যে পত্রিকা বদলে দিয়েছে সিলিকন ভ্যালি

পেপ্যালের সহপ্রতিষ্ঠাতা পিটার থিয়েলছবি: রয়টার্স

সংবাদমাধ্যমের প্রভাব অনেক। ইতিহাস যেমন ধরে রাখে সংবাদপত্র, ঠিক তেমনি পত্রিকার পাতায় তৈরি হয় ভবিষ্যৎ। তিন দশকের বেশি সময় আগে একটি পত্রিকার যাত্রা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। সেই পত্রিকার হাত ধরেই বদলে গেছে সিলিকন ভ্যালির গতিপথ। ‘দ্য স্ট্যানফোর্ড রিভিউ’ নামের একটি পত্রিকা চালু করেন এই সময়ের আলোচিত প্রযুক্তি বিনিয়োগকারী পিটার থিয়েল।

পিটার থিয়েল মার্কিন শতকোটিপতি ও উদ্যোক্তা। সিলিকন ভ্যালি আর প্রযুক্তি–দুনিয়ায় বেশ শক্তিশালী এক নাম পিটার থিয়েল। তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশিষ্ট সমর্থকদের একজন ছিলেন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৯ সালে তিনি স্নাতক হন। ৩০ বছরের বেশি আগে সেই সময়ে ১৯৮৭ সালে স্ট্যানফোর্ডে পড়ার সময় একটি পত্রিকা চালু করেন পিটার। দ্য স্ট্যানফোর্ড রিভিউ নামের সেই পত্রিকার আরেক প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নরম্যান বুক। দ্য রিভিউ ক্যাম্পাস প্রকাশনা হিসেবে রক্ষণশীলতা ও উদারতাবাদ নিয়ে নানান লেখা প্রকাশ করত। দ্য রিভিউতে থিয়েলের নিজের নানান নিবন্ধ লিখতেন প্রথম এডিটর–ইন–চিফ হিসেবে।

থিয়েলের নেতৃত্বে দ্য স্ট্যানফোর্ড রিভিউতে যুক্ত অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থীর কারণে সিলিকন ভ্যালিনির্ভর বেশ বড় একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। তিন দশক ধরে এই নেটওয়ার্কের সদস্যরা কোটি কোটি ডলার মূল্যের বিভিন্ন স্টার্টআপ ও উদ্যোগ তৈরির সঙ্গে যুক্ত আছেন।

ফরচুন ম্যাগাজিনে এক সাক্ষাৎকারে পিটার বলেন, ‘আমরা তখন এত বড় কিছু কল্পনা করিনি। ১৯৮৭ সালে যাত্রা শুরু করে একটা পত্রিকা সিলিকন ভ্যালির বিশাল নেটওয়ার্ক হয়ে উঠবে, তা চিন্তার বাইরে ছিল। আমরা যারা লেখক ছিলাম, সবাই একই আদর্শের মানুষ ছিলাম না। আমাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সংযোগ ছিল, যার কারণেই আমরা পরস্পর যুক্ত হয়েছি। দ্য স্টানফোর্ড রিভিউ অনেক মানুষকে যুক্ত করেছে।’

ধারণা করা হয়, পত্রিকায় কাজ করেছেন বা লিখেছেন, এমন তিন শতাধিক প্রাক্তনি পিটার থেইল বা পত্রিকাসংশ্লিষ্ট কারও না কারও কাছ থেকে বিনিয়োগ পেয়েছেন। পত্রিকাটি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বাইরে তেমন আলোচিত নয়, কিন্তু সেই পত্রিকার লেখকদের নেটওয়ার্ক অনেক বড় হয়েছে ৩০ বছরে।

পিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পরও পত্রিকায় ভূমিকা রেখেছেন ও রাখছেন। তিন দশকের বেশি সময় ধরে রিভিউতে যুক্ত কর্মী ও লেখকদের নিয়ে নিয়মিত নৈশভোজের আয়োজন করেন। দ্য স্ট্যানফোর্ড রিভিউতে আরেক বিখ্যাত প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান পেপ্যালের সহপ্রতিষ্ঠাতা বা প্রাথমিক নির্বাহী যুক্ত ছিলেন। পিটার থিয়েলসহ ডেভিড স্যাকস, সুইডেনে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেন হাওরি নিয়মিত লিখতেন পত্রিকায়।

মার্কিন প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি কোম্পানি প্যালান্টিরের তিনজন প্রতিষ্ঠাতা লিখেতেন এই পত্রিকায়। আরেক মার্কিন প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডারস ফান্ডের বিনিয়োগকারী কিথ রাবোইস এই পত্রিকায় লিখতেন। ফেসবুকের প্রাক্তন প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা গিডিয়ন ইউ, ওপেন এআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট বব ম্যাকগ্রু দ্য স্ট্যানফোর্ড রিভিউতে লিখতেন। পত্রিকার সাবেক সম্পাদক জ্যাকসন আর্থিক প্রতিষ্ঠান পেপ্যালের শুরুর দিককার কর্মী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখন দেখতে পাই, আমরা কত বড় একটা নেটওয়ার্ক শুরু করেছিলাম। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পত্রিকার লেখকদের উপদেষ্টা কিংবা নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ করা হচ্ছে কয়েক বছর ধরেই।’

শুরুতে ছাপা পত্রিকা হিসেবে দ্য স্ট্যানফোর্ড রিভিউ আলোচিত ছিল। পরে ২০০২ সালে অনলাইনে যাত্রা শুরুর পর থেকে কিছুটা বিষয় সংকটে পড়ে এটি। পিটার যখন দ্য স্ট্যানফোর্ড রিভিউ শুরু করেন, তখন তিনি দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করতেন। দ্য স্ট্যানফোর্ড রিভিউতে আলোচিত ও বিতর্কিত নানা বিষয় নিয়ে লেখা প্রকাশ করা হতো।

আলোচিত মার্কিন রাজনীতিবিদ কন্ডোলিৎসা রাইস শিক্ষার্থী অবস্থায় কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হবেন, তা নিয়েই স্ট্যানফোর্ড রিভিউতে লেখা প্রকাশিত হতো নব্বইয়ের দশকে। পিটার থিয়েল ও তাঁর সহপ্রতিষ্ঠাতারা ১৯৯৮ সালে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান পেপ্যাল চালু করেন। সেই পেপ্যালের শুরুর দলে পত্রিকার নির্বাহী ও প্রাক্তন রিভিউ এডিটর–ইন–চিফ এরিক জ্যাকসন যুক্ত হন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও অ্যাপলের সিইউ টিম কুকের সঙ্গে পিটার থিয়েল (মাঝে)

পিটার ২০০৪ সালে একটি সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে বিনিয়োগ করেন। যাকে এখন আমরা ফেসবুক নামে চিনি। থিয়েল ও তাঁর পত্রিকার লেখকেরা শতাধিক প্রযুক্তি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন। লিংকডইন, লিফট, স্পটিফাই, এয়ারবিএনবি আর স্পেসএক্সের নাম নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। পেপ্যালের সহপ্রতিষ্ঠাতা পিটার থিয়েল বিভিন্ন গণমাধ্যম ধ্বংস করার জন্য টাইম ম্যাগাজিনের সমালোচনার মুখে পড়েন নিয়মিতই। এ ছাড়া কর প্রদান না করা ও রক্ষণশীল প্রযুক্তিনির্ভর শতকোটিপতি হওয়ার জন্য বিখ্যাত আবার সমালোচিত হন।

সাংবাদিক ম্যাক্স চাফকিন থিয়েলের জীবনীগ্রন্থ ‘দ্য কন্ট্রারিয়ান’ লিখেছেন। টাইম ম্যাগাজিনকে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি মনে করি, গোপনে গোপনে পিটার থিয়েল সিলিকন ভ্যালির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন। তিনি পর্দার পেছনের খেলোয়াড়। গত দুই দশকে সিলিকন ভ্যালিতে ঘটে যাওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পেছনে আছেন পিটার। ফেসবুক বিশ্বের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি। অনেক লোক মনে করে, ফেসবুক বিশ্বের জন্য খারাপ। ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গকে নিয়ে অনেক মানুষই সন্দেহ পোষণ করেন। সেই ফেসবুকের পেছনে পিটার থিয়েল যুক্ত আছেন। ফেসবুকে তিনিই প্রথম বাইরের বিনিয়োগকারী হিসেবে অর্থ দেন। তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি মার্ক জাকারবার্গকে তৈরি করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সাম্রাজ্যের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পরিণত করেছিলেন। মার্ক তো এখন অনেক বিশ্বনেতার চেয়ে বেশি শক্তিশালী।’

অনেক লোক ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে এখন উচ্ছ্বসিত। ক্রিপ্টোকে আপনারা পেপ্যালের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। ১৯৯০–এর দশকে পিটার থিয়েল স্পষ্টভাবে স্বাধীন অর্থনীতি চালুর কাজ করেছিলেন।

সূত্র: ফরচুন ও টাইম ম্যাগাজিন