সিলেট থেকে জীবনে প্রথমবারের মতো বিমানে চড়ে ঢাকায় এসেছেন এইচ এম রেদোয়ান আহমেদ। উপলক্ষ্য ফ্রিল্যান্সার সম্মেলন। বিয়ানীবাজারের চারখাই উত্তর ঘুলাঘাট গ্রাম থেকে আসা রেদোয়ানের গল্পটা একটু অন্য ধরনের। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি জানালেন, মাদ্রাসায় পড়েছেন, মসজিদে ইমাম হিসেবে চাকরি করেছেন—আর এখন একজন সফল ফ্রিল্যান্সার।
রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) আজ শনিবার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় ফ্রিল্যান্সার সম্মেলন। এ সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন ফ্রিল্যান্সাররা। এখানেই কথা হয় এইচ এম রেদোয়ান আহমেদের সঙ্গে।
সিলেটের সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ার সময় টিউশনির পাশাপাশি স্থানীয় মসজিদে ইমামতি করতেন তিনি। বেতন ছিল পাঁচ হাজার টাকা। এই ক্ষুদ্র আয় থেকে টাকা জমিয়ে গোপনে একটি পুরোনো ল্যাপটপ কেনেন রেদোয়ান। তারপর ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শেখার একটি কোর্স করেন। ক্লাস হতো রাতে, অনলাইনে। সে সময় ইন্টারনেট ব্যবহার সহজ ছিল না, আর তাই মসজিদের বাইরে পুকুরঘাটে ল্যাপটপ নিয়ে ক্লাস করতেন রেদোয়ান।
মসজিদের ইমাম সারা রাত পুকুরঘাটে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছেন, বিষয়টি ভালোভাবে গ্রহণ করতেন না অনেকেই। বিরূপ মন্তব্যও করতেন কেউ কেউ। কিন্তু কাজ শিখে স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, এই তাড়না রেদোয়ানকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
অনলাইনে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং কাজ দেওয়া–নেওয়ার ওয়েবসাইট (মার্কেটপ্লেস) ফাইভআরে ২০২০ সালে ৫ ডলারের প্রথম কাজ পান রেদোয়ান, কিন্তু ইংরেজি ভাষায় দুর্বলতার কারণে কাজটি হাতছাড়া হয়ে যায়। আর তাই ফ্রিল্যান্সিং শেখার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেন তিনি।
রেদোয়ান বলেন, ‘এর ফল পাই কয়েক মাসের মধ্যেই। লিংকডইন থেকে একটি কাজ পাই ১০০ ডলারের। কাজটি ক্লায়েন্টের এত পছন্দ হয় যে বাড়তি ৫০ ডলার টিপসও দেন।’
রেদোয়ান জানালেন, অনলাইনে এক মাসে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকাও আয় করেছেন। আর তাই নিজের টাকায় বিমানের টিকিট কেটে এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন তিনি। সম্মেলনে আসা ফ্রিল্যান্সারদের সঙ্গে কথা বলে বেশ অনুপ্রাণিত হয়েছেন রেদোয়ান। তাই সিলেট ফিরে ফ্রিল্যান্সিং শেখানোর একটি প্রতিষ্ঠান চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
সন্তান নিয়েও এসেছেন কয়েকজন নারী ফ্রিল্যান্সার
সম্মেলনে অনেক নারী ফ্রিল্যান্সার এসেছেন ছোট ছোট সন্তানকে নিয়ে। এমনই এক ফ্রিল্যান্সার জান্নাতুন নাঈম। বছর দশেক আগে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ শুরু করেন, বর্তমানে বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটপ্লেস থেকে প্রতি মাসে প্রায় দেড় লাখ টাকা আয় করছেন বলে জানালেন।
জান্নাতুনের অভিভাবকেরা চাইতেন মেয়ে স্বাবলম্বী হোক, কিন্তু বাইরে গিয়ে কাজ করলে তাঁরা নিরাপদ বোধ করতেন না। তাই ঘরে বসেই অনলাইনে ই-বুকের জন্য কনটেন্ট তৈরি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবস্থাপনা, ডেটা এন্ট্রির মতো বিভিন্ন ধরনের কাজ শুরু করেন জান্নাতুন। মেয়ে ঘরে বসেই স্বাবলম্বী হচ্ছে, বিষয়টি জানতে পেরে জান্নাতুনের পরিবারও বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে।
এখন তাঁর একটি ছোট্ট মেয়ে রয়েছে। তাকে দেখভাল করে রাত জেগে কাজ করা বিরাট চ্যালেঞ্জ হলেও পরিবারের সমর্থনে তিনি নিয়মিত অনলাইনে কাজ করছেন। ফ্রিল্যান্সার সম্মেলনে মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন জান্নাতুন নাঈম। তিনি বলেন, ‘এখানে এসে মনে হচ্ছে আমি একা নই, শত শত সহকর্মী খুঁজে পেয়েছি।’
ফ্রিল্যান্সার সুমাইয়ার সাফলে আনন্দিত স্বজনেরা
সম্মেলনকেন্দ্রে ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় অর্থনীতিতে মাস্টার্স করা সুমাইয়া আমিরের সঙ্গে। নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ক্যাম্পাসে সরকারের পরিচালিত লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং সেন্টারের বুথ দেখতে পান তিনি। সেখান থেকেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রাথমিক ধারণা নেন সুমাইয়া। সে সময় সুমাইয়াকে ফ্রিল্যান্সিং শেখার বিষয়ে অনেকেই ভুল তথ্য দিয়ে নিরুৎসাহিত করেন। কিন্তু দমে যাননি তিনি, বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ আর ইউটিউব ভিডিও দেখে ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিভিন্ন কাজ শেখেন।
এইসব ২০১৮ সালের কথা। এ সময় লেখাপড়ার পাশাপাশি সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের কারণে পরিবারের অনেকেই ফ্রিল্যান্সিং করতে নিরুৎসাহিত করেন সুমাইয়াকে। তখন নিজের সাফল্যের ছোট ছোট গল্প পরিবারের সবাইকে জানান তিনি। ২০২০ সালে প্রথম অনলাইন থেকে ২০ ডলার আয় করেন সুমাইয়া। এরপর অনলাইনে কোনো কাজের অর্ডার পেলেই পরিবারের সদস্যদের জানাতেন। ফলে অনলাইন কাজের ধরন বুঝতে পেরে পরিবারের সদস্যরাও সাহায্য করতে থাকেন সুমাইয়াকে।
সুমাইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন গড়ে দেড় লাখ টাকার মতো আয় করি। পরিবারের সবাই স্বপ্ন দেখতেন, আমি বিসিএস ক্যাডার হব। কিন্তু এখন তাঁরাই “ফ্রিল্যান্সার সুমাইয়া”কে নিয়ে আনন্দিত।’