো হটলাইন সেন্টারে কাজ করতেন, কখনো খাবার সরবরাহ করতে যেতেন। ওই রাতে হটলাইনে কাজ করছিলেন অনিত। ফোন ধরতেই ওপাশের নারী কণ্ঠ জানতে চাইলেন, ‘এখানে রাতে খাবার ডেলিভারি দেওয়া হয়?’ সম্মতিসূচক উত্তর দিতেই নারী হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। অনিতকে জানান, বিধিনিষেধের কারণে বাসায় এখন তাঁর ছোট্ট মেয়ে ও তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। তাঁর স্বামী দেশের বাইরে থাকেন। ওদিকে মেয়ের প্রচণ্ড জ্বর। তাই জ্বর কমাতে যত দ্রুত সাপোজিটরি দিতে হবে।

অত রাতে বাড়ির আশপাশের ওষুধের সব দোকান বন্ধ। আর অসুস্থ মেয়েকে এই অবস্থায় একা রেখে তিনি ওষুধের দোকান খুঁজতে বেরও হতে পারছেন। এই পরিস্থিতি শুনে তাৎক্ষণিকভাবে মাঞ্চিসের একজন রাইডারকে ওষুধের দোকান খুঁজতে বলা হয়। ৩০ মিনিটের মধ্যে ওই নারীর বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয় ওষুধ। পরদিন বিকেলে মাঞ্চিসের হটলাইন নম্বরে আবারও ওই নারী কল করেন এবং কাঁদতে শুরু করেন। অনিত বলেন, ‘তবে এবারের কান্নাটা ছিল আনন্দের, কৃতজ্ঞতার। তিনি আমাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান। এই ঘটনার পর থেকেই মাঞ্চিসের যুক্ত করা হয় প্রেসক্রিপশনের ভিত্তিতে সারা রাত ধরে ওষুধ সরবরাহের সেবা। যখনই কোনো রাইডার ওষুধের অর্ডার পাবেন, তখনই সেটা সম্পন্ন করার নির্দেশনা তাঁদের দেওয়া আছে।’

পাঁচটি অর্ডার থেকে শুরু

একেবারে নিজেদের উদ্যোগেই শুরু করেছিলেন মাঞ্চিস। এর প্ল্যাটফর্মের অন্যতম উদ্যোক্তা ও অভিনেতা তামিম মৃধা বলেন, ‘শুরুতে আমরা যখন কোনো দোকানে গিয়ে বলতাম সারা রাত দোকান খোলা রেখে তাদের জন্য খাবার সরবরাহ করতে হবে, তখন অনেকেই আমাদের পাগল ভাবত। পরিচিতজনেরা ভাবতেন ব্যর্থ চেষ্টা। কিন্তু আস্তে আস্তে আমরা সবার ধারণা বদলে দিই।’

রাত যতই হোক খাবার পৌঁছে যাবে গ্রাহকের কাছে

শুরুতে চিপস, বিস্কুট, চানাচুরের মতো শুকনা খাবার, আইসক্রিম, কোমল পানীয় ইত্যাদি নিজেরাই কিনে মজুত করে ডেলিভারি দেওয়া হতো। এ ছাড়া ‘ওভেন’ নামের একটি দোকানও শুরুর দিকে রাত দুইটা পর্যন্ত পিৎজা তৈরি করে মাঞ্চিসের সঙ্গে কাজ শুরু করে। ১১ জানুয়ারি, মাঞ্চিসের প্রথম দিন পাঁচটি অর্ডার আসে বাইরে থেকে। এর মধ্যে চারজনই পরিচিত বন্ধু আর স্বজন। মাত্র একজন অপরিচিত গ্রাহক। পরদিন আসে ১০টি অর্ডার। এরপর প্রতি রাতেই বাড়তে থাকে মাঞ্চিস হটলাইন আর ওয়েবসাইটে গ্রাহকের চাপ। প্রথম মাসে প্রায় ২০০টি অর্ডার পায় মাঞ্চিস, যার মধ্যে ৮০ শতাংশই পিৎজার।

গ্রাহকের চাহিদা দেখে ওই পিৎজার দোকান সকাল ছয়টা পর্যন্ত খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে মাঞ্চিস আরও নতুন রেস্তোরাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়। বাড়তে থাকে গ্রাহকের সংখ্যা, বাড়তে থাকে রেস্তোরাঁও। মাঞ্চিসের নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি।

উদ্যোক্তারা জানালেন, প্রতি রাতেই ১৫০–২০০ নতুন গ্রাহক যুক্ত হচ্ছে মাঞ্চিসের সঙ্গে। আর এই ধারা অব্যাহত রাখার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা।