কথা বলে বলে হিসাব রাখা
শুরুতেই একটা প্রশ্ন করা যাক। আপনি কারও সঙ্গে অর্থ লেনদেন করছেন, তার জন্য কী করবেন? উত্তর নিশ্চয় এতক্ষণে গলার ডগায় এসে পৌঁছেছে। লেনদেনের ব্যাপারটা টুকে রাখবেন কাগজে, এই তো? যুগ যুগ ধরে এমন চলই চলে আসছে। শুধু আপনিই নন, দোকানদার কিংবা পরিবারের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যিনি থাকেন, তাঁদের প্রায়ই দেখা যায় হিসাব-নিকাশের ব্যাপারটা কাগজে টুকে রাখতে। হাল আমলে অবশ্য ডিজিটাল যন্ত্র কেনাকাটার ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনলেও বিক্রেতাদের বড় একটি অংশ এখনো পুরাতন নিয়মে অভ্যস্ত।
এই হিসাব-নিকাশের ব্যাপারটা আপনি শুধু কথা দিয়েই করতে পারবেন। এর জন্য শুধু আপনার প্রয়োজন পড়বে একটি মুঠোফোন। ব্যাপারটা পরিষ্কার করা যাক, ধরুন কোনো দোকান থেকে আপনি ২৫০ টাকায় ৫ কেজি চাল এবং ২ কেজি আলু কিনেছেন ৫০ টাকায়। এরপর একটি নির্দিষ্ট নম্বরে আপনার মুঠোফোন থেকে কল করে তা বলে দিলেন। অপর প্রান্তে কোনো মানুষ তা লিখে নেবে না। আপনার কথার স্বর থেকে লেনদেনের পুরো ব্যাপারটা টুকে রাখা হবে আপনার হিসাবে। এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্লানিং (ইআরপি) সফটওয়্যারের মাধ্যমে তা হবে।
শিগগিরই ‘হিসাব’ নামে এমন প্রযুক্তি চালু হতে যাচ্ছে দেশে। এখন এটি পরীক্ষামূলক সংস্করণে রয়েছে। এর জন্য দরকার পড়বে না কোনো স্মার্টফোন কিংবা অ্যাপ। সাধারণ মুঠোফোন হলেই চলবে। এমনটাই জানিয়েছেন হিসাব লিমিটেডের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম।
মুঠোফোন ব্যবহার করে ১৬৫১৩ কল দিলে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে শুধু কথা দিয়েই। এর জন্য কল করার জন্য খরচ হবে প্রতি সেকেন্ড এক পয়সা। এ ছাড়া গ্রাহকদের বাড়তি কোনো খরচ দিতে হবে না। নিবন্ধনের ব্যাপারটাও খুব সহজ। এর জন্য নেই কোনো ঝক্কি-ঝামেলা। নম্বরটিতে কল করে আপনার নাম, ঠিকানা বলে দিলে নিবন্ধন হয়ে যাবে। এরপর থেকে হিসাব রাখতে পারবেন। প্রমিত বাংলা থেকে শুরু করে দেশের সব আঞ্চলিক ভাষাও বুঝতে পারে হিসাবের এই প্রযুক্তি।
মনে নিশ্চয় এতক্ষণে প্রশ্ন জেগেছে, কেনাকাটা বা লেনদেনের হিসাবটা আপনি কিভাবে পাবেন? এ ব্যাপারে মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ওয়েবসাইট থেকে গ্রাহক তাঁর হিসাব নামিয়ে নিতে পারবেন। আর যাঁদের ইন্টারনেট ব্যবহারের যন্ত্র নেই কিংবা যাঁরা হার্ড কপি চাইবেন আমরা তাঁদের তা সরবারহ করব।’
জুবায়ের আহমেদ, মোজাহিদুল ইসলাম ও সিঙ্গাপুরের ইচ চিয়াও চেন মিলে গড়ে তুলেছেন হিসাব লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠান। জুবায়ের আহমেদ হচ্ছেন প্রতিষ্ঠাতা, বাকি দুজন আছেন সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। গতকাল ১৬ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটির ঢাকার কার্যালয়ে যখন মোজাহিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হচ্ছিল তখন জানতে চেয়েছিলাম, কীভাবে এই ধারণা পান? ‘বছর চারেক আগের কথা। জুবায়ের আহমেদ কেনাকাটা করছিলেন সিঙ্গাপুরের এক দোকানে। তখন তিনি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেন, ক্রেতা ও বিক্রেতা একে অপরকে সন্দেহ করছিলেন আগের কেনাকাটার বাকি নিয়ে। দুজনই দ্বিমত পোষণ করছিলেন আগে কেনাকাটা করার বাকি টাকা নিয়ে। তখন জুবায়ের চিন্তা করে এমন বিষয়টাকে নিয়ে যদি ডিজিটাল মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু এমন প্রযুক্তি প্রয়োজন, যা সব স্তরের মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে দেওয়া যায়। আর তার জন্য কথাকে বেছে নেওয়া।’ বললেন মোজাহিদুল। পরবর্তী সময়ে জুবায়েরের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। এর মধ্যে মোজাহিদুল সর্বশেষ দেশের একটি মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। এর ইচ চিয়াও চেন আইবিএমের ক্যালিফোর্নিয়া শাখায় চিফ ইনফরমেশন অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন।
২০১৫ সালের শেষের দিকে এই ধারণা নিয়ে পণ্য তৈরির পর্যায়ে কাজ শুরু হয়। এরপর গ্রামীণফোনের সঙ্গে পরীক্ষামূলক সংস্করণ করা হয় গত বছরের জুলাইয়ে। তারপর মুঠোফোন সেবাদাতা এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি হয় গত নভেম্বরে। আপাতত গ্রামীণফোনের কিছু গ্রাহক হিসাবের এই সুবিধা পাচ্ছেন। বিজনেস টু বিজনেস (বিটুবি) প্রক্রিয়ায় হিসাব এখন চালু রয়েছে। আগামী জুন বা জুলাইয়ে ‘বিজনেস টু কাস্টমার’ প্রক্রিয়ায় বাজারে আসার কথা রয়েছে।
মোজাহিদুল ইসলাম বলছিলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থ লেনদেনে বাকির হিসাবে স্বচ্ছতা নিয়ে আসা। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই লাভবান হবেন। এ ছাড়াও আমরা চাই ভবিষ্যতে আমাদের উদ্যোগকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দিতে।’
ভবিষ্যতে এই মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের সুযোগ তৈরি হতে পারে।