কৃষ্ণগহ্বর: মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ও প্রকৃতিবিষয়ক একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা
অকল্পনীয় মহাকর্ষের অধিকারী এক মহাজাগতিক বস্তু কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল। ব্ল্যাকহোল শব্দের অর্থ কালো গর্ত। এই নামকরণ করার পেছনের কারণ হলো, এটি এর নিজের দিকে আসা সব আলোকরশ্মিকে শুষে নেয়। কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোনো আলোকবিন্দু আর বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না, ঠিক তাপগতিবিদ্যার কৃষ্ণ বস্তুর মতো। এই কৃষ্ণগহ্বর মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ও প্রকৃতিবিষয়ক একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা। এই ধারণা অনুযায়ী, কৃষ্ণগহ্বর মহাবিশ্বের এমন একটি বস্তু, যা একটি অত্যন্ত ঘন-সন্নিবিষ্ট বস্তু (High-density matter)। অর্থাৎ অতিক্ষুদ্র আয়তনে অত্যন্ত বেশি ভরের বস্তু। একে সুপারম্যাসিভ অ্যাস্ট্রোনমিক্যালও বলা যেতে পারে। এর মহাকর্ষীয় বল এত বেশি যে সে কোনো কিছুকেই তার ভেতর থেকে বাইরে বের হতে দেয় না। এমনকি আলো বা বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বিকিরণকেও নয়। প্রকৃতপক্ষে, এই জায়গায় মহাকর্ষীয় বলের মান এত বেশি হয়ে যায়, তা মহাবিশ্বের অন্য সব বলকে অতিক্রম করে। তার ফলে এর থেকে কোনো কিছুই বাইরে পালিয়ে আসতে পারে না।
আগেই বলেছি, কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হয় খুবই বেশি ঘনত্ববিশিষ্ট ভর থেকে। বিপুল পরিমাণ ভরবিশিষ্ট কোনো বস্তু, যার মহাকর্ষের প্রভাবে আলোকতরঙ্গ পর্যন্ত পালাতে পারে না—এ ধারণা প্রথম প্রদান করেন ভূতত্ত্ববিদ জন মিচেল। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বর-সম্পর্কিত এই ধরনের মতামত ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রবলভাবে উপেক্ষিত হয়, কেননা আলোর মতো ভরহীন তরঙ্গ কীভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, তা বোধগম্য ছিল না। ১৯১৫ সালে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন, যার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে আলোর গতিকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রভাবিত করতে পারে। স্বাভাবিকভাবে কোনো একটি নক্ষত্র সংকুচিত হলে বা চুপসে গেলে কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়। নক্ষত্রগুলো অস্বাভাবিক ভরবিশিষ্ট হওয়ায় এগুলোর মাধ্যাকর্ষণও অনেক। কারণ আমরা জানি, মাধ্যাকর্ষণের সঙ্গে ভরের একটি অনন্য সম্পর্ক আছে। যখন নক্ষত্রের বাইরের তাপমাত্রার চাপে ভেতরের মাধ্যাকর্ষণ বাড়তে থাকে, তখন সেই বলের কারণে নক্ষত্রটি ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে। তখন সব ভর একটি বিন্দুতে পতিত হতে শুরু করে এবং অসীম ঘনত্ববিশিষ্ট বস্তুতে পরিণত হয়। তবে সব চুপসে যাওয়া নক্ষত্রই কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয় না। কৃষ্ণগহ্বর হবে কি না, তা নির্ভর করে এর ভর এবং একটি নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের ওপর।
ওপরের ছবিটি কৃষ্ণগহ্বরের ছবি, যা একটি ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের (EHT) সাহায্যে তোলা হয়েছে। এটি একটি বিশেষ ধরনের টেলিস্কোপ, যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত কয়েকটি দানবাকৃতির রেডিও টেলিস্কোপের সমাহার। সব কটি টেলিস্কোপ একই সঙ্গে সমান্তরালভাবে কাজ করে এবং তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। ছবিটিতে অর্ধচন্দ্রাকার আকৃতির আলোকবলয় ও মাঝখানে একটি বৃত্তাকার ছায়া দেখা যাচ্ছে। অর্ধচন্দ্রাকার বলয়টি ঘূর্ণায়মান কৃষ্ণগহ্বরের একটি বহিঃপ্রকাশ। এখানে একটি কথা না উল্লেখ করলেই নয়, তা হচ্ছে এই ছবি তুলতে টেলিস্কোপটিতে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বর্ণালির মাইক্রোওয়েভ কম্পাঙ্কের রেঞ্জ ব্যবহার করা হয়েছিল। এর সঙ্গে স্বনামধন্য বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর যুগান্তকারী আবিষ্কার ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কোনো অল্প স্থানে খুব বেশি পরিমাণ ভর একত্র হলে স্থানটিতে একধরনের বক্রতা আসে। আমরা মহাবিশ্বকে একটি সমতল পৃষ্ঠ কল্পনা করছি, অনেকটা যেন টান টান একটি বিশাল কাপড়ের মতো। এবার তার ওপরে কোথাও যদি একটি ভারী বস্তু রাখা হয়, স্বভাবতই জায়গাটি নিচু হয়ে যাবে এবং মনে হবে যেন কাপড়ের ওই স্থানে একটি গর্ত হয়েছে। ঠিক মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে একই রকম ঘটনা ঘটছে। মহাকাশের যেসব স্থানে ভর বা Mass অচিন্তনীয় পরিমাণ বেশি, সেসব স্থানে গর্তের সৃষ্টি হবে। এই অসামান্য ভর এক স্থানে জটলা পাকিয়ে স্থান-কাল বক্রতার সৃষ্টি করে। প্রতিটি গ্যালাক্সির স্থানে স্থানে কমবেশি কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের কথা জানা যায়।
বিগ ব্যাং তত্ত্বানুসারে, ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে আমাদের মহাবিশ্ব একটি অতিপরমাণুর (Super Atom) আকারে ছিল, যা ছিল খুব ঘন ও উত্তপ্ত। এর ঠিক আগের অবস্থাকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সিঙ্গুলারিটি কী? সিঙ্গুলারিটি হচ্ছে একটি বিশেষ বিন্দু, যা আমাদের প্রচলিত পদার্থবিদ্যা বোঝার ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করে।
সিঙ্গুলারিটিতে মৌলিক রাশিগুলোর (বেগ, ঘনত্ব, সময়, দৈর্ঘ্য বা আকৃতি) কোনো গাণিতিক সসীম মান থাকে না। সহজ অর্থে, The relevant quantities either become 'zero' or infinite with nothing in between in a mathematical sense.
গণিতে যেমন একটি বিন্দুর অবস্থান ছাড়া আর কোনো ধর্ম নেই, তেমনি শূন্যমাত্রিক সিঙ্গুলারিটিও। তবে জ্যোতির্বিদ্যার এই বিন্দুর একটি সসীম ভর আছে! সিঙ্গুলারিটির ঘনত্ব অসীম; কেননা, সসীম ভর একেবারে বলতে গেলে শূন্য আয়তনে সংকুচিত হয়। এই অসীম ঘনত্বের অঞ্চলকেই বলা হয় সিঙ্গুলারিটি। এই অসীম ঘনত্বের বিন্দুর জন্য স্থান-কাল-পাত্রের বক্রতাও হয় অসীম। এখানে সাধারণ পদার্থবিদ্যার কোনো নিয়ম খাটে না। এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো অদ্বৈত বিন্দু। কেন নিয়ম খাটে না, তা বুঝতে হলে প্ল্যাঙ্কের একক সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে! পদার্থবিজ্ঞানে প্ল্যাঙ্কের ইউনিট (প্ল্যাঙ্ক একক) একটি ব্যবস্থা, যেখানে চিরাচরিত পদার্থবিদ্যার ধ্যানধারণা কার্যত অচল হয়ে যায়।
সিঙ্গুলারিটি হলো প্ল্যাঙ্কের দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট একটি পরিসর, যা পদার্থবিজ্ঞান পরিমাপ করতে পারে না। সিঙ্গুলারিটি হলো অতিক্ষুদ্র, যা শূন্যমাত্রার! তবে প্রশ্ন আসতেই পারে যে শূন্যের সঠিক মান না জানা গেলেও শূন্যের একদম কাছাকাছি মান যেমন পাওয়া সম্ভব, তেমনি সিঙ্গুলারিটি ব্যাখ্যা না করা গেলেও এমন দৈর্ঘ্যের বস্তু থাকতেই পারে, যাকে পরিমাপ করা সম্ভব। এ রকম সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট বস্তুর উপস্থিতি পদার্থবিজ্ঞানের নীতি দ্বারা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। পরিমাপযোগ্য এই সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্যকে প্ল্যাঙ্কের দৈর্ঘ্য (Planck's length) বলে।
প্ল্যাঙ্কের দৈর্ঘ্য হলো এমন ক্ষুদ্রতম দৈর্ঘ্য, যার নিচে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের মধ্য দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ এর চেয়ে ক্ষুদ্রতর পরিসরে সংঘটিত ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করতে হলে মহাকর্ষের একটি পূর্ণাঙ্গ কোয়ান্টাম তত্ত্ব থাকা দরকার, যা আজও উদ্ভাবিত হয়নি। সহজভাবে বলতে গেলে, প্ল্যাঙ্কের দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট একটি দৈর্ঘ্য আমাদের জানা পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে থাকা সম্ভব নয়। সংখ্যাগতভাবে এই মান হলো 1.6 x 10-35 মিটার! ভাবছেন এই দৈর্ঘ্য বেশ বড়ই তো লাগছে! একটি কোয়ার্কের (পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াস মূলত প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে তৈরি। এই প্রোটন বা নিউট্রন আবার কয়েকটি কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি।) ব্যাসার্ধ হলো ৪৩ বিলিয়ন বিলিয়ন সেন্টিমিটারের এক ভাগ (0.43 x 10−16) সেমি), যা একটি প্রোটনের চেয়ে ২০০০ ভাগের এক ভাগ ক্ষুদ্র এবং একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ব্যাসার্ধের চেয়ে ৬০ হাজার ভাগের এক ভাগ ক্ষুদ্র। হাইড্রোজেন পরমাণু আবার ডিএনএর ডাবল হেলিক্সের চেয়ে ৪০ ভাগের এক ভাগ ছোট; যা আবার একটি বালুর দানার চেয়ে কয়েক বিলিয়ন গুণ ছোট! তাহলেই, হিসাব করে দেখুন, আমাদের মহাবিশ্বের যেখানে অসীমের দিকে বিশালতা (Infinitely large), তেমনি এর উপাদানগুলো অসীমের নিকটতম ছোটও (Infinitesimally small) বটে! তাই ব্ল্যাকহোলের সিঙ্গুলারিটিকে ব্যাখ্যা করা আমাদের প্রচলিত পদার্থবিজ্ঞানে অসম্ভব!
একইভাবে প্ল্যাঙ্কের দৈর্ঘ্যের মতোই সময়ের ব্যাপারেও সর্বনিম্ন বলে একটা টার্ম আছে। অর্থাৎ প্রচলিত পদার্থবিজ্ঞানের নীতি অনুযায়ী এই সর্বনিম্ন সীমার নিচে আর সময়ের পরিমাণ হতে পারে না। সময়ের এই সর্বক্ষুদ্রতম পরিমাণকে ‘প্ল্যাঙ্কের সময়’ বলে! পদার্থবিজ্ঞানে, প্ল্যাঙ্কের সময় হলো প্ল্যাঙ্ক-একক ব্যবস্থায় শূন্য মাধ্যমে আলোকতরঙ্গের এক প্ল্যাঙ্কের দৈর্ঘ্য অতিক্রম করতে যেটুকু সময় লাগে। একে tP দ্বারা প্রকাশ করা হয়। প্ল্যাঙ্কের সময় কত ক্ষুদ্র, তা বোঝার জন্য সাধারণ কয়েকটি কথাই যথেষ্ট। ১ সেকেন্ডে যত একক প্ল্যাঙ্কের সময় আছে, পুরা মহাবিশ্বের বয়সেও এত সেকেন্ড নেই, আর হয়তো থাকবেও না। এক প্ল্যাঙ্কের সময়=৫.৩৯১২৪ x ১০-৪৪ সেকেন্ড!
বিগ ব্যাংয়ের আগে যেহেতু সময় বলে কিছু ছিল না, তাই প্ল্যাঙ্কের সময় ততটা বিগ ব্যাং–পূর্ববর্তী অবস্থা ব্যাখ্যা করার জন্য লাগে না। তবে বিগ ব্যাং–পরবর্তী সময়ের সূচনাবিন্দু হিসেবে ১০-৪৩ সেকেন্ড বিবেচনা করা হয়। এই সময়কে প্ল্যাঙ্কের যুগ বা প্ল্যাঙ্ক ইপক (Planck epoch) বলা হয়। প্ল্যাঙ্ক ইপকের আগের সময়কে (হয়তো সময় ছিল না) আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে না। একইভাবে ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রে অসীম বক্রতার জন্য সময় থেমে আছে বলে মনে হবে, যা প্রচলিত আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বা কোয়ান্টাম মেকানিকস ব্যাখ্যা করতে পারে না!
ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রস্থলকেও সিঙ্গুলারিটি বলে। মহাবিশ্ব যে সসীম ভরের অসীম ঘনত্বের সিঙ্গুলারিটি থেকে জন্ম নিয়েছে। একইভাবে ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রও সসীম ভরের অসীম ঘনত্বের শূন্য আয়তনের একই বিন্দু! আমরা ব্ল্যাকহোলকে দানবীয় একটি গোলক ভাবি। অনেকেই আবার ভাবি, এটি ফানেল আকৃতির। যা এর নিকটে যায়, আর মুক্তি পায় না। এর ভেতরে বুঝি চিরতরে হারিয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে ব্ল্যাকহোলের ভর এই অসীম ঘনত্বের একটি বিন্দুতেই পুঞ্জীভূত। ওপরের ছবিটি সিঙ্গুলারিটি বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে।
সিঙ্গুলারিটি ব্যাখ্যার জন্য বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম মেকানিকস ও সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দুই–ই দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়, এমন মিলিত একটি তত্ত্বের পেছনে ছুটছেন! কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান এবং সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব মিলিত এই তত্ত্বকে বলা হয় কোয়ান্টাম মহাকর্ষ বা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি। একে সবকিছুর তত্ত্ব বা থিওরি অব এভরিথিংও বলা হয়। কোয়ান্টাম মহাকর্ষ ব্যাখ্যা করার জন্য বেশ কয়েকটি তত্ত্বের অবতারণা করা হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে স্ট্রিং তত্ত্ব, সুপারস্ট্রিং তত্ত্ব, এম তত্ত্ব উল্লেখযোগ্য।
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সাবেক সিনিয়র অধ্যাপক, সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিকস, কলকাতা
পুরুষোত্তম চক্রবর্তী