বন্ধ হয়ে গেল আলোচিত বাংলা ব্লগসাইট ‘সচলায়তন’
প্রায় ১৭ বছর চলার পর বন্ধ হয়ে গেল একসময়ের জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ বাংলা কমিউনিটি ব্লগসাইট সচলায়তন। সচলায়তনের ওয়েবসাইটে ৯ মে সচলায়তন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের একটি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে বাংলা ব্লগ লেখার এই ওয়েবসাইটে এ পর্যন্ত প্রকাশিত সব লেখা বা কনটেন্ট পাওয়া ও পড়া যাবে। সাইটটিকে এখন ‘রিড-অনলি’ করে রাখা হয়েছে।
‘জরুরি: সচলায়তন অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কেবল পাঠ্য আকারে সংরক্ষিত হতে যাচ্ছে’ শিরোনামে ব্লগার সন্দেশ একটি ঘোষণা প্রকাশ করেছেন। এই ঘোষণায় লেখা হয়েছে ‘সচলায়তনের প্রিয় সদস্য ও অতিথিবৃন্দ, শুভ নববর্ষ। গত কয়েক বছরে সচলায়তনে লেখা আর মন্তব্যের স্রোত ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে এসেছে। সচলায়তনের কারিগরি ব্যয় কম নয়, আর এই ব্যয় কয়েকজন সদস্য ১৭ বছর ধরে বহন করে চলেছেন। সদস্য-অতিথিদের অনুৎসাহ বিবেচনায় নিয়ে আমরা সচলায়তনকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিশ্চল রাখতে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে আবারও যদি সময়-সুযোগ-সাধ্যের মেলবন্ধন ঘটে, সচলায়তন পুনরায় সক্রিয় হবে।’
চলতি শতাব্দীর প্রথম দশকে ‘সামহোয়্যার ইন ব্লগ’-এর মাধ্যমে অনলাইনে স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য বাংলায় ‘কমিউনিটি ব্লগ’ ধারার সূচনা হয়। এরপর ২০০৭ সালের ১ জুন থেকে চালু হয় বাংলা কমিউনিটি ব্লগ সচলায়তন। অনেকের কাছে এটি ‘সচল’ নামেও পরিচিত। চলতি শতকের প্রথম দশক ও দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এ ধারা ছিল বেগবান। পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে ব্লগ গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। সেই বাস্তবতায় সচলায়তন বন্ধ হলো।
নির্বাচিত লেখা দিয়ে গড়ে ওঠায় খ্যাতি পেয়েছিল সচলয়াতন। সামহোয়্যার ইন ব্লগের কয়েকজন ব্লগার মিলে সচলায়তন চালু করেন। সচলায়তনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হাসান মোরশেদ আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামহোয়্যার ইন ব্লগ দিয়ে বাংলা ব্লগিংয়ের যাত্রা শুরু হয়। একটা সময় আমরা বুঝতে পারলাম, এটি আসলে করপোরেট প্রতিষ্ঠান। তাই জনপ্রিয়তা এবং ব্লগে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ানো তাদের মূল উদ্দেশ্য। সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অনেক লেখা সেখানে প্রকাশ পেত। আবার স্বাধীনতাবিরোধী লেখাও সেখানে প্রকাশিত হতো। এ কারণে আমরা কয়েকজন লেখক ও ব্লগার নতুন একটি ব্লগসাইট প্রকাশের তাগিদ অনুভব করি। এখানে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সবাই একত্র হলাম। সচলায়তনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল মানসম্পন্ন অনলাইন অ্যাক্টিভিজম। সব লেখা বাছাই করে তবে প্রকাশ করা হতো। ব্লগ থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়ার দাবি বেগবান হয়েছিল।’
ব্লগের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া ও সচলায়তন বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুটি কারণ উল্লেখ করলেন হাসান মোরশেদ। এ কারণ দুটি হলো গণজাগরণ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে দোষারোপ করা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডিজিটাল কনটেন্টের ধরনে পরিবর্তন আসা। তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলনের পর অনেক ব্লগার বিদেশে চলে যান, অনেকে হুমকির মধ্যে পড়েন। ব্লগারদের নানাভাবে বিতর্কিত করে ফেলা হয়। ফলে স্বাধীনভাবে ব্লগ লেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অনেক লেখক-ব্লগার। ওদিকে ফেসবুক ও টুইটারের (বর্তমানে এক্স) জনপ্রিয়তার কারণে ভিডিও কনটেন্টের প্রতি মানুষ আগ্রহী হয়ে ওঠে। অনলাইনে প্রকাশিত লেখা পড়ার চেয়ে ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট দেখার প্রবণতা তৈরি হয়। এই ধাক্কায় ব্লগে লেখার হার কমে যায়।’
সচলায়তন বন্ধের আরেকটি কারণ আর্থিক বলে উল্লেখ করেন হাসান মোরশেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা শুরু থেকে সচলায়তনে বাইরের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নিইনি। নিজেরাই সাধ্যমতো খরচ করে ব্লগটিকে সচল রেখেছি।’ এর পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের ব্যক্তি ও পেশা জীবনে ব্যস্ততার বিষয়টিও রয়েছে। হাসান মোরশেদের ভাষায়, যখন শুরু করেছিলাম তখন আমরা ছাত্র ছিলাম। এরপর আমরা পেশাজীবনে ব্যস্ত হয়েছি, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছি।’
সচলায়তন শুরু হয়েছিল ৬-৭ জনের উদ্যোগে। পরে সমমনা আরও অনেকে এর পরিচালনায় যুক্ত হন। মানসম্পন্ন লেখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল সচলায়তন। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে সচলায়তনের আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) ঠিকানায় প্রবেশ কয়েক দিনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সচলায়তনের সাম্প্রতিক এই ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের একসময়ের তুমুল আলোচিত কমিউনিটি ব্লগ ধারার সমাপ্তি যেন শুরু হলো। তবে সামহোয়্যার ইন ব্লগ অনুল্লেখ্য পরিসরে এখনো চালু রয়েছে।