যেসব মজার উদ্ভাবন, গবেষণা এবারের আইজি নোবেল পুরস্কার পেল

২০০০ সালে আঁন্দ্রে গিম জীবন্ত ব্যাঙের ওপর চৌম্বকীয় প্রভাব নিয়ে গবেষণার জন্য আইজি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১০ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে সত্যিকারের নোবেল পুরস্কার জয় করেন।সায়েন্স টাইমস

প্রথমে হাসুন, পরে ভাবুন—এমন ভাবনা থেকেই ১৯৯১ সাল থেকে বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনে অপ্রচলিত গবেষণা, আবিষ্কারের জন্য পুরস্কার দেওয়া আইজি নোবেল পুরস্কার। নোবেল পুরস্কারের ব্যঙ্গ বা প্যারোডি হিসেবে আলোচিত হলেও আইজি (অনেকে ইগ উচ্চারণ করেন) নোবেলে সত্যিকারের আবিষ্কার ও উদ্ভাবনকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। চলতি বছরের আইজি নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে।

এক ওয়েবকাস্টে আইজি নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। সরাসরি সম্প্রচার করা এই অনুষ্ঠানে আসল নোবেল পুরস্কার পাওয়া ১১ জন বিজ্ঞানী উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ফ্রান্সিস আর্নল্ড (রসায়নে নোবেল বিজয়ী, ২০১৮), মার্টি ক্যালফি (রসায়ন, ২০১৮), এস্থার ডাফলো (অর্থনীতি, ২০১৯) ও জেরি ফ্রাইডম্যান (পদার্থবিজ্ঞান, ১৯৯০)। নিজ নিজ গবেষণা ক্ষেত্রে যুক্ত বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন তাঁরা।

জীবাশ্ম চেটে রসায়ন ও ভূতত্ত্বে পুরস্কার

২০১৭ সালে ‘ইটিং ফসিলস’ নামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। লেখক ছিলেন যুক্তরাজ্যের লেইচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্বিক গবেষক জ্যান জালাসেইভিকজ। তিনি জীবাশ্মযুক্ত পাথরকে জিহ্বা দিয়ে চেটে দারুণ সব আবিষ্কারের কথা লিখেছিলেন। জিব দিয়েই তিনি পাথর চেটে অনেক জীবাশ্মের খোঁজ পেয়েছেন। তার এই যুগান্তরী অভিজ্ঞতার জন্য তিনি রসায়ন ও ভূতত্ত্ব আইজি নোবেল পুরস্কার ২০২৩ পেয়েছেন।

সাহিত্যে উল্টো অনুভূতির পুরস্কার

দেজা ভ্যু শব্দটির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। অনেক সময় কোনো ঘটনা আমাদের সঙ্গে আগেও ঘটেছে বলে মনে হয়। অথচ ঘটেনি, এমন ঘটনাকে দেজা ভ্যু বলা হয়। এই বিষয়ের উল্টো ঘটনা হচ্ছে জেমাইস ভ্যু। অনেক সময় অনেক কিছু নিয়মিত দেখা হয়, কিন্তু হুট করে মনে হয় কখনই এমনটা দেখা হয়নি। এসব বিষয় নিয়ে গবেষকেরা শিক্ষার্থীদের ওপরে নিরীক্ষা চালান। যাঁরা দেজা ভ্যু বেশি অনুভব করেন, তাঁরাই নাকি জেমাইস ভ্যু বেশি অনুভব করেন। দুই ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক আছে বলে গবেষণায় দেখা যায়। যে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় তার শিরোনামে দেখা যায় চারবার ‘দ্য’ শব্দটি। এই অনুভূতি নিয়ে গবেষণার জন্য এ বছর সাহিত্যে আইজি নোবেল দেওয়া হয়েছে।

আইজি নোবেল পুরস্কার
সায়েন্স টাইমস

জনস্বাস্থ্যে টয়লেট পুরস্কৃত

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের গবেষক সিউং-মিন জনস্বাস্থ্যে এ বছরের আইজি নোবেল পেয়েছেন। তিনি ‘স্ট্যানফোর্ড টয়লেট’ নামে একটি শৌচাগার উদ্ভাবন করেছেন। মানুষের মলমূত্র সক্রিয়ভাবে পরীক্ষার সুযোগ করে দেয় বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি যুক্ত করা এই টয়লেট। ২০২০ সালে গবেষক সিউং-মিন এই টয়লেট উদ্ভাবন করেন।

যন্ত্র প্রকৌশলে মাকড়সা রোবট পুরস্কৃত

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফাই ইয়াপ ও তাঁর সহকর্মীরা যন্ত্র প্রকৌশলে আইজি নোবেল পেয়েছেন। তাঁরা উলফ স্পাইডার জাতের একটি মৃত মাকড়সাকে বায়ুচালিত রোবটে রুপান্তর করেন। এতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। এই গবেষণার মাধ্যমে নেক্রোরোবোটিকসের ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়েছে বলে আইজি নোবেলে সম্মাননা জানানো হয়েছে।

উল্টো করে কথা বলে যোগাযোগে আইজি নোবেল

যোগাযোগে আইজি নোবেল পেয়েছেন গবেষক মারিয়া হোসে টরেস-প্রায়োরিস ও তাঁর সহগবেষকেরা। স্পেনের লা লাগুনা অঞ্চলের অধিবাসীদের ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন তাঁরা। স্প্যানিশে শুভ রাত্রি হলো বুয়েনস নচেস। লা লাগুনা অঞ্চলের অধিবাসীরা এভাবে না বলে ‘নাসবুয়ে চেসনো’ বলে। এমন উল্টো করে কথা কথা বলার জন্য তারা ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পর্যন্ত দাবি করেছে। এভাবে কথা বললে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ে বলে গবেষকদের গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

নাকের লোমের বিন্যাস নিয়ে গবেষণা পেল চিকিৎসাবিজ্ঞানের পুরস্কার

মেডিসিনে এবার পুরস্কার পেয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, আরভিনের গবেষকেরা। বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলের মানুষের নাকের ভেতর লোমের বিন্যাস একই রকম কি না, এই ছিল গবেষণার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেসিডোনিয়া, ইরান ও ভিয়াতনামে গবেষণা করেছেন গবেষেকরা। ২০টি মৃতদেহের নাকের লোম নিয়ে গবেষণা করে গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষকেরা দেখেছেন গড়পরতা মানুষের নাকের বাম পাশে ১২০টি লোম ও ডান পাশে ১২২টি লোম থাকে। লোমের দৈর্ঘ্য দশমিক ৮১ থেকে ১ দশমিক শূন্য ৩৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত।

খাবারের নতুন স্বাদ পেতে বিদ্যুৎ!

এবারের পুষ্টিতে আইজি নোবেলে পুরস্কার পেয়েছেন মোমেই মিয়াশিটা ও হিরোমি নাকামুরা। তাঁরা ২০১১ সালে স্বাদ গ্রহণের জন্য নতুন এক পথ বের করেন। ক্যাটফিশের ‘সুইমিং টাং’ কৌশল কৃত্রিমভাবে তৈরি করে খাবারের স্বাদে নতুনত্ব আনেন এই দুই গবেষক। এ জন্য স্ট্র ও চপস্টিকে সহনীয় বিদ্যুৎ প্রবাহ ঘটিয়ে খাবার গ্রহণ করা হয়। ভোল্টেজ কমিয়ে–বাড়িয়ে খাবারের স্বাদে তারতম্য আনা হয়। একে তাঁরা বলছেন ‘বৈদ্যুতিক স্বাদ’।  

ক্লাস একঘেয়ে হয় কখন?

২০২০ সালে গবেষক ক্যাটি ট্যাম ও তাঁর সহকর্মীরা শিক্ষকদের উদাসীনতা ও শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণার বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁরা গবেষণায় দেখতে পান, শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যায়, যখন শিক্ষকেরা উদাসীন থাকেন। আবার যখন শিক্ষার্থীরা কোনোভাবে শিক্ষকের উদাসীনতা টের পান, তখন তাঁদের শেখার আগ্রহ কমে যায়। সেই গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ২০২৩ সালে আরেকটি যুগান্তকারী গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। গবেষণায় দেখা যায়, ক্লাসের কোনো বক্তৃতা সম্পর্কে আগে থেকেই একঘেয়ে মনে করলে ক্লাসে তা একঘেয়ে লাগে। এই গবেষণার জন্য ক্যাটি ট্যাম ও তাঁর সহকর্মীরা আইজি নোবেল ২০২৩ পুরস্কার পেয়েছেন।

চলতি পথের মনস্তত্ত্ব

অনেক বছর আগের একটি গবেষণা এ বছর মনোবিজ্ঞানে আইজি নোবেল পুরস্কার পেল।  যুক্তরাষ্ট্রের সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কে ১৯৬৯ সালে গবেষক স্ট্যানলি মিলগ্রাম, লিওনার্ড বিকম্যান ও লয়েরন্স বারকোভিজের করা গবেষণা এবার পুরস্কৃত হয়েছে। পথে হাঁটার সময় সামনের মানুষ ডানে তাকালে পেছনে থাকা অনেকে ডানে তাকান। আবার চলার পথে কেউ কোনো উঁচু ভবনের দিকে তাকিয়ে থাকলে অন্যরাও তাকান। কেন অপরিচিত মানুষকে চলতিপথে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলে তা মানুষ অনুসরণ করে—এই ছিল গবেষণার বিষয়।

অ্যানকোভি মাছের প্রজনন ক্রিয়া নিয়ে গবেষণা

ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটনের বিয়েতো ফার্নান্দেজ ক্যাস্ট্রো ও তাঁর সহকর্মীরা পদার্থবিজ্ঞানে পেয়েছেন আইজি নোবেল। তাঁদের গবেষণার বিষয় ছিল সাগরের পানি অ্যানকোভি নামের মাছের প্রজনন ক্রিয়ায় কী প্রভাব ফেলে।

আইজি নোবেলের ৩২ বছর

১৯৯১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈজ্ঞানিক  রম্য সাময়িকী (হিউমার ম্যাগাজিন) ‘অ্যানালস অব ইমপ্রোবাবল রিসার্চ’ আইজি নোবেল নামে এই সম্মাননা প্রদান করছে। মার্ক আব্রাহাম এই পুরস্কার চালু করেন। নোবেল পুরস্কারের প্যারোডি হলেও নোবেল পুরস্কারকে হেয় করা মূল উদ্দেশ্য নয়। এ পুরস্কারের মাধ্যমে এমন সব বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে স্বীকৃতি দেওয়া, যেগুলো ‘আগে মানুষকে হাসায়, পরে ভাবায়’।

করোনা মহামারীর আগে সরাসরি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্মাননা প্রদান করা হতো। গেল কয়েক বছর অনলাইনেই প্রদান করা হচ্ছে। এই ওয়েব ঠিকানায় ঠিকানায় পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানটি দেখা যাবে শিগগরই। হাস্যকর ও অদ্ভুত আবিষ্কার-উদ্ভাবনের জন্য আইজি নোবেল ও সত্যিকারের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এখন পর্যন্ত মাত্র একজন। স্যার আঁন্দ্রে গিম ও মাইকেল বেরি ২০০০ সালে জীবন্ত ব্যাঙের ওপর চৌম্বকীয় প্রভাব নিয়ে গবেষণার জন্য আইজি নোবেল পুরস্কার পান। আঁন্দ্রে গিম ২০১০ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে সত্যিকারের নোবেল পুরস্কার জয় করেন।
সূত্র: সায়েন্স টাইমস