হাঁসের পালকের মতো পিচ্ছিল তল তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা

বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর পানিপ্রতিরোধী তল (সারফেস) তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরাগিজমোডো

হাঁসের পিঠে থাকা পালক এমনই পিচ্ছিল যে হাঁস পানি থেকে উঠে এসে গা ঝাড়া দিলেই সব পানি ঝরে যায়। পিচ্ছিল পালকের কারণে হাঁসকে পানিতে ভেজানো যেন অসম্ভব।

কোন রহস্যে পানিতে ভিজলেও ভেজা লাগে না হাঁসদের? আবার পানি পড়তে পড়তে গাড়ির কাচ ঝাপসা হয়ে গেলে অনেকের মন খারাপ হয়। এসব মন খারাপ কমাতে বিজ্ঞানীরা বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর পানিপ্রতিরোধী তল (সারফেস) তৈরি করেছেন। বৃষ্টির দিনে বা পুকুরের পানিতে নামলে তো হাঁস ভিজে যায় না।

হাঁসের পালকের অনুপ্রেরণায় পানিতে ভিজবে না, এমন সব বস্তু তৈরির উদ্দেশ্যেই কাজ করছেন গবেষকেরা। ফিনিশ গবেষকেরা সিলিকন থেকে ‘তরলসদৃশ’ স্তর তৈরি করেছেন, যা গৃহপ্রকৌশলে বিপ্লব ঘটাতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। ফিনল্যান্ডের আল্টো বিশ্ববিদ্যালয় ও জাইভাস্কিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রবিন রাস অভূতপূর্ব কার্যকর এই তল উদ্ভাবন করেছেন। উদ্ভাবিত তলের ওপরে পানির ফোঁটা পড়লে তা দ্রুত সরে যায়। গৃহসামগ্রী থেকে শুরু করে পরিবহন, অপটিকস ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এই তল ব্যবহার করা যাবে। কঠিন সিলিকন পৃষ্ঠতল থেকে পানির ফোঁটা পিছলে গিয়ে বিকর্ষিত হয়। তলের বহিরাবরণ অনেকটা তৈলাক্ত পদার্থ বা লুব্রিকেন্টের মতো কাজ করে। পানি পড়লেই তা ঝরে যায়।

নতুন এই উদ্ভাবন কঠিন পৃষ্ঠ বা তলের সঙ্গে পানির ঘর্ষণ–সম্পর্কিত বিদ্যমান ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করছে। আণবিক পর্যায়ে পিচ্ছিলতা সম্পর্কে জানার নতুন পথ তৈরি করছে। ‘নেচার কেমিস্ট্রি’ জার্নালে নতুন উদ্ভাবিত পৃষ্ঠ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

বৃষ্টির দিনে বা পুকুরের পানিতে নামলেও হাঁস ভিজে যায় না
রয়টার্স

গবেষণা দলের গবেষক সাকারি লেপিকো বলেন, ‘আমরা প্রথমবারের মতো আণবিক পর্যায়ে ভিন্নধর্মী তল তৈরি করতে সরাসরি ন্যানোমিটার স্তরে কাজ করেছি। নতুন এই তল তৈরি করার জন্য একটি বিশেষ ধরনের চুল্লি বানানো হয়েছে। এই চুল্লির মাধ্যমে সেলফ অ্যাসেম্বেলড মনোলেয়ার বা এসএএমনির্ভর তল তৈরি হচ্ছে। নতুন উদ্ভাবিত সিলিকন উপাদানের গায়ে অণুগুলো সমযোজীভাবে আবদ্ধ থাকে। সাধারণ তরল অণু একসঙ্গে যেমন থাকে, সিলিকনের অণুগুলো এই তলে একইভাবে আবদ্ধ থাকে। একটি চুল্লির অভ্যন্তরে তাপমাত্রা ও পানি পরিমাণমতো নিয়ে সামঞ্জস্য তৈরি করে সিলিকনের মনোলেয়ার দিয়ে সিলিকন তল তৈরি করা হচ্ছে। আমরা এই উদ্ভাবনকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। চুল্লির মধ্যে সিলিকনের মনোলেয়ার বা অসাধারণ একটি স্তর তৈরি করছি আমরা।’

নিয়মিত পানির স্পর্শে নানা ধরনের তল সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে নানা জিনিসের কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে। নতুন উদ্ভাবন এই সমস্যা সমাধানে বেশ কার্যকর। নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে গবেষক দল বিশ্বের সবচেয়ে পিচ্ছিল তরল তল তৈরি করেছে। বিজ্ঞানীদের মতে, অনেক মাধ্যমে পানির ফোঁটাপ্রতিরোধী তলের প্রয়োজন হচ্ছে।

দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে নানা শিল্পে এই তল নতুন সুযোগ এনে দেবে। কঠিন তলকে আরও পিচ্ছিল করার উপায় নিয়ে কাজকর্মকে অনেকেই হাস্যকর মনে করেন। যদিও গবেষকেরা এসব ঠাট্টাকে গুরুত্ব দেন না। এর আগে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি গবেষক দল উদ্ভিদের ওপর প্রাকৃতিক মোমের আবরণের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। তাঁরা একটি ২.৫ মাইক্রোন পুরু আবরণ তৈরি করেন। সেই আবরণের ওপর কেচাপ, সস কিংবা শর্ষের মতো দানা পড়লেই স্লাইড করে সরে যায়। অন্যদিকে আল্টো ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা এর আগেও পানিপ্রতিরোধী প্রযুক্তি তৈরি করেছেন। ২০২০ সালে গবেষক দল একটি সুপারহাইড্রোফোবিক সারফেস তৈরি করেন। সেই পৃষ্ঠ চিকিৎসাক্ষেত্রে পানি সরানোর কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও অন্যান্য প্যাথোজেনের বিস্তার রোধ করে সুপারহাইড্রোফোবিক সারফেস।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান ও গিজমোডো