আসছে ভয়ংকর কোয়ান্টাম কম্পিউটার!
কম্পিউটার দেখতে কেমন? সাধারণত ডেস্কটপ কম্পিউটারে চৌকোনা বাক্সের সিপিইউ থাকে। থাকে মনিটর-মাউস। কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা এমন এক কম্পিউটার তৈরি করতে ঘাম ঝরাচ্ছেন, যা দেখতে হবে উল্টো কেকের মতো! চার-পাঁচ স্তরের কেক উল্টো করে ঝুলিয়ে দিলে যেমন হয়, ঠিক তেমন। থাকবে অনেক ধাতব সিলিন্ডার ও প্যাঁচানো তার। আর সবকিছুর নিচে থাকবে ছোট্ট একটি কালো চিপ। কিম্ভূতকিমাকার এই বস্তুকেই বলা হচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই কম্পিউটার বদলে দেবে পুরো প্রযুক্তিবিশ্ব!
বদলটা আসলে কেমন হবে? এ জায়গাতেই কিছু ‘কিন্তু’ আছে। বর্তমান কম্পিউটার ব্যবস্থার তুলনায় সম্পূর্ণ নতুন এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার। যেসব গাণিতিক সমস্যা মানুষ দূরে থাক, হালের সুপার কম্পিউটারের করতেও বছরের পর বছর লাগে, সেসব সমস্যা এক তুড়িতে সমাধান করতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কার করতে সহায়তা করবে এটি। নতুন পদার্থ আবিষ্কারেও আসবে বৈপ্লবিক গতি। এক কথায় কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রযুক্তিবিশ্বে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। পুরো কম্পিউটার ব্যবস্থাই বদলে যাবে।
হাতের উল্টো পিঠও আছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বিপত্তি অনেক। বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পুরো বিশ্ব মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত জীবনের ছোট ছোট অনুভূতি প্রকাশ করা থেকে শুরু করে ব্যাংকের তাবৎ কাজও নির্ভরশীল অন্তর্জালের ওপর। বর্তমানের এই ইন্টারনেট ব্যবস্থা কিছু নির্দিষ্ট এনক্রিপশন অনুসরণ করে। ক্রিপ্টোগ্রাফি বা সংকেত লিখন পদ্ধতি ব্যবহার করে এসব এনক্রিপশন তৈরি হয়। এনক্রিপটেড থাকার কারণে ইন্টারনেট ব্যবহার নিরাপদ থাকে এবং ব্যবহারকারীর তথ্য বেহাত হওয়া প্রতিরোধ করে। সমস্যা হলো, ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম কম্পিউটার হালের ইন্টারনেট এনক্রিপশনের যমে পরিণত হবে। এক তুড়িতে বর্তমানের ইন্টারনেট ক্রিপ্টোগ্রাফি হ্যাক করতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। তাই কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রযুক্তি যদি অসৎ হ্যাকারের হাতে পড়ে, তবে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর তথ্য ঝুঁকিতে পড়ে যাবে! এমনকি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিরাপদ থাকবে না। গোপন গোয়েন্দা ও প্রতিরক্ষা তথ্যও আর গোপন রইবে না।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করতে এখন কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। ওদিকে তলোয়ারে শাণ দিচ্ছে চীন। কোয়ান্টাম কম্পিউটার যে তাদেরও চাই। তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার–সংক্রান্ত গবেষণায় সবচেয়ে বেশি হুড়োহুড়ি করছে গুগল, আইবিএম, মাইক্রোসফটসহ নানা টেক জায়ান্ট। কারণ খুব স্পষ্ট। যে প্রতিষ্ঠান এই প্রতিযোগিতায় জিতবে অর্থাৎ প্রথম কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করতে পারবে, সেই প্রতিষ্ঠানই নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তি ব্যবসায় একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এটি অনেকটা লটারির জ্যাকপট জেতার মতো! তাই দেদার খরচ হচ্ছে কোয়ান্টাম গবেষণায়।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার কী?
সাধারণ কম্পিউটার কাজ করে বাইনারি সংখ্যা দিয়ে। বাইনারি পদ্ধতিতে সংখ্যা মাত্র দুটি: ০ ও ১। এই দুটি সংখ্যা দিয়েই যাবতীয় কাজ করে এখনকার কম্পিউটার। দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান ব্যবস্থায় প্রতিবার হয় ০ নতুবা ১ ব্যবহার করতে পারে কম্পিউটার। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার ০ ও ১—দুটিরই প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। আবার একই সময়ে একই সঙ্গে ০ ও ১–এর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। বিশেষ এই কম্পিউটারের মৌলিক একককে বলা হয় কিউবিটস। বাইনারি সংখ্যা হিসেবে ০ ও ১ ব্যবহারের অনবদ্য বৈশিষ্ট্যের কারণেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার জটিল গাণিতিক সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে পারে।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্বোধ্য ও জটিল কোয়ান্টাম মেকানিকসের ওপর নির্ভরশীল কোয়ান্টাম কম্পিউটার। কোয়ান্টাম মেকানিকসের সুপারপজিশন ও এনট্যাংগেলমেন্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে কাজ করে এই কম্পিউটার। খুব বেশিসংখ্যক গাণিতিক সমস্যার সমাধান এটি করে না। তবে যে অল্পসংখ্যক জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান কোয়ান্টাম কম্পিউটার করে, সেগুলো বর্তমানের কম্পিউটারের পক্ষে করা অত্যন্ত কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। কিছু ক্ষেত্রে অসম্ভবও।
সংবাদমাধ্যম ওয়্যারড বলছে, কোয়ান্টাম বিটস বা কিউবিটস নানা পদ্ধতিতে গঠিত হতে পারে। তবে এগুলো সব সময়ই ০ ও ১-এর প্রতিনিধিত্ব করে এবং এই পুরো প্রক্রিয়া ইলেকট্রনিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে প্রথাগত কম্পিউটার বিটসের চেয়ে বহুগুণ বেশি কাজ করতে পারে কিউবিটস।
সুফল কী?
টেলিগ্রাফ বলছে, কার্যকর কোয়ান্টাম কম্পিউটার অসীম সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে। নতুন টেকসই নির্মাণসামগ্রী তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। ক্যানসার বা এইডসের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির পথ্য তৈরিতে সহায়তা করবে এটি।
মাইক্রোসফটের কর্মকর্তা ক্রিস্তা সোরে বলেন, ‘এর প্রভাব হবে অভাবনীয়। কোয়ান্টাম কি করতে পারে—সেই সম্ভাবনার বিশাল সমুদ্রের কেবল উপরিভাগে আছি আমরা। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতার সমস্যার প্রকৃতি বুঝতে পারব আমরা। একই সঙ্গে কীভাবে কার্বন ধরে রাখা যাবে এবং আমাদের পৃথিবীকে বাঁচানো যাবে, তাও জানতে পারব।’
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইবিএমের কোয়ান্টাম বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট বব সুটর মনে করেন, কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রযুক্তিতে নতুন বিপ্লবের সূচনা করবে। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ এখনো এ বিষয়ের বিস্তৃতি আঁচ করতে পারছে না। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কল্যাণে মানুষ আরও ভালো পণ্য হাতে পাবে, খাবারে আসবে নতুন স্বাদ। তৈরি হবে নতুন নতুন ওষুধ। জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে বর্তমানের উড়োজাহাজকে আরও দ্রুতগামী করা যাবে। এসব উন্নত উড়োজাহাজতে আবার জ্বালানিও কম খরচ হবে।
আইবিএমের গবেষণা বিভাগ জানাচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এতে করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আরও নিখুঁত করে তোলা সম্ভব হবে।
গন্ডগোল কোথায়?
কথায় আছে—‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ ঠিক তেমনি ভালো মানুষের হাতে পড়লে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সম্ভাবনার শেষ নেই। আর ভুল মানুষের হাতে পড়লে এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার হয়ে দাঁড়াবে সীমাহীন ভোগান্তির কারণ। শুধু একবার ভেবে দেখুন—আপনার ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট থেকে শুরু করে এটিএম পাসওয়ার্ডও চলে গেছে অন্যের হাতে! কী, গা শিউরে উঠছে না?
টেলিগ্রাফ বলছে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার হালের ইন্টারনেটের ক্রিপ্টোগ্রাফি নিমেষে ব্রেক করতে পারবে। ফলে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে এই কম্পিউটার থাকলে এত দিন ধরে চলে আসা ইন্টারনেট ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারে। কোটি কোটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হয়ে যাবে। হ্যাক করা যাবে সরকারি ডেটাবেইস। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ধস নামবে। ইন্টারনেটভিত্তিক অর্থ লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে পারবে অসৎ হ্যাকাররা। আবার রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও ধসিয়ে দেওয়া যাবে।
নটিংহাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটির কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বিশেষজ্ঞ কলিন উইলমট বলেন, যে পক্ষ সবার আগে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মালিক হবে, সেই পক্ষই এই অসীম ক্ষমতার অধিকারী হবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার ক্ল্যাসিক ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবস্থাকে বিশাল ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
ইকোনমিস্ট বলছে, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের অপব্যবহার বিশ্বব্যাপী দুই ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যমানের ই-কমার্স শিল্পকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কারণ, বর্তমানে প্রচলিত ইন্টারনেট ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করেই এসব আর্থিক লেনদেন করা হয়ে থাকে। এই ক্রিপ্টোগ্রাফি রাষ্ট্রীয় তথ্যের গোপনীয়তাকেও সুরক্ষিত রাখে। সুতরাং এই ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে পারলে ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের বিস্তারিত তথ্য, ব্যাংকে লেনদেন, যাবতীয় ই-মেইল—এক কথায় ইন্টারনেট–সংশ্লিষ্ট সব তথ্যই অরক্ষিত হয়ে পড়বে। তখন যে–কেউ এসব তথ্যে নাক গলাতে পারবে, পারবে চুরি করতেও।
সমস্যা আছে রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়েও। নেদারল্যান্ডসের রাডবাউন্ড ইউনিভার্সিটির ক্রিপ্টোগ্রাফার পিটার সোয়েব বলেন, ‘আজ থেকে ১০-২০ বছর পর কেউ যদি আমার আজকের খুদে বার্তা বা ব্যাংক হিসাব দেখতে পান, তবে আমার মতো সাধারণ মানুষের হয়তো কিছু যাবে–আসবে না। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, আমি যদি একটি দমনমূলক রাষ্ট্রের নাগরিক হই, তখন কী হবে? এটি কি তখন দমনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠবে না?’
কে যাবে কার আগে?
কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই ইন্টারনেটে ব্যবহারের উপযোগী কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি হয়ে যেতে পারে। অনেকে অবশ্য বলছেন, আরও ১২ থেকে ১৫ বছরের আগে পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর কোয়ান্টাম কম্পিউটার পাওয়ার আশা নেই। তবে যেভাবে বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্র ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো কোমর বেঁধে লেগেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে, সেদিন খুব বেশি দূরে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউয়ে কড়া পাহারায় কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে গুগল। বসে নেই আইবিএম ও মাইক্রোসফট। এই দুটি প্রতিষ্ঠানই জোরেশোরে চালাচ্ছে এ–সংক্রান্ত গবেষণা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যদের চেয়ে কিছুটা এগিয়েই আছে গুগল। আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর এই প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে চীনা আলিবাবা ও হুয়াওয়ে।
শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোও নাম লিখিয়েছে এই রেসে। টেলিগ্রাফের দাবি, কোয়ান্টাম গবেষণায় যুক্তরাজ্য নাকি সবচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেছে! ব্রিটিশ সরকার ২০১৩ সালে জাতীয় কোয়ান্টাম প্রযুক্তি কর্মসূচির গবেষণাকাজে মোট ২৭০ মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। কোয়ান্টাম প্রযুক্তির উন্নতির জন্য ১০ বছর মেয়াদি বিনিয়োগের প্রকল্প আনছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, ২০২০ সালের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে কোয়ান্টাম ইনফরমেশন সায়েন্সভিত্তিক পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করতে ১০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে চীন।
সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরিতে কে কার আগে যাবে, তা নিয়ে ইঁদুরদৌড়ে নেমেছে সবাই। টেক জায়ান্ট বা শক্তিধর রাষ্ট্র—কারও মধ্যেই তফাত নেই। তবে যে পক্ষই এই কোয়ান্টাম জ্যাকপটে প্রথম হাত দিতে পারবে, তারাই বিশ্বের অর্থনৈতিক ও প্রাযুক্তিক নেতৃত্বে আসতে পারবে। প্রযুক্তিপ্রেমী তথা সাধারণ মানুষের আশা একটাই—কোয়ান্টাম কম্পিউটার যেন হ্যাকারদের হাতে না পড়ে!