বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জন্য নভেম্বর কেন গুরুত্বপূর্ণ
বিজ্ঞানের ইতিহাসে নভেম্বরকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস ধরা হয়। ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে দারুণ এক ঘটনা পুরো বিজ্ঞানের ইতিহাসে নতুন বাঁক তৈরি করেছিল। ১৯১৯ সাল যখন শুরু হয়, তখন আলবার্ট আইনস্টাইন নামটি তেমন আলোচিত ছিল না। পদার্থবিজ্ঞানীদের আলাপ বা আড্ডার বাইরে অজানা ছিল এই নাম।
সেই ১৯১৯ সালের শেষ ভাগে নভেম্বরে পুরো পৃথিবী এক জাদুর চমক দেখে, আর তাতেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম। বলা হয়, ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসেই পেটেন্ট অফিসের কর্মচারী আইনস্টাইন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন হিসেবে পরিণত হন। ওই বছরের ৬ নভেম্বর লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি ও রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির একটি যৌথ সভা আয়োজন করে। সেই সভায় বিজ্ঞানীরা পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় নেওয়া তথ্যাদি প্রকাশ করেন। তাঁদের তথ্য আইনস্টাইনের অভিকর্ষসংক্রান্ত নতুন তত্ত্বকে সমর্থন করে। আইনস্টাইনের অভিকর্ষসংক্রান্ত তত্ত্ব সাধারণ আপেক্ষিকতা হিসেবে পরিচিতি পায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) অধ্যাপক মার্সিয়া বার্টুসিয়াক বলেন, সেই সময়ে বিজ্ঞানীরা যে বিখ্যাত হতে পারেন, তা স্বাভাবিক ধারণা ছিল না। মেরি কুরি সেই সময়ে বহুল পরিচিত নামগুলোর একটি ছিল। ব্রিটেনের জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটন সেই সময়ে তারকা বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতা পরীক্ষা করার জন্য সূর্যগ্রহণ অভিযানের আয়োজন করেন।
তিনি প্রথমদিককার কয়েকজনের মধ্যে একজন, যাঁরা আইনস্টাইনের তত্ত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। এডিংটন যুক্তরাজ্যে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করেন। তিনি আইনস্টাইনের প্রতি গণমাধ্যমের মনোযোগ আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯১৯ সালে সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ দিয়ে আলো বেঁকে যায়—আলবার্ট আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণী এই সূর্যগ্রহণের সময় পরীক্ষা করা হয়। কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোনমি ইউনিভার্সিটির গ্রন্থাগারিক মার্ক হার্ন বলেন, ১৯১৯ সালের ২৯ মে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় এক সারিতে অবস্থান করে। সেই ঘটনার ছবি থেকে অদ্ভুত কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
গ্রহণের সময় অন্ধকারে দৃশ্যমান কয়েকটি তারা ভুল জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এটা নাকি আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন। সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ব্যবহার করে তিনি আপাতদৃষ্টিতে আকাশে তারার অবস্থান পরিবর্তনের কথা বলেন। এমনকি কতটা অবস্থান পরিবর্তন হবে, তা-ও গণনা করেন। সাধারণ আপেক্ষিকতার ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে, নক্ষত্রগুলো কতটা সরে যায়, তা জানা গিয়েছিল।
সাধারণ আপেক্ষিকতা কতটা সঠিক, তার প্রথম পরীক্ষামূলক প্রমাণ ছিল সেটি। বৃহস্পতিবারের সেই পূর্ণ সূর্যগ্রহণ ছিল বিজ্ঞানদুনিয়া কাঁপানো একটি ঘটনা। সূর্যগ্রহণের মোট সময় ছিল সর্বোচ্চ ৬ মিনিট ৫০ দশমিক ৭৬ সেকেন্ডের মতো। ১৪১৬ সালের পর থেকে এটি ছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম সূর্যগ্রহণ। সেই সূর্যগ্রহণে চাঁদের আপাত ব্যাস বেশ বড় ছিল।
এডিংটনের পরীক্ষার মাধ্যমে সাধারণ আপেক্ষিকতার জন্য একটি পর্যবেক্ষণমূলক পরীক্ষা করা হয়। ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্ক ওয়াটসন ডাইসন ও আর্থার স্ট্যানলি এডিংটন এই পরীক্ষা পরিচালনা করেন। সূর্যগ্রহণের দৃশ্য ধারণ করতে দুটি অভিযান পরিচালনা করা হয়। আফ্রিকান দ্বীপ প্রিন্সেপ ও ব্রাজিলের শহর সোব্রালে সূর্যগ্রহণের ছবি তোলা হয়। অভিযানের লক্ষ্য ছিল, সূর্যের কাছাকাছি থাকা তারার আলোর মহাকর্ষীয় বিচ্যুতি পরিমাপ করা। আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯১১ সালের গবেষণাপত্রে এই বিচ্যুতির পরিমাণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। প্রাথমিক ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক ছিল না। আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে তাঁর তত্ত্ব চূড়ান্ত করে উন্নত ভবিষ্যদ্বাণী করেন। অভিযানের ফলাফল থেকে জানা যায়, তারার আলো বেঁকে যায়।
সংবাদপত্র তখন উত্সাহের সঙ্গে সেই সংবাদ প্রচার করে। ‘বিজ্ঞানে বিপ্লব’ শিরোনাম করে টাইমস অব লন্ডন লিখেছিল ‘নিউটনিয়ান ধারণার উচ্ছেদ হয়েছে।’ নিউইয়র্ক টাইমস ছয় লাইনের শিরোনামে লিখেছিল, ‘স্বর্গেই শুধু আলো বেঁকে যায় না, আইনস্টাইনের তত্ত্বের জয়।’ আর সংবাদ-এ লিখেছিল, আকাশের তারা যেখানে আছে বলে মনে হয়, তারা আসলে সেখানে নেই, আর কোনো দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই।
এর পরের আলো তো আইনস্টাইন ও আপাতদৃষ্টিতে দুর্ভেদ্য তত্ত্বের ওপরই পড়েছে। ১৯২০ সালে এক বন্ধুকে আইনস্টাইন বলেন, এখন তো সব কোচম্যান (ঘোড়ার গাড়িচালক) ও সব ওয়েটার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সঠিক কি না, তা নিয়ে তর্ক করেন। বার্লিনে রীতিমতো সাধারণ মানুষেরা তাঁর শ্রেণিকক্ষে ভিড় জমানো শুরু করেন। এরপর তাঁর যুক্তরাষ্ট্র-জয়ের গল্প তো সবাই জানেন।
আইনস্টাইনের প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ ঐতিহাসিকদের কাছে এক রহস্য বটে। চলচ্চিত্র তারকারা যেভাবে দর্শকদের আকর্ষণ করেন, আইনস্টাইন সেখানে কী করেছেন যে এত মানুষের মনোযোগ পাবেন? ১৯৬০-এর দশকে পুরো বিশ্ব বিটল ম্যানিয়ায় আক্রান্ত হয়, কিন্তু একজন পদার্থবিজ্ঞানী কীভাবে তারকা হয়ে গেলেন? এর আগে কিন্তু এমন কিছুই দেখা যায়নি।
হাল আমলে স্টিফেন হকিং ব্যতীত বিজ্ঞানদুনিয়ায় এত বড় তারকার খোঁজ এখনো মেলেনি। বছরের পর বছর ধরে একজন পদার্থবিজ্ঞানীর কাজের জন্য বিশ্ব কেন এত আগ্রহ দেখিয়েছে, তা যেন এখনো রহস্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেই সময় পুরো পৃথিবীতে যেন চলছিল আতঙ্কিত এক পরিস্থিতি। লাখ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল, জাতীয়তাবাদ আর রাজনীতির ছকে বিভক্ত ছিল পুরো পৃথিবী। বছরের পর বছর ধরে যে যুদ্ধ চলছিল, সেখানে আইনস্টাইনের তত্ত্বটি বজ্রপাতের মতো পুরো বিশ্বকে আঘাত করে। বলা যায়, সারা বিশ্বে নতুন এক ঝাঁকুনি তৈরি করেন আইনস্টাইন।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালটেকের বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ ও আইনস্টাইন পেপারস প্রজেক্টের পরিচালক ও সাধারণ সম্পাদক ডায়ানা কোরমোস-বুচওয়াল্ড বলেন, তাঁর সেই সময়কার গল্প পৌরাণিক বলে মনে হতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরপর একজন জার্মান বিজ্ঞানীর ধারণা বিশ্ব গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ব্রিটিশদের কাছ থেকে তাঁর প্রশংসা পাওয়ার বিষয়টি ছিল বিস্ময়কর। জার্মান বিজ্ঞানীরা সেই সময় অস্থির হয়েছিলেন। তাঁদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হতো না। আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশনার অনুমতি ছিল না। আইনস্টাইন সেই সমস্যা সমাধান করতে পদক্ষেপ নেন, এটি ছিল অসাধারণ এক উদ্যোগ। তিনি তাঁর খ্যাতি ব্যবহার করে শত্রুদেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেন।
১৯১৯ সালে ৬ নভেম্বর লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি ও রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি আলবার্ট আইনস্টাইনের তত্ত্বের পরীক্ষার ফলাফল গ্রহণ না করলে হয়তো পৃথিবীর বিজ্ঞানের ইতিহাস অন্য রকম। সেই সময়কার বিজ্ঞানীরা কখনো টাইম মেশিনে করে ২০২৩ সালে ঘুরতে এলে চমকে যাবেন। তাঁদের সেই সময়কার অভিযান আর আবিষ্কারের কারণেই এখন জিপিএস থেকে শুরু করে মহাকাশে কত রঙের খেয়া যান পাঠাচ্ছি আমরা। পেটেন্ট অফিসের এক সাধারণ কর্মীর ভাবনা পুরো বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দুনিয়ায় কতটা চমক তৈরি করেছে, তা দেখতে পেয়ে নিশ্চয়ই রয়্যাল সোসাইটি ও রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সেই সময়কার গুণীরা গর্ব অনুভব করেছিলেন।
সূত্র: ডিসকভারি ম্যাগাজিন ও স্মিথসোনিয়ান ম্যাগ