অদ্ভুত আকৃতির এই বিমান কেন অন্যতম বিশ্বসেরা
দেখতে অদ্ভুত বিশ্বসেরা বিমানের মধ্যে একটি এয়ারবাস বেলুগা। তিমি আকৃতির এই বিমান এখন নিজস্ব এয়ারলাইনসের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিমান পর্যবেক্ষণকারী (প্লেনস্পটার) ও ভ্রমণপিয়াসুদের কাছে এই বিমান অদ্ভুত আর ‘সুদর্শন’ হিসেবে আলোচিত। বড় আকারের এই কার্গো বিমানটিকে সারা বিশ্বের প্লেনস্পটাররা প্রায় দুই দশক ধরে অনুসরণ করছেন।
ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে এয়ারবাসের কারখানা আছে। সেখানে বিমানের যন্ত্রাংশ পরিবহন করে বেলুগা। সম্প্রতি এই বিমান দিয়ে এয়ারবাস বেলুগা ট্রান্সপোর্ট নামে একটি স্বতন্ত্র মালবাহী এয়ারলাইনস চালু করেছে। এয়ারবাস বেলুগা ট্রান্সপোর্টের প্রধান বেনোইট লেমনিয়ার বলেন, বিমানে পণ্য পরিবহনের বাজারে বড় আকারের বিমান নেই বললেই চলে। বিমানের অনেক যন্ত্রাংশ সাধারণ বিমানে পরিবহন করা যায় না। এয়ারবাস বেলুগায় সব কিছুই এঁটে যায়।
প্রথম বেলুগাকে এয়ারবাস সুপার ট্রান্সপোর্টার হিসেবে ডাকা হতো। বেলুগা নামের সাদা আর্কটিক তিমির মতো দেখায় বলে এই বিমানের নাম রাখা হয় এয়ারবাস বেলুগা। এয়ারবাস বিমানটির নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রেখেছে বেলুগা এসটি। ১৯৯৪ সালে প্রথম আকাশে ওড়ে বেলুগা। ১৯৯৫ সালে নিয়মিত পণ্য পরিবহনের কাজ শুরু করে। পরবর্তী সময়ে আরও চারটি বেলুগা তৈরি করা হয়। প্রধানত যুক্তরাজ্য, স্পেন, তুরস্ক থেকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নিয়ে ফ্রান্সের টুলুস ও জার্মানির হামবুর্গের কারখানায় নিয়ে যায় বেলুগা। বিশেষ নকশায় বেলুগা তৈরি করা হয়। একটি এ৩০০-৬০০ বিমানের সামনের অংশ রূপান্তর করে বেলুগা তৈরি করা হয়েছে। একই সঙ্গে বহিরাবরণ বদলে ফেলা হয়। আর বড় দরজা যুক্ত করার মাধ্যমে পণ্য পরিবহনের উপযোগী করে তোলা হয়। বেলুগা এসটি মডেলের ধারণক্ষমতা ৪৭ হাজার কেজি। দৈর্ঘ্য ৫৬ দশমিক ১৫ মিটার। ডানার দৈর্ঘ্য ৪৪ দশমিক ৮৪ মিটার। জ্বালানির ধারণক্ষমতা ২৩ হাজার লিটার।
বেলুগার আগে এয়ারবাস ১৯৫০ সালের বোয়িং স্ট্র্যাটোক্রুজার যাত্রীবাহী প্লেনের পরিবর্তিত সংস্করণ দিয়ে পণ্য পরিবহন করত। সেই পরিবহন বিমানের নাম ছিল সুপার গাপ্পি। সুপার গাপ্পির মাধ্যমে মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করত নাসা। এখন নতুন করে পণ্য পরিবহনের জন্য বেলুগাকে আরও প্রশস্ত ও উন্নত করে বেলুগা এক্সএল তৈরি করা হচ্ছে। আগের বেলুগার চেয়ে দীর্ঘ ও বড় বেলুগা এক্সএল। নতুন বেলুগায় এয়ারবাস এ ৩৫০ বিমানের দুটি ডানা বহন করা যায়। এ৩৩০ কাঠামোয় নতুন বেলুগা তৈরি করা হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে এযাবৎ ছয়টি এক্সএল মডেলের বিমান তৈরি করা হয়েছে। এই নতুন বিমানে ৫০ হাজার কেজি পণ্য পরিবহনের সুযোগ আছে। ৬৩ দশমিক ১ মিটার লম্বা এই বিমানের ডানার দৈর্ঘ্য ৬০ দশমিক ৩ মিটার। এই বিমানের জ্বালানি ক্যাপাসিটি ৭৩ হাজার কেজি। ঘণ্টায় বিমানটি ৭৩৭ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারে।
বেলুগা দিয়ে দুই দশকের বেশ সময় ধরে পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। বেনোইট লেমনিয়ার বলেন, নতুন মডেলের বেলুগার মাধ্যমে নতুন কার্গো এয়ারলাইনসের কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। আগে বেলুগার মাধ্যমে হেলিকপ্টার ও কৃত্রিম উপগ্রহ পরিবহন করা হতো। এখন আরও বেশি পণ্য পরিবহন করা হবে। ২০২২ সালে এয়ারবাস বেলুগার মাধ্যমে এয়ারলাইনস চালুর প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এখন গ্রাহকের সময় ও অবস্থান অনুযায়ী পণ্য পরিবহন করা যায়। বেলুগার কার্গোর জায়গা সাধারণ পণ্য পরিবহন বিমানের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি। বোয়িং ৭৪৭-৮এফ বিমানের চেয়ে ১০ শতাংশ প্রশস্ত বেলুগা। স্যাটেলাইট, হেলিকপ্টার থেকে শুরু করে বিমানের ইঞ্জিন, ফ্লাইট সিমুলেটর, নৌকা ও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিশালাকার পণ্য পরিবহন করা হবে।
বেলুগার সামনের অংশ বা মাথা বড় হওয়ার কারণে বিমানটি চালাতে পাইলটদের বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। বিমানটি একটানা ৩ হাজার কিলোমিটার উড়তে পারে। ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের জন্য এই বিমানকে মধ্য আটলান্টিকের অ্যাজোরস ও কানাডায় জ্বালানির জন্য থামতে হয়। এসব কার্গো বিমানে সর্বোচ্চ ৪০ মেট্রিক টন পণ্য সরবরাহ করা যায়। বেশি ওজনের চেয়ে বড় আয়তনের পণ্য পরিবহনের জন্য বেলুগার নকশা করা হয়েছে। বেলুগার প্রতিদ্বন্দ্বী বিমান আন্তোনোভ এএন-১২৪ তিন গুণ বেশি ওজন বহন করতে পারে। এই বিমান ২০২২ সালে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়।
বিমানবিষয়ক পরামর্শক সংস্থা অ্যাভিয়েশনভ্যালুসের বিশ্লেষক গ্যারি ক্রিচলো বলেন, এয়ারবাস বেলুগার মাধ্যমে পণ্য পরিবহনের বিষয়টি অন্যান্য বাণিজ্যিক মালবাহী বিমান চলাচলের চেয়ে আলাদা। হেলিকপ্টার বা স্যাটেলাইট বহন আর অ্যামাজনের জন্য পণ্য পরিবহন বেশ আলাদা। গত ২০ বছরে প্রতিটি বেলুগার জন্য প্রায় ১ কোটি ৯৯ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয় হয়েছে। পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে নিয়মিত অর্থ আয়ের সুযোগ তৈরি করেছে বেলুগা।
সূত্র: সিএনএন