ইউক্যালিপটাসগাছের কারণেই কি উরুগুয়েতে পানি–সংকট
কাগজকে প্রায়ই প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে দেখা হয়। তবে কাঠ থেকে কাগজ তৈরির জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর পরিমাণ পানি। তাই কাগজ তৈরিতে পানির ব্যবহার কমানোর বিকল্প ও নতুন প্রযুক্তির সন্ধান করা হচ্ছে।
এ বছরের জুন মাসে উরুগুয়েতে বিশ্বের অন্যতম বড় কাগজের পাল্প কারখানা ‘ইউপিএম পাসো দে লস তোরোস’ চালু করা হয়েছে। এমনই এক সময় কারখানাটি চালু হয়, যখন উরুগুয়েতে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি খরা দেখা দিয়েছে। খরার মধ্যে বিশাল মিলে কাগজ তৈরির জন্য পানির ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওতে রেকর্ড পরিমাণ কম বৃষ্টি হয়েছে। তাই সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে নানা জায়গায়।
উরুগুয়ের ১২ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে ইউক্যালিপটাস বা পাইনগাছ রয়েছে। এসব গাছ দিয়েই কাগজ তৈরি করা হয় দেশটিতে। তবে ইউক্যালিপটাসগাছের বাগান মাটি থেকে প্রচুর পানি শোষণ করায় আশপাশের জমি শুকিয়ে যাচ্ছে। উরুগুয়েতে এ বছরের জুন মাসে সুপেয় পানির আধারে সংকট দেখা দেয়। সরকার রীতিমতো সুপেয় পানির আধার রক্ষায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ বছরের শুরুতে নদীর মোহনা থেকে পানি সরবরাহের চেষ্টা করলেও সফল হতে পারেনি তারা। দেশটিতে পানির অভাবে সাধারণ মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে। অভিযোগের তির যায় কাগজ তৈরির সেই কাঠ-পাল্প কারখানার দিকে। কাগজের কারখানার জন্য পানি আছে, মানুষের জন্য নেই—এমন অভিযোগ করছেন সবাই।
উরুগুয়ের বিভিন্ন পাল্প মিল ইউক্যালিপটাস ও পাইন কাঠকে সেলুলোজে পরিণত করে। পরে তা বিদেশে কাগজ তৈরি করার জন্য রপ্তানি করা হয়। পাসো দে লস তোরোসের নতুন কারখানা থেকে বছরে ২১ লাখ টন সেলুলোজ উৎপাদন করা হবে, যা উরুগুয়ের মোট সেলুলোজ উৎপাদনের দ্বিগুণ। এর ফলে দক্ষিণ আমেরিকার আরেক দেশ চিলিকে ছাড়িয়ে ১১তম বৃহত্তম কাগজ উৎপাদনকারী হিসেবে সামনে আসবে উরুগুয়ে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও চীনের মতো বড় দেশগুলোতে বিশাল কাগজ তৈরির কারখানা রয়েছে। প্রতিবছর নতুন নতুন শিল্পকারখানা তৈরি হচ্ছে। এসব কারখানায় কাঠ খণ্ড করে উচ্চ চাপে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড ও সোডিয়াম সালফাইড দিয়ে সেদ্ধ করা হয়। এ পদ্ধতিতে কাঠের লিগনিন দ্রবীভূত হলে সেলুলোজ ফাইবার সংগ্রহ করা হয়। তারপর সেলুলোজকে ক্লোরিন ডাই–অক্সাইড ও হাইড্রোজেন পারক্সাইড ব্যবহার করে ব্লিচ করা হয়। এ প্রক্রিয়ার জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইমরান হোসেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘পানির সংকট দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে বেশ প্রবল। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে গত দুই দশকে লাতিন আমেরিকায় প্রায় ৭৪টি খরার ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে ১ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। খরার কারণে কৃষির প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে, অনেক নদী শুকিয়ে গেছে। বিশ্বের ৩০ ভাগ সুপেয় পানির আধার লাতিন আমেরিকা অঞ্চলে। সেই এলাকায় পানির সংকট আসলে সারা বিশ্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।’
উরুগুয়ের নতুন কারখানাটি স্থানীয় রিও নিগ্রো নদী থেকে প্রতিদিন ১২ কোটি ৯০ লাখ লিটার পানি সংগ্রহ করে ব্যবহার করে। এরপর বর্জ্য পানি শোধন করে আবার নদীতে ফেলে দেয়। কারখানাগুলোতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি জলীয় বাষ্প পুনঃ ব্যবহার করা হয়। উরুগুয়ের পরিবেশবাদীরা পাল্প কারখানার পানি ব্যবহারের পাশাপাশি বর্জ্য পানির কারণে নদীদূষণ নিয়ে চিন্তিত। উরুগুয়ের গবেষণা গ্রুপ ল্যাটিটুডের বিজ্ঞানী ডায়ানা মিগেজ বলেন, ‘ফ্রে বেন্টোস কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পার্শ্ববর্তী উরুগুয়ে নদীর মাছের হরমোনকে প্রভাবিত করছে। আমরা এক হাজারের বেশি দেশীয় মাছের ওপরে জরিপ করেছি। পাল্প কারখানা থেকে আসা বর্জ্য পানির স্রোতের কারণে মাছের প্রজননক্ষমতা কমে যাচ্ছে।’
গত আগস্ট মাসে পাসো দে লস তোরোস প্ল্যান্ট থেকে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড দূষণ নিয়ে পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগ করা হয়। নদীর স্রোত, একটি হ্রদের মাছ আর আশপাশের গাছপালায় সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড পাওয়া গেছে। জলবায়ুবিজ্ঞানীরা উরুগুয়ের নদী রক্ষায় আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে। নতুবা কাগজশিল্প হয়তো বেঁচে থাকবে, কিন্তু পানি পানের জন্য মানুষ পাওয়া যাবে না।
সূত্র: বিবিসি