২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

গৌরনদীর এক স্কুলের ডিজিটাল হয়ে ওঠার গল্প

গৌরনদীতে বসেই বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের কাছে অনলাইনে পড়তে পারছে এই ছাত্রীরা
ছবি: স্ক্রিনশট

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার হোসনাবাদ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়। স্কুলের ছাত্রীরা বলে, এটি তাদের ডিজিটাল স্কুল। কারণ, তাদের বেশির ভাগ ক্লাসই হয় অনলাইনে। বিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষকদের পাশাপাশি এখানে অনলাইনে ছাত্রীদের পড়ান ভারত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকেরা। প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষক যেমন আছেন, তেমনি এ তালিকায় আছেন বিদেশি শিক্ষকও। ফলে গৌরনদীতে বসেই অনলাইনে বিশ্বমানের পড়াশোনার সুযোগ মিলছে এ বিদ্যালয়ে। বর্তমানে প্রায় ৩০০ ছাত্রী বিনা পয়সায় পড়াশোনা করছে এই বিদ্যালয়ে। এই মেয়েরা স্বপ্ন দেখছে চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও ব্যাংকার হওয়ার।

মেয়েদের স্কুল ছিল না সেই গ্রামে

সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের জন্য নিজ গ্রাম হোসনাবাদে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন মো. কামাল হোসেন। ২০০১ সালের কথা। মুঠোফোন মেরামত ও বিকিকিনির এক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. কামাল হোসেন। রাজধানীর ইস্টার্ন প্লাজায় তাঁর দোকান ও অফিস। একদিন সেখানে এলেন তাঁর গ্রামের একজন শিক্ষক— রেজাউল। তিনি কামাল হোসেনকে বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের কোনো গার্লস স্কুল (বালিকা বিদ্যালয়) নেই। আমরা চাই, তোমার জায়গায় স্কুল প্রতিষ্ঠিত হোক।’ 

স্কুল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি মনে ধরে কামাল হোসেনের। তিনি রেজাউলকে বলেছিলেন, ‘আমার মা–বাবা রাজি থাকলে স্কুল করতে রাজি আছি।’ ২২ বছর আগের স্মৃতিচারণা করে কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০১ সালে আমার টাকাপয়সা খুব বেশি ছিল না। তবে যতটুকু সামর্থ্য ছিল, গ্রামের বিভিন্ন উন্নয়নে খরচ করতাম। বিষয়টি জানানোর পর এককথায় আমার মা–বাবা রাজি হন। আম্মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আপনারা জমি দিতে রাজি হলেন কেন?” আম্মা জানিয়েছিলেন, গার্লস স্কুলে মেয়েরা পড়বে, যাদের পরিবার খরচ চালাতে পারবে না তারা আসবে, মেয়েদের শিক্ষার প্রসার হবে—রাজি হওয়ার কারণ এটি। আমার মায়ের নাম আম্বিয়া খাতুন। আমাদের খুব বেশি জমি ছিল না, কিন্তু তারপরও তাঁরা জমিগুলো স্কুলের নামে লিখে দিয়েছিলেন।’

সামনে এগিয়ে চলা

কামাল হোসেনদের পারিবারিক জায়গায় চিংড়িঘের ছিল। বেশ ভালো মানের চিংড়ির চাষ হতো সেখানে। স্কুল তৈরির জন্য ঘেরটি ভরাট করার জন্য প্রথমে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। পরে স্কুলের আশপাশের বেশ কিছু জমি কেনেন কামাল হোসেন। হোসনাবাদে ২০০১ সালেই প্রতিষ্ঠিত হলো হোসনাবাদের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। 

স্কুলটা করার পেছনে কামাল হোসেনের মায়ের আগ্রহ ও ইচ্ছা ছিল বেশি। তাঁর বাবার অবদানও কম নয়। তাঁরাই স্কুলের দেখাশোনা করতেন। স্কুলে পাকা ভবন হচ্ছে, এটা কামালের বাবা শুনে গেছেন, কিন্তু দেখে যেতে পারেননি। স্কুলে পাকা দালান হয়েছে ২০১৮ সালে। আরেকটা ভবন নির্মাণের বরাদ্দ চূড়ান্ত হয়েছে, সেটার কাজ এখন চলছে। 

যেভাবে ডিজিটাল স্কুল

অষ্টম শ্রেণি থেকে হোসনাবাদ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ছে সুমাইয়া ইসলাম। এবার এসএসসি পাস করেছে এই স্কুল থেকে। মানবিক বিভাগ থেকে পেয়েছে জিপিএ–৪.৬৭। সুমাইয়া বলে, ‘বাইরের শিক্ষকদের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছি। আমাদের স্কুলের শিক্ষকেরা আমাদের সন্তানের মতো রেখেই পড়িয়েছেন। এই সুযোগ না পেলে আমার আর পড়াশোনা হতো না। আমি একজন শিক্ষক হতে চাই। আমার স্বপ্ন এখন শিক্ষক হওয়া। সুযোগ পেলে নিজের স্কুলেই শিক্ষকতা করব।’

হোসনাবাদ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার শুরুটা ২০২১ সাল থেকে। কামাল হোসেনের ইচ্ছা ছিল, নিয়মিত শিক্ষকদের বাইরেও ছাত্রীরা যেন দেশি–বিদেশি শিক্ষকদের কাছে পড়ার সুযোগ পায়। দেশের সেরা স্কুলগুলোর মতোই যেন পড়াশোনার সুযোগ পায় গৌরনদী থেকেই। স্কুলের উপদেষ্টা মশিউর রহমান বলেন, ‘২০২১ সাল থেকেই জুম ও গুগল মিটের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়া হয়। শ্রেণিকক্ষে সরাসরি পাঠদানের পাশাপাশি ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অনলাইনেও পড়ানো হচ্ছে। স্কুলটিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রয়োগ আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, আমরা সে চেষ্টা করছি। নতুন ডিজিটাল ল্যাবও হচ্ছে।’ 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষাথী এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শিক্ষকের মাধ্যমে ছাত্রীদের অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে স্কুলটিতে। ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের সঙ্গে প্রজেক্টর জুড়ে দিয়ে বড় পর্দায় ক্লাস করান বাইরের শিক্ষকেরা। তাঁদের কেউ ভারত, কেউ কানাডা বা অস্ট্রেলিয়া থেকে সরাসরি অনলাইনে ক্লাস নেন। ঢাকা থেকেও পাঁচজন ক্লাস নেন অনলাইনে। এসএসসিতে এই স্কুলের ছাত্রীদের পাসের হার শতভাগ। অনলাইনে দূর থেকে যাঁরা পড়ান, তাঁদের কেউই পড়ানোর বিনিময়ে কোনো অর্থ নেন না।

এ রকম একজন শিক্ষক ড. তিলোত্তমা সিং। তিনি ভারতের উত্তরাঞ্চল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। হোয়াটসঅ্যাপে তিলোত্তমা বলেন, ‘নারীশিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে হোসনাবাদ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী ও শিক্ষকদের সচেতন করছি। ছাত্রীরা যাতে গুণগতভাবে গড়ে ওঠে সে চেষ্টাই করছি। ছাত্রীরা আরও ভালো ফল করার ব্যাপারে প্রত্যয়ী।’ 

স্বপ্ন আরও বড়

এ বিদ্যালয়ে নতুন একটি ভবন তৈরি হচ্ছে। এ ভবনে ছাত্রীদের জন্য একটি কম্পিউটার ল্যাব করা হবে। অনলাইন পড়াশোনা আরও বিস্তৃত হবে বলে মনে করেন কামাল হোসেন। পাঠক্রমের বাইরে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে তাদের দক্ষ করে তোলা হবে। গৌরনদীর মেয়েরা যাতে আধুনিক পেশা, আধুনিক প্রযুক্তির দুনিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে—এমনভাবেই তাদের গড়ে তুলতে চান এই স্কুলের সঙ্গে যুক্ত সবাই।