পৃথিবীর গভীরে কী রয়েছে

পৃথিবীরয়টার্স

আপনার পায়ের নিচে কী? সহজ উত্তরে বলবেন, মাটি। তার নিচে কী? এভাবে যেতে থাকলে আমরা একসময় পৃথিবীর কেন্দ্রে চলে যাব তা–ই না? সেই কেন্দ্রের পরিবেশের কথা আমরা অনেকেই জানি। গলিত লাভা আর উত্তপ্ত এক পরিবেশ বিরাজ করছে সেখানে। সেই এলাকার অবস্থা নিয়ে নতুন এক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণায় জানা যাচ্ছে, পৃথিবীর কেন্দ্রের আশপাশে সব গলিত অংশ পৃথিবীর অংশ নয়। সেখানে বহুকালে আগে অন্য মহাজাগতিক বস্তুর অংশবিশেষ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির একদল বিজ্ঞানী বলছেন, প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে প্রাচীন প্রোটোপ্ল্যানেট থিয়া ও প্রোটো-আর্থের মধ্যে একটি বিশাল সংঘর্ষ ঘটেছিল। সেই সংঘর্ষে চাঁদের পাশাপাশি দুটি বিশাল মহাদেশ তৈরি হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। পৃথিবীর আবরণের মধ্যে এই অঞ্চলগুলো আটকা পড়েছে।

থিয়াকে সৌরজগতের একটি প্রারম্ভিক প্রাচীন গ্রহ হিসেবে মনে করা হয়। এর সঙ্গেই আদি-পৃথিবীর সংঘর্ষ হয়েছিল। সেই সংঘর্ষের ধ্বংসাবশেষ থেকেই চাঁদ তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। থিয়ার আকার মঙ্গল গ্রহের সমান ছিল বলে অনুমান করা হয়। সাধারণভাবে বলা যায়, থিয়া ঘুরতে ঘুরতে আদি পৃথিবীর সীমানায় চলে এলে পৃথিবীর ওপর আছড়ে পড়ে। আর এতে ধ্বংসাবশেষ নিয়ে চাঁদের বিকাশ ঘটে। আশির দশকে প্রথমবার বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর কেন্দ্রের গভীরে অস্বাভাবিক পদার্থের সন্ধান পান। দুটি মহাদেশ-আকারের এই ব্লককে বৈজ্ঞানিক ভাষায় ব্লব বলছেন তাঁরা। দুটি ব্লবের একটি আফ্রিকা মহাদেশের নিচে ও অন্যটি প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে রয়েছে। একেকটি ব্লব চাঁদের আকারের দ্বিগুণ। পৃথিবীর কেন্দ্র যেসব উপাদানে তৈরি, এসব ব্লব তার চেয়ে ভিন্ন উপাদানে তৈরি। এ বিষয়ে বিজ্ঞানী কিয়ান ইউয়ান বলেন, চাঁদের মতো উপগ্রহ ও মঙ্গল গ্রহের মতো বড় গ্রহগুলো তৈরির কোনো না কোনো পর্যায়ে এমন সংঘর্ষের মুখে পড়েছিল। আমরা গবেষণায় দেখেছি, প্রোটোপ্ল্যানেট থিয়া ও প্রোটো-আর্থের সঙ্গেও সংঘর্ষ হয়েছিল। গবেষণার জন্য সংগৃহীত নানা তথ্য কম্পিউটার সিমুলেশন ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।’

আফ্রিকা মহাদেশের নিচে ও অন্য একটি প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে প্রাপ্ত উপাদানগুলো আশপাশের আবরণের তুলনায় ২ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ বেশি ঘন। আবরণের এই অংশগুলো থিয়ার উপাদানকে প্রতিনিধিত্ব করে। থিয়ার ধ্বংসাবশেষ ১০ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পৃথিবীর প্রথম দিকের বিবর্তনের সময় এসব পদার্থের কী পরিণতি হয়েছিল, তা নিয়ে আরও অনুসন্ধান চলছে। সাংহাই অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরির গবেষক অধ্যাপক হংপিং ডেং বলেন, নতুন অনুসন্ধান পুরোনো ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। সংঘর্ষের কারণে পৃথিবী প্রথম দিকে আকৃতি পেতে শুরু করে বলে মনে করা হতো।

অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী অধ্যাপক স্টিভেন ডেশ বলেন, নতুন তথ্য বলছে, চাঁদ তৈরির আগেও পৃথিবীতে থিয়ার উপাদান থাকতে পারে। কোটি কোটি বছর ধরে থিয়ার অংশ পৃথিবীর ভেতরে ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছে বলা যায়। পৃথিবীর মধ্যে থিয়ার কোনো অংশবিশেষ এখনো যদি থাকে, তা ধীরে ধীরে পৃথিবীর কেন্দ্রে মিশে যাবে বা মুছে যাচ্ছে বলা যায়। কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবী ঘূর্ণনের মাধ্যমে নিজের কেন্দ্রে থিয়ার অংশগুলোকে গিলে ফেলছে। এটিই প্রথম গবেষণা, যা সেই ঘটনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এই গবেষণা দাবি করছে, থিয়ার অংশবিশেষ এখনো পৃথিবীর মধ্যে মূল-ম্যান্টল বা কেন্দ্রের সীমানায় অবস্থান করছে।

গবেষণাটি নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী অধ্যাপক এড গার্নেরো বলেন, ‘নতুন গবেষণা অনুসারে বলা যায়, পৃথিবীর ব্লব অন্য গ্রহের সংঘর্ষের অবশিষ্টাংশের সঙ্গে সংঘর্ষে আমাদের চাঁদ তৈরি হয়েছে। অন্য কথায়, বর্তমানে পৃথিবীর গভীরে থাকা বিশাল ব্লব আসলে বহির্জাগতিক বস্তুবিশেষ। পৃথিবীর মধ্যে সাধারণ কোনো ব্লব নেই, সব বহির্জাগতিক ব্লব আছে পায়ের নিচে। বিস্তৃত পরিসরের শিলা নমুনার সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের মাধ্যমে আরও গবেষণার সুযোগ রয়েছে। আদিম পৃথিবী, গাইয়া ও থিয়ার বস্তুগত গঠন ও কক্ষপথের গতিশীলতা অনুমান করতে পারছি আমরা। সৌরজগতের অভ্যন্তরীণ গঠনের ইতিহাসকে বোঝার চেষ্টা করছি। সৌরজগতের বাইরে এক্সোপ্ল্যানেটের গঠন ও বাসযোগ্যতা বোঝার জন্য এ গবেষণার ফল কাজে আসবে।’

সূত্র: ফিজিস ডট অর্গ