দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আশিকুরের উদ্যোগ চোখ খুলে দেয় অন্যদের
পড়াশোনাসহ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ যাতে বিভিন্ন কাজ করতে পারেন প্রযুক্তির সাহায্যে, সে জন্য স্মার্টফোনের অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ) ও সফটওয়্যার তৈরি করে ইনোভেশন গ্যারেজ লিমিটেড নামের একটি দেশি প্রতিষ্ঠান। প্রতি মাসে এই প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবার গড় বিকিকিনি ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা; লাভ হয় আড়াই লাখ টাকা।
সফটওয়্যার, তথ্যপ্রযুক্তি সেবা ও নানা রকম অ্যাপ এই প্রতিষ্ঠানের পণ্য। এসব পণ্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নত করার জন্য।
ইনোভেশন গ্যারেজ যিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেই আশিকুর রহমান নিজেও একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। অধ্যবসায় ও ইচ্ছাশক্তির জোরে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে তিনি আজ সফল।
ছোটবেলায় চার–পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতোই ছিলেন আশিকুর রহমান। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা–হইহুল্লোড়, মা–বাবা–বোনদের সঙ্গে হাসি–আনন্দ আর পড়াশোনায় মেতে থাকতেন তিনি। দেখতে দেখতে উঠলেন অষ্টম শ্রেণিতে।
বয়স তখন ১৩ বছর; কিন্তু এই বয়সে এসে ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি হারান আশিকুর।
ঢাকার ছেলে, ঢাকাতেই বেড়ে ওঠা, অথচ নিজের উপযোগী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুঁজে পেলেন না। মা–বাবা তাঁকে ভর্তি করলেন কুমিল্লার একটি স্কুলে। তাঁর মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল পাঠ্যবইয়ের। ব্রেইল বই ছিল কম। তিন-চারজন ভাগাভাগি করে পড়তেন একেকটি বই। এভাবেই কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড থেকে এসএসসি পাস করলেন তিনি।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সংগ্রামের এমন গল্প হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আশিকুর রহমানের গল্পটা বিস্ময়কর। আশিকুর প্রতিষ্ঠা করেছেন ইনোভেশন গ্যারেজ লিমিটেড।
বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে এবং সহায়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ২০১৭ সালে আশিকুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন ইনোভেশন গ্যারেজ লিমিটেড। সাত বছরে এর অর্জন দেখলে অবাক হতে হয়। আদাবরের পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটিতে এই প্রতিষ্ঠানে এখন ১০ জন কর্মী কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানটি বিটুবি (বিজনেস টু বিজনেস) ঘরানার। এটি মূলত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ‘প্রবেশগম্য প্রযুক্তি’ ও সমাধান নিয়ে কাজ করে। যে প্রযুক্তিগুলো বাংলা ভাষায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য এখনো সহজলভ্য নয়, সেগুলো নিয়ে গবেষণা করার পাশাপাশি উদ্ভাবন ও বিপণনের কাজ করে তারা।
যেভাবে আজকের অবস্থানে
তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে বড় আশিকুরের জন্ম ১৯৮১ সালে ঢাকার আদাবরে। অধ্যবসায়ের জোরে ২০০১ সালে মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন। স্নাতক হন ২০০৫ সালে। ২০০৮ সালে চাকরি নিলেন একটি এনজিওতে। সেখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কম্পিউটারের মৌলিক প্রশিক্ষণ দেয়। সে সময় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পরীক্ষার সময় সঙ্গে একজন সহকারী দেওয়া হতো, যাঁরা পরীক্ষার্থীর কথা শুনে শুনে লিখে দিতেন; কিন্তু কম্পিউটার দক্ষতার পরীক্ষায় দেখা যেত, সঠিক শ্রুতলেখক পাওয়া যাচ্ছে না। বড় একটি সমস্যা দেখা দিল।
তখন আশিকুর রহমান উদ্যোগ নেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের যত পরীক্ষা হবে, সেখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা নিজেরাই পরীক্ষা দেবেন। ২০১০ সালে বাংলাদেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের প্রথম কোনো ব্যাচ শ্রুতলেখক ছাড়াই কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। ২০১২ সাল পর্যন্ত আশিকুর যুক্ত ছিলেন এই প্রশিক্ষণে। এরপর তিনি একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত চাকরি করেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
হলো নিজের প্রতিষ্ঠান
২০১৬ সালের মে মাসে চাকরি ছেড়ে দিলেন আশিকুর। ঝোঁকের বশে নয়, ভেবেচিন্তে। ছয় মাস ধরে সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে লাগলেন। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ইনোভেশন গ্যারেজ নামে ট্রেড লাইসেন্স নিলেন আশিকুর। এরপর সমাধানগুলো (সলিউশন) নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করতে থাকেন। তখন অবশ্য অফিস বলতে কিছু ছিল না। বছরের শেষ দিকে এসে তিনি টের পান, শুধু পড়াশোনা করেই সব হয় না। ব্যক্তি উদ্যোগে বড় কাজ করা অনেক জটিল। তখন তিনি ইনোভেশন গ্যারেজ লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুললেন।
২০১৮ সালে আশিকুরের প্রতিষ্ঠান একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করে। এই অ্যাপ দিয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা স্মার্টফোনের মাধ্যমে পড়তে পারবেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আশিকুরকে।
ইনোভেশন গ্যারেজ লিমিটেডের ব্যবসা মূলত বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের জন্য, যাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থান ভালো নয়, নিজেদের পক্ষে এমন সহায়ক প্রযুক্তি কেনা অসম্ভব। তবে আশিকুরের প্রতিষ্ঠান সরাসরি কোনো ব্যক্তিকে নয়; বরং কোনো এনজিও বা বিশ্ববিদ্যালয়কে সহায়তা দেয়। এই প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পাশে থাকা
আশিকুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়ানো। তাঁদের প্রযুক্তিগত যত সহযোগিতা দরকার, দেওয়ার।’ কী ধরনের কাজ করছেন, জানতে চাইলে আশিকুর রহমান নামফলকের কথা বলেন। কারও অফিস বা বাড়ির সামনে লাগানো নামফলক দেখে স্বাভাবিক কোনো মানুষ সহজেই বুঝতে পারেন; কিন্তু একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সেটি কীভাবে পড়বেন? ফলে তাঁরা একটি নামফলকের নকশা ডিজাইন করেছেন, যেটিতে সাধারণ লেখা ও ব্রেইল–পদ্ধতি থাকবে একসঙ্গে। আবার কারও বিজনেস কার্ড বা ক্যালেন্ডারও তৈরি করে দেন এই পদ্ধতিতে।
বইমেলায় স্পর্শ ফাউন্ডেশনের বই ও অন্যান্য পণ্যের সবই ইনোভেশন গ্যারেজের তৈরি। এনসিটিবির প্রাক্–প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ব্রেইল পাঠ্যপুস্তক এই প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করে। চার বছর গবেষণা চালিয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ব্যবহারোপযোগী কম্পিউটার মাউস তারা তৈরি করেছে। এ ছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পঠনপদ্ধতি ব্রেইল প্রিন্টার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইনডেক্স ব্রেইল, ব্রেইল অনুবাদক সফটওয়্যার নির্মাতা ডাক্সবেরি সিস্টেম এবং ছবিকে টেকটাইলে রূপান্তরকারী সফটওয়্যার টেকটাইলভিউর বাংলাদেশের একমাত্র পরিবেশক ইনোভেশন গ্যারেজ।
আশিকুর রহমান তাঁর উদ্যোগের স্বীকৃতি হিসেবে ১ অক্টোবর পেয়েছেন আইডিএলসি–প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২৩। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি অন্যদের কথা ভেবে কাজ করিনি। আমি কাজ করেছি নিজের জন্য। নিজে যে সমস্যায় পড়েছি বা পড়তাম, তার সমাধানগুলো বের করেছি। পরে দেখা গেছে, সেটিই আসলে সবার কাজে লাগছে। সেটি থেকেই আমার এই উদ্যোগ।’
নিজের অপূর্ণতা ও চাওয়া সম্পর্কে আশিকুর বলেন, ‘আমাদের যদি বড় বিনিয়োগ থাকত, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা পেতাম, তাহলে আমরা নিজেরাই অনেক পণ্য বানাতে পারতাম। এখন যে পণ্য আমাদের বিদেশ থেকে ৯০ হাজার বা ১ লাখ টাকা দিয়ে কিনতে হয়, একই মানের পণ্য আমরা দিতে পারতাম ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায়।’