করোনার কোন ভ্যাকসিন কী অবস্থায় আছে?
করোনাভাইরাস মহামারির ছয় মাস পার করল বিশ্ব। আজ থেকে ঠিক ছয় মাস আগে চীনের উহানে শনাক্ত হয়েছিলেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী। এরপর সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর ভয়ানক পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক দেশ। অনেক জায়গায় দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়ে চলেছে মৃত্যু।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, করোনা মহামারি নতুন এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। ভ্যাকসিন ছাড়া এই ভাইরাসের সংক্রমণ থামানো সম্ভব নয় বলে প্রথম থেকেই বলে আসছেন বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা। এ পরিস্থিতিতে মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে কার্যকর ভ্যাকসিনের। গবেষকেরা আশার আলোও দেখাচ্ছেন। বলছেন, হয়তো এ বছরেই দেখা মিলতে পারে বহু প্রতীক্ষিত ভ্যাকসিনের। তরতর এগিয়ে চলেছে ভ্যাকসিনের গবেষণা। কয়েকটি ভ্যাকসিন সফলতার প্রায় দ্বারপ্রান্তে। একটি ভ্যাকসিন ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারের অনুমোদনও পেয়ে গেছে।
গবেষকেরা বলছেন, ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টায় এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করোনার ভ্যাকসিনের মানবদেহে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য একাধিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তিও করেছে অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা। ভ্যাকসিন পরীক্ষা সফল হলেই তা বাজারে আসবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সবশেষ ২৪ জুনের খসড়া তালিকা অনুযায়ী এখন বিশ্বে টিকা বানাতে ১৪৩টি উদ্যোগ চালু আছে। ২ জুন এমন উদ্যোগের সংখ্যা ছিল ১৩৩। অর্থাৎ, তিন সপ্তাহের মধ্যে আরও ১০টি টিকার উদ্যোগ যুক্ত হয়েছে। এখন ১৪৩টি উদ্যোগের মধ্যে ১৬টির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা মানবদেহে পরীক্ষা চলছে। বাকি ১২৫টি টিকা প্রথম বা দ্বিতীয় ধাপে আছে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘অগ্রগতি কতটা, কোন ধাপে রয়েছে, সেই বিচারে আমি মনে করি তারা (অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীরা) এগিয়ে রয়েছেন।’
নিউইয়র্ক টাইমসের করোনা ট্র্যাকার অনুযায়ী, বিশ্বে এ মুহূর্তে ১৪০টি ভ্যাকসিনের মধ্যে ১২৫টির বেশি প্রি-ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে রয়েছে। ১১টি প্রথম ধাপে, ৮টি দ্বিতীয় ধাপে, ৩টি তৃতীয় ধাপে এবং একটি পরীক্ষামূলক ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে। মার্কিন সংস্থা ‘মডার্না আইএনসি’র তৈরি এমআরএনএ-১২৭৩ ভ্যাকিসনও এ দৌড়ে রয়েছে। এই টিকারও তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হচ্ছে আগামী মাসে। সৌম্য স্বামীনাথন যেমন অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকাকেই এগিয়ে রাখছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা জানি, মডার্নার ভ্যাকসিনও তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হচ্ছে জুলাইয়ের মাঝামাঝি। ফলে তারাও খুব একটা পিছিয়ে নেই। কিন্তু অগ্রগতি ও বাণিজ্যিক উৎপাদনের প্রক্রিয়ার দিক থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেশি সুযোগ রয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার।’
প্রযুক্তিবিষয়ক মার্কিন ওয়েবসাইট সিনেট বলছে, প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত চলে আসতে পারে ভ্যাকসিন। সাধারণত, ভ্যাকসিন বিশ্বব্যাপী অনুমোদন, উৎপাদন এবং বিতরণ করতে কয়েক বছর, এমনকি কখনো কখনো কয়েক দশক সময় লাগে। তবে করোনা ভ্যাকসিন পেতে চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা কঠোর ও দ্রুত কাজ করছেন। সার্স-কোভ-২ প্রথম আবিষ্কার হওয়ার ছয় মাস পরে এসে কমপক্ষে ছয়টি ভ্যাকসিন উন্নয়ন প্রকল্পের ইতিমধ্যে উত্সাহজনক অগ্রগতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। আরও অনেক প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
আমেরিকার শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজেসের পরিচালক অ্যান্থনি ফাউসি বলেছেন, তিনি আশা করেন,২০২১ সালের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যাকসিনটির কয়েক মিলিয়ন ডোজ প্রস্তুত থাকবে। গবেষকেরা আরেকটি আশার কথা বলছেন, তাঁরা করোনাভাইরাস জিনোমকে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, এটি অন্য ফ্লুর মতো দ্রুত পরিবর্তন হয় না, যার অর্থ মিউটেশন ভ্যাকসিনের বিকাশের গতি কমানোর আশঙ্কা কম।
ভ্যাকসিনের অগ্রগতি
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ভ্যাকসিন সাধারণত ক্লিনিকে পৌঁছানোর আগে কয়েক বছর গবেষণা ও পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। গত জানুয়ারি মাসে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের জিন নকশা উন্মোচনের মাধ্যমে ভ্যাকসিনের কাজ শুরু হয়েছিল। গবেষকেরা বলেন, মানুষের মধ্যে প্রথম ভ্যাকসিন সুরক্ষা পরীক্ষা মার্চ মাসে শুরু হয়েছিল। তবে সামনের পথ অনিশ্চিত। কিছু পরীক্ষা ব্যর্থ হবে এবং কিছু সুস্পষ্ট ফলাফল ছাড়াই শেষ হতে পারে। তবে কয়েকটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি করতে প্রতিরোধব্যবস্থা উদ্দীপনায় সফল হতে পারে।
ল্যাব বা পরীক্ষাগারে থেকে ক্লিনিক পর্যন্ত একটি ভ্যাকসিনকে বিকাশচক্র পার করতে হয়, যার শুরুতেই থাকে প্রি-ক্লিনিক্যাল টেস্টিং বা প্রাকৃতিক পরীক্ষা। বিজ্ঞানীরা ইঁদুর বা বানরের মতো প্রাণীতে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করেন, যাতে এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে কি না, তা বোঝা যায়। পরের ধাপ বা পরীক্ষার প্রথম ধাপটি হচ্ছে বিশেষ নিরাপত্তা পরীক্ষা। বিজ্ঞানীরা সুরক্ষা এবং ডোজ পরীক্ষা করার পাশাপাশি অল্পসংখ্যক লোককে এই ভ্যাকসিন দিয়ে প্রতিরোধব্যবস্থাকে উদ্দীপিত করে তা নিশ্চিত করেন। এরপর দ্বিতীয় ধাপের সম্প্রসারিত পরীক্ষা করা হয়। বিজ্ঞানীরা শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের মতো বিভিন্ন দলে বিভক্ত কয়েক শ লোককে এই ভ্যাকসিন দেন, যাতে ভ্যাকসিনটি তাদের মধ্যে আলাদাভাবে কাজ করে কি না, তা দেখা যায়। এই পরীক্ষায় ভ্যাকসিনের সুরক্ষা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জাগ্রত করার ক্ষমতা দেখা হয়।
তৃতীয় ধাপে কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। বিজ্ঞানীরা কয়েক হাজার মানুষকে এই ভ্যাকসিন দেন এবং কতজন সংক্রমিত হয়েছে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে ভ্যাকসিন করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে কি না। এরপর আসবে অনুমোদনের বিষয়টি। প্রতিটি দেশের নিয়ন্ত্রকেরা পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে ভ্যাকসিন অনুমোদন করবেন কি না, তা স্থির করেন। মহামারি চলাকালে একটি ভ্যাকসিন আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের আগে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেতে পারে।
অনুমোদন পেল ক্যানসিনোর ভ্যাকসিন
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনে মোট আটটি ভ্যাকসিন মানবপরীক্ষার অনুমতি পেয়েছে। চীন ও চীনের বাইরে ভ্যাকসিনগুলো নিয়ে পরীক্ষা চালানোর পর অ্যাড৫-এনকোভ নামের এ ভ্যাকসিন নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে। এই একই ভ্যাকসিন এরই মধ্যে কানাডাতেও মানবপরীক্ষার জন্য অনুমতি পেয়েছে। এখন অ্যাড৫-এনকোভ নামের এই পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে চীনের সেনাবাহিনী। বিস্তৃত পরিসরে ভ্যাকসিনটির ব্যবহারের আগে আরও কিছু অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে বলে জানিয়েছে উৎপাদনকারী ক্যানসিনো। সেনাবাহিনীর মধ্যে এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক, নাকি ঐচ্ছিক রাখা হচ্ছে, সে সম্পর্কে এখনো কিছু জানানো হয়নি। এর ধরন সম্পর্কেও সুস্পষ্টভাবে কিছু জানানো হয়নি। এর আগে চলতি মাসের শুরুর দিকে চীনে আরও দুটি সম্ভাব্য ভ্যাকসিনকে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ক্যানসিনোর তৈরি করা পরীক্ষামূলক এ ভ্যাকসিন প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় বেশ সফল হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধে এটি কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। যদিও এটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে কি না, সে বিষয়ে এখনো ক্যানসিনো নিশ্চিত নয় বলে জানিয়েছে।
তৃতীয় ধাপে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন
অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি ভ্যাকসিনটির তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা চলছে। এতে আরও ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে যুক্ত করার কাজ চলছে। ব্রাজিলে স্বেচ্ছাসেবকেরা যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোভিড-১৯ প্রতিরোধী পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। এতে দেশটির পাঁচ হাজার স্বেচ্ছাসেবী অংশ নিচ্ছেন। অক্সফোর্ড জেনার ইনস্টিটিউটের তৈরি ভ্যাকসিনটি বর্তমানে যুক্তরাজ্যেও পরীক্ষা চলছে। সেখানে চার হাজার স্বেচ্ছাসেবী ইতিমধ্যে ভ্যাকসিনটি নিয়েছেন এবং আরও ১০ হাজার জনকে পরীক্ষায় যুক্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। দুটি ধাপে সফল হওয়ার পর এই ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে মানবদেহে। যদিও তার ফলাফল নিয়ে কোনো দাবি এখনো সংস্থার পক্ষ থেকে করা হয়নি; তবে ইতিমধ্যেই বিশ্বের অন্তত ১০টি সংস্থার সঙ্গে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করার চুক্তি সই হয়েছে। শেষ তথা দশম চুক্তি হয়েছে ব্রাজিলের সঙ্গে।
ব্রাজিলে স্থানীয়ভাবে এই ভ্যাকসিন তৈরি হবে। ব্রাজিলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনস্বাস্থ্য আধিকারিক এলসিও ফ্রাঙ্কো সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করেছেন, শুরুতে মোট তিন কোটি টিকা উৎপাদন করা হবে। তার অর্ধেক ডিসেম্বরে এবং বাকি দেড় কোটি পরের বছরের জানুয়ারির মধ্যেই তৈরি করা হবে। তিনি আরও জানিয়েছেন, ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যায় আক্রান্ত প্রবীণ এবং সামনের সারির যোদ্ধা অর্থাৎ চিকিৎসক-নার্সদের প্রথম ব্যাচে উৎপাদিত টিকা দেওয়া হবে। তবে জুনের শুরুতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার সিইও বলেছিলেন, এই টিকা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেবে এক বছরের জন্য।
চূড়ান্ত ধাপে মডার্নার ভ্যাকসিন
যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার তৈরি পৃথক আরেকটি ভ্যাকসিন জুলাই মাসে ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে দেওয়ার মধ্য দিয়ে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু হবে। মডার্নার এমআরএনএ-১২৩৩ ভ্যাকসিন তৈরিতে অক্সফোর্ডের পর দৌড়ে এগিয়ে এই ভ্যাকসিন। তৃতীয় তথা চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হচ্ছে জুলাইয়ে। ৩০ হাজার মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হবে এই ভ্যাকসিন। কিন্তু তার আগেই মার্কিন এই সংস্থা ইতিমধ্যেই উৎপাদনের চুক্তিও সেরে ফেলেছে সে দেশেরই ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা ক্যাটালেন্টের সঙ্গে। প্রথম ব্যাচেই ক্যাটালেন্ট ১০ কোটি টিকা উৎপাদন করবে বলে সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী টিকা উৎপাদনের পাশাপাশি প্যাকেজিং, লেবেলিং থেকে শুরু করে ডিস্ট্রিবিউশনের কাজও করবে ক্যাটালেন্টই। সম্প্রতি মডার্নার সিইও স্টিফেন বানসেল বলেছেন, পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ফল আগামী নভেম্বরের মধ্যেই পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
দ্রুত শেষ টানতে চাইছে সিনোফার্ম
চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সিনোফার্ম বড় আকারের তৃতীয় ধাপের ভ্যাকসিন পরীক্ষা শুরু করছে। এ মাসের শুরুতে সিনোফার্ম প্রাণিদেহে তাদের ভ্যাকসিন পরীক্ষা থেকে ইতিবাচক ফলের খবর প্রকাশ করে। চীনা গবেষকেরা সেল সাময়িকীতে গবেষণাসংক্রান্ত নিবন্ধ প্রকাশ করেন। তাঁরা দাবি করেন, নিষ্ক্রিয় ভাইরাস থেকে তৈরি ভ্যাকসিন প্রার্থী বিবিআইবিপি-করভি সার্স-কোভ-২-এর বিরুদ্ধে উচ্চমাত্রার নিরপেক্ষ অ্যান্টিবডিকে প্ররোচিত করতে পারে। তাঁরা বেইজিংয়ে বছরে ২০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন তৈরির কারখানা করছেন।
সম্ভাবনাময় সিঙ্গাপুরের ভ্যাকসিন
সিঙ্গাপুরের ডিউক-এনইউএস মেডিকেল স্কুলের গবেষকেদের একটি ভ্যাকসিন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার পাশাপাশি এটি রোগ নিরাময়েও ব্যবহার করা যাবে। সম্প্রতি গবেষকেরা এ দাবি করেছেন। আগস্ট মাসে এর পরীক্ষা শুরু হচ্ছে।
এগোচ্ছে সানোফির ভ্যাকসিন
অক্সফোর্ড বা মডার্নার চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও ফরাসি ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা সানোফির তৈরি এই ভ্যাকসিনের অগ্রগতিও আশানুরূপ। একাধিক টিকা প্রস্তুত করেছে তারা। পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হবে এ বছরের অক্টোবর থেকে। সানোফি আগেই জানিয়েছিল, মার্কিন স্টার্টআপ সংস্থা ‘ট্র্যানস্লেট বায়ো’র সঙ্গে যৌথভাবে টিকা তৈরিতে তারা ৪২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। সংস্থার সিইও পল হাডসন গত সপ্তাহেই সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, তাঁদের তৈরি টিকা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হিসেবে তৈরি হতে যাচ্ছে। এটাই একমাত্র ভ্যাকসিন, যা কোভিড-১৯ চিকিৎসায় সাফল্যের প্রমাণ দেবে।
কাজে লাগতে পারে বর্তমান ভ্যাকসিন
চিকিৎসাবিজ্ঞান–সংক্রান্ত সাময়িকী এমবায়োতে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, মিজলস, মামস ও রুবেলা বা এমএমআর প্রতিরোধে যে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, সেটা করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও কার্যকর হতে পারে। কারণ, এই টিকা হৃদ্যন্ত্রে সংক্রমণ আটকায়, যা কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও অন্যতম সমস্যা। ল্যাবে পরীক্ষামূলক প্রয়োগে দেখা গিয়েছে, এই টিকা প্রয়োগ করা হলে এবং তা সক্রিয় থাকলে গুরুতর অসুস্থতা রোধ করা যায়। কোভিডের চিকিৎসায় সরাসরি প্রয়োগের কথা না বললেও কোভিডে আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই টিকা কাজে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
দ্বিতীয় ধাপে ফাইজার
আমেরিকার ফাইজার ও জার্মানির বায়োএনটেক—এই দুই ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার যৌথ উদ্যোগে তৈরি বিএনটি-১৬২ ভ্যাকসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে। জার্মান সংস্থা বায়োএনটেক নিউইয়র্কের ফাইজার ও চীনা ওষুধ প্রস্তুতকারী ফসুন ফার্মা একসঙ্গে এমআরএনএ ভ্যাকসিন তৈরিতে কাজ করছে। মে মাসে ফাইজার তাদের ভ্যাকসিনের মানবদেহে পরীক্ষার কথা ঘোষণা করে। ফাইজার আশা করছে, ট্রায়ালে সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী শরতে জরুরি ব্যবহারের জন্য কয়েক মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে।
চীনা টিকার অগ্রগতি
চীনের দুই সরকারি সংস্থা উহান ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টসের তৈরি ‘ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন’ এবং বেইজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টসের ‘বিবিআইবিপি কর্ভ’ ভ্যাকসিন দুটিরও প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা চলছে একসঙ্গে।
সিনোভ্যাক বাংলাদেশে পরীক্ষা চালাবে
জুলাই মাসে চীনের করোনার টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাংলাদেশে শুরু হতে পারে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাকের অংশীদার হিসেবে এই পরীক্ষা চালাবে। নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, সিনোভ্যাকের ইনঅ্যাক্টিভেটেড করোনাভ্যাক ভ্যাকসিনটি দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে। ১৩ জুন তারা ৭৪৩ জনের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা চালিয়েছিল, যাতে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি এবং প্রতিরোধী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। চীন ও ব্রাজিলে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা চালাবে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া বার্ষিক ১০ কোটি ডোজ তৈরির জন্য কারখানা তৈরি করছে তারা। গত মাসে সিনোভ্যাক একাডেমিক জার্নাল সায়েন্সে তাদের গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করে, যাতে করোনাভ্যাক নামে তাদের ভ্যাকসিনটি বানরের ওপর পরীক্ষায় সফল বলে জানানো হয়। এটি বানরের শরীরে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম হয়েছিল।
মাঠে নামছে জনসন অ্যান্ড জনসন
জুলাই মাসে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা একসঙ্গে শুরু করবে জনসন অ্যান্ড জনসন। প্রতিষ্ঠানটি অ্যাড ২৬ প্ল্যাটফর্মে তাদের ভ্যাকসিন তৈরি করছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে বেথ ইসরায়েল ডিকনেস মেডিকেল সেন্টার।
ইম্পেরিয়ালের ভ্যাকসিনে অগ্রগতি
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের বিজ্ঞানীরা আত্মপরিবর্ধনকারী আরএনএ প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ভ্যাকসিন তৈরি করছেন। ইম্পেরিয়াল কলেজ ও হংকংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মর্নিংসাইড ভেঞ্চার্সের উদ্যোগে তৈরি ভ্যাকুইটি গ্লোবাল হেলথ এ ভ্যাকসিন তৈরি করছে। ইম্পেরিয়াল কলেজের বিজ্ঞানীদের তৈরি আরএনএ ভ্যাকসিন মূলত পেশিকোষে জিনগত নির্দেশ পাঠায়, যাতে কোষ স্পাইক প্রোটিন তৈরি করতে পারে। এ প্রোটিনের উপস্থিতি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্ররোচিত করে, যাতে কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা তৈরি হয়। ১৫ জুন থেকে ৩০০ মানুষকে নিয়ে ভ্যাকসিনটির ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। পরীক্ষা সফল হলে ছয় হাজার মানুষকে নিয়ে আগামী অক্টোবরে পরের ধাপের পরীক্ষার পরিকল্পনা করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা আশা করছেন, আগামী বছরের শুরুতেই যুক্তরাজ্য ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে ভ্যাকসিন দিতে পারবেন তাঁরা।