আলোচিত ৭
২০২০ সাল শুরুর মধ্য দিয়ে আমরা প্রবেশ করেছি নতুন একটা দশকে। পড়ালেখা, ক্যারিয়ার, উদ্যোগ বা ভবিষ্যতের আলোচনায় গত দশক থেকে কিছু কিছু শব্দ ঘুরেফিরে আসছে বারবার। এগুলোর অর্থ কী? কেনই–বা এ সম্পর্কে জেনে রাখা ভালো? লিখেছেন ড্রিমস ফর টুমরোর প্রতিষ্ঠাতা ও রবির মানবসম্পদ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জাভেদ পারভেজ।
ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটি
ইন্টারনেট অব থিংসকে সংক্ষেপে বলা হয় আইওটি। সহজ করে বললে এর অর্থ হলো, যেকোনো জিনিস, যন্ত্রপাতি, পশুপাখি কিংবা মানুষের দেহেও ইন্টারনেটের সংযোগ। বর্তমানে আমাদের মুঠোফোন থেকে শুরু করে ঘর, গাড়ি কিংবা ঘড়ি—সবই ‘স্মার্ট’ হয়ে উঠছে। দূরনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি যোগ করতে এসবের সঙ্গে যোগ করা হচ্ছে ইন্টারনেট প্রযুক্তি। জিনিসপত্রের সঙ্গে ইন্টারনেট জুড়ে দেওয়াকেই বলা হচ্ছে ইন্টারনেট অব থিংস। উইকিপিডিয়া বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অটো-আইটি সেন্টারের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী পরিচালক কেভিন অ্যাশটন ১৯৯৯ সালে পি অ্যান্ড জি কোম্পানির একটি প্রকল্পে কাজ করার সময় ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করেন। শুরুর দিকে আইওটি শুধু ডেটা তৈরি ও সংগ্রহের কাজ করলেও বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের মাধ্যমে ডেটাগুলোকে বিশ্লেষণ করে নানা গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দিতে পারে; এমনকি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সে অনুযায়ী কাজও করতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে আইওটি প্রযুক্তির একটি জনপ্রিয় উদাহরণ হতে পারে ‘স্মার্ট হোম’। স্মার্ট হোমে একটি বাড়িতে ব্যবহৃত সব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, যেমন—বাতি, এয়ারকন্ডিশনার, স্বয়ংক্রিয় তালা, সিসিটিভি ক্যামেরাসহ পুরো নিরাপত্তাব্যবস্থা ইত্যাদি আইওটি প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। ফলে স্মার্টফোন বা স্মার্ট স্পিকারের মাধ্যমে জিনিসগুলো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কে জানে, কিছুদিন পর হয়তো আমাদের শরীরও ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। তখন নিয়মিত রক্ত চলাচল কিংবা হৃৎস্পন্দনে কোনো ব্যত্যয় ঘটলেই হয়তো খবর পৌঁছে যাবে কোনো হাসপাতালে!
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও সফটওয়্যার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে বাস্তবায়ন করাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলে। যেমন কোনো কিছু শেখা এবং তাকে কাজে লাগিয়ে সমস্যার সমাধানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুনলেই অনেকে কল্পনায় একটা রোবট দেখতে শুরু করেন। আদতে কিন্তু তা নয়। বর্তমানে যেসব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার মধ্যে কয়েকটি হলো মানুষের কথা সঠিকভাবে বুঝতে পারে, বিভিন্ন কৌশলভিত্তিক খেলায় (যেমন দাবা) প্রতিযোগিতা করা, স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ি চালানো পারে, সামরিক সিমুলেশন, অনেক বেশিসংখ্যক ও জটিল ডেটা ব্যাখ্যা করতে পারা ইত্যাদি।
আবেগিক বুদ্ধিমত্তা
সংবেদনশীল বুদ্ধিমত্তা বলতে বোঝায়, কোনো ব্যক্তির নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ ও সুপরিচালনার মাধ্যমে অন্যের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। ব্যবহারিক ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে, যে আবেগগুলো আমাদের আচরণ ও অন্যান্য মানুষকে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক উপায়ে প্রভাবিত করতে পারে, সেগুলোর বিষয়ে সচেতন হওয়া এবং সেই আবেগগুলোকে সঠিক উপায়ে পরিচালনা করতে শেখা; বিশেষত আমরা যখন নানামুখী চাপে থাকি। আমরা বেশির ভাগ সময় মনে আবেগের আসা–যাওয়া বুঝতে পারি না। ফলে আবেগের বশে নানা রকমের আচার-আচরণ ও কাজ করে ফেলি, যার বেশির ভাগই অপরিকল্পিত। এতে আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, কিন্তু নানা রকম খোঁড়া যুক্তি দিয়ে সেটাকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করি। এতে নিজের যেমন লাভ হয় না, অনেক ক্ষেত্রে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কে মারাত্মক ক্ষতি হয়। আবেগিক বুদ্ধিমত্তা বর্তমান সময়ে নেতৃত্বের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর পাঁচটি প্রধান উপাদান হচ্ছে আত্মসচেতনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, অনুপ্রেরণা, সহানুভূতি এবং সামাজিক দক্ষতা। আজকাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরির ক্ষেত্রে কিংবা উদ্যোক্তাদের জন্য আবেগিক বুদ্ধিমত্তা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদিও এই দক্ষতা পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হতে হলে আপনার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার মতো বুদ্ধি থাকতে হবে।
ব্লকচেইন
ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে জানলাম, সাতশি নাকামতো নামের একজন জাপানি কম্পিউটার বিজ্ঞানী (বা একদল বিজ্ঞানী, যাঁরা রূপক অর্থে এই নামটি ব্যবহার করেছিলেন) ২০০৮ সালে ব্লকচেইনের উদ্ভাবন করেন। ব্লকচেইন আবিষ্কারের মূল কারণ ছিল বিটকয়েন নামক ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের তথ্যভান্ডারকে নিরাপদ করা। ব্লকচেইনের মাধ্যমে বিটকয়েন একটি নতুন মাত্রা পায়। এটি প্রথম ডিজিটাল মুদ্রায় পরিণত হয়, যা কেন্দ্রীয় সার্ভারের (বা কোনো প্রকার বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান) সাহায্য ছাড়া দ্বৈত খরচ সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। একটি ব্লকচেইন হলো ক্রমবর্ধমান রেকর্ড তালিকা, যা ক্রিপ্টোগ্রাফি সংযুক্ত এবং নিরাপদ। প্রতিটি ব্লকে থাকে পূর্বের ব্লকের একটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ, সময়কাল ও আদান-প্রদানসংক্রান্ত তথ্য। একবার রেকর্ড হওয়ার পর একটি ব্লকের তথ্য সব উপ-অনুক্রমিক ব্লকের পরিবর্তন ছাড়া পরিবর্তন করা যায় না। তথ্যগত নিরাপত্তার কারণে ব্লকচেইনকে গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড সংরক্ষণের কাজে ব্যবহার করা হয়। যেমন পরিচয় ব্যবস্থাপনা, গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করার রেকর্ড, ঐতিহাসিক স্থানের নথিভুক্তই, খাদ্যনিরাপত্তা, নির্বাচন ইত্যাদি।
বিগ ডেটা
কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি যত উন্নত হয়েছে, আমরা তত ডেটা বা উপাত্তনির্ভর হয়ে পড়েছি। এই ডেটাগুলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে বেশ কিছু ট্রেন্ড বা প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যা থেকে ভবিষ্যতের অনেক কিছুরই সম্ভাব্যতা অনুমান করা সম্ভব। ব্যবসা, চিকিৎসা, শিক্ষা, আঞ্চলিক বা বিশ্ব রাজনীতি—সব বিষয়েই এই উপাত্ত বিশ্লেষণ দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ডেটার সংখ্যা বা পরিমাণ যত বাড়ে, বিশ্লেষণও জটিল হয়ে পড়ে। বিগ ডেটা হচ্ছে ডেটা বিশ্লেষণের একটি বিশেষ ক্ষেত্র, যেখানে অনেক বেশি পরিমাণ ও জটিল ধরনের ডেটা বিশ্লেষণের সক্ষমতা থাকে। এবং এই ডেটাগুলো থেকে অর্থবোধক উপাত্ত সংগ্রহ সম্ভব হয়, যা সাধারণ ডেটা বিশ্লেষণ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সম্ভব নয়। নব্বইয়ের দশকে ‘বিগ ডেটা’ শব্দটি কম্পিউটার–শাস্ত্রে প্রথম ব্যবহৃত হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের কম্পিউটার বিজ্ঞানী জন আর ম্যাসে বিষয়টিকে জনপ্রিয় করতে ভূমিকা রাখেন। ভবিষ্যতের পৃথিবী যে ডেটানির্ভর হবে, সেটা আমরা এখন জানি। এমনকি বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতে যাঁর কাছে যত বেশি উপাত্ত থাকবে, সে হবে তত বেশি ক্ষমতাধর বা প্রভাবশালী। বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগ ডেটা নিয়ে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। অতএব, ভবিষ্যতের জন্য তৈরি থাকতে হলে বিগ ডেটা সম্পর্কে জ্ঞান রাখা দরকার।
গ্রোথ হ্যাকিং
গ্রোথ হ্যাকিং হলো বাজারজাতকরণ ও বিপণনে তুলনামূলকভাবে নতুন একটি শব্দ, যা মূলত ক্রমিক প্রবৃদ্ধির কথা বলে। শুরুর দিকে স্টার্ট আপ (নতুন উদ্যোগের) উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এ কথাটি ব্যবহৃত হতো, যেখানে সামান্য অর্থের বিনিময়ে ও খুব অল্প সময়ে অনেক বেশি প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন হয়। পরবর্তী সময়ে বড় ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও এই ধারণাটিকে গ্রহণ করে। গ্রোথ হ্যাকিংয়ের কৌশলগুলোর উদ্দেশ্য থাকে অল্প ব্যয় করে স্বল্প সময় যতটা সম্ভব বেশি ব্যবহারকারী বা গ্রাহককে যুক্ত করা। একটি গ্রোথ হ্যাকিং দলে থাকেন মার্কেটিয়ার, ডেভেলপার, প্রকৌশলী এবং প্রোডাক্ট ম্যানেজার—যাঁরা ক্রমাগত ওই ব্যবসায় ব্যবহারকারী বা গ্রাহককে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে যুক্ত করতে থাকেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা গতানুগতিক বিপণনব্যবস্থার (যেমন রেডিও, টিভি, পত্রপত্রিকায় ঢালাওভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়া) বিপরীতে কম খরচের বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করেন; যেমন সোশ্যাল মিডিয়া, ভাইরাল বিপণন, টার্গেটেড অ্যাডভার্টাইজমেন্ট ইত্যাদি।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব
আমরা কমবেশি সবাই জানি যে তিনটি শিল্পবিপ্লব মানবসভ্যতার ইতিহাসকে পাল্টে দিয়েছে। প্রথম শিল্পবিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। দ্বিতীয়টি হলো, ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কার ও তৃতীয়টি ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট প্রযুক্তি। তবে আগের যেকোনো বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যাবে ডিজিটাল বিপ্লব, যাকে বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। আমরা চাই বা না চাই, আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম ইতিমধ্যে বদলে যেতে শুরু করেছে। পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন–প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, এমনকি রাষ্ট্র চালানোর প্রক্রিয়াও। সত্যি করে বলতে, স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনা করেছে মাত্র। আগামী ১০ বছরে ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে আমরা এমন সব পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি, যা এর আগের ১০০ বছরে সম্ভব হয়নি।