ওবায়দুরের স্মার্ট সেচব্যবস্থায় এখন যুক্ত অনেক কৃষক, যে সুফল পাচ্ছেন তাঁরা
২০২২ সালের ৫ নভেম্বর ‘কৃষিজমিতে সেচের পানির সমবণ্টন করতে ওবায়দুর রহমানের প্রযুক্তি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয় প্রথম আলোয়। এরপরই বিষয়টি সাড়া ফেলে দেশে ও বিদেশে। ওবায়দুর রহমান একই সঙ্গে ডেটা সায়েন্টিস্ট, বিপণনকর্মী ও উদ্ভাবক। তবে নিজেকে ডেটা সায়েন্টিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তিনি।
নিজের টেকগার্লিক লিমিটেড থেকে আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট ইরিগেশন সিস্টেম বানিয়েছেন ওবায়দুর। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সেচ মৌসুমে সব জমিতে ও কৃষকদের মধ্যে সেচের পানি সমবণ্টন করা। ২০২৩ সালে দুটি পুরস্কার পেয়েছে স্মার্ট সেচযন্ত্র। গত অক্টোবরে স্মার্ট বাংলাদেশ ২০২৩ পুরস্কার পায় ওবায়দুরের প্রযুক্তি। আর গত নভেম্বরে দক্ষিণ কোরিয়ায় এশিয়া-ওশেনিয়া অঞ্চলের তথ্যপ্রযুক্তি সংগঠনগুলোর সংস্থা অ্যাসোসিওর বার্ষিক সম্মেলনে ওবায়দুর পেয়েছেন ‘অ্যাসোসিও অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’।
ওবায়দুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলে এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছি কৃষকদের জন্য। আর এই খবর প্রথম আলোতে প্রকাশ হওয়ার পরপরই সাড়া ফেলে সারা দেশে। বাইরের দেশ থেকেও অনেকে যোগাযোগ করেন আমার সঙ্গে। অল্প দিনের ব্যবধানে দুটি পুরস্কার পেয়েছি, যা আমার কাজের ক্ষেত্রে উৎসাহ দেবে।’
ওবায়দুরের প্রযুক্তিটা আসলে কী? টেকগার্লিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ওবায়দুর রহমান বলেন, টেকগার্লিকের লক্ষ্য মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক মানুষের সমস্যার সমাধান করা। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে কৃষকদের মধ্যে যথাযথভাবে পানিবণ্টনের জন্য একটি আইওটিভিত্তিক যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। এটি ব্যবহার করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা প্রতিটি সেচপাম্প কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের আওতায় থাকবে। এই যন্ত্র স্থাপন করলে কৃষকেরা একটি স্মার্ট কার্ড ব্যবহার করে তাঁদের প্রয়োজনীয় পানির সরবরাহ পাবেন। এতে শুধু কৃষকের পানি সমস্যার সমাধান হবে তা নয়, এটি থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চাহিদা-জোগানের সমন্বয়, জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পানির যথাযথ বণ্টন করা যাবে।
এই স্মার্ট সেচব্যবস্থার কাজ হলো সেচপাম্প নিয়ন্ত্রণ করা। এই সিস্টেমে প্রত্যেক গ্রাহক, অর্থাৎ কৃষক, একটি করে প্রিপেইড কার্ড পাবেন। এই কার্ড ব্যবহার করে তাঁরা তাঁদের ভাগের নির্দিষ্ট পানি জমিতে নিতে পারবেন।
প্রিপেইড কার্ডের চিপে কৃষকের তথ্য থাকে (যেমন নাম, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, মুঠোফোন নম্বর ইত্যাদি)। কৃষকেরা কার্ডটি রিচার্জ করে পাম্প ব্যবহার করতে পারেন। কৃষকেরা যখন তাঁদের প্রিপেইড কার্ড স্মার্ট যন্ত্রে ব্যবহার করবেন, তখন তাঁরা যন্ত্রটির পর্দায় সব তথ্য দেখতে পাবেন। এরপর যখন তাঁরা যন্ত্রের ‘অন’ বাটনটি চাপবেন, পাম্প চালু হবে। স্মার্ট সেচযন্ত্র পানি সরবরাহ পর্যবেক্ষণ করে কার্ড থেকে অর্থ কেটে নেবে। কৃষকদের জমিতে সেচ সম্পন্ন হলে তাঁরা পাম্পহাউসে গিয়ে যন্ত্রটি ‘অফ’ করে দেবেন। পাম্পটি বন্ধ হয়ে যাবে। যদি একজন কৃষকের কার্ডে ভরা টাকা শেষ হয়ে যায়, তবে স্মার্ট সেচ সিস্টেম থেকে তাঁর মুঠোফোনে একটি সতর্কবার্তা (এসএমএস) পাঠানো হবে।
ওবায়দুর জানান, প্রতিবার ব্যবহার শেষে একজন কৃষক তাঁর মুঠোফোনে একটি বার্তা পাবেন। যেখানে থাকবে কত টাকা খরচ হয়েছে, পাম্প কতক্ষণ চলেছে এবং তাঁর কার্ডে কত টাকা রয়েছে—এমন তথ্য। ওবায়দুর বলেন, পরে একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা হবে। স্মার্ট সেচব্যবস্থার জন্য একটি ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনও তৈরি করা হবে, যেখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সব তথ্য দেখতে পাবেন। যেমন একটি এলাকায় কতগুলো পাম্প আছে, কতগুলো বর্তমানে চলছে এবং কোনো কৃষক কোন পাম্প কতটুকু ব্যবহার করছেন।
টেকগার্লিক লিমিটেড ২০২১ সালের শুরুর দিকে এই ‘স্মার্ট ইরিগেশন সিস্টেম’ নিয়ে কাজ শুরু করে। প্রথম ধাপে অভ্যন্তরীণ গবেষণা চালানো হয়। গবেষণায় সফলতার পর শুরু হয় মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা। এই পরীক্ষা চলাকালে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় উদ্ভাবকদের। অনেক প্রচেষ্টার পর ২০২২ সালের এপ্রিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার একটি পাম্পহাউসে প্রথম পরীক্ষা চালানো হয়। এই পরীক্ষা সফল হওয়ার পর টেকগার্লিক লিমিটেড পণ্যটির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ওই বছরের নভেম্বরে টেকগার্লিক লিমিটেড ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় আরও ৩৪টি পাম্পহাউসে এই প্রযুক্তি স্থাপন করে এবং প্রযুক্তিটি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কাছে প্রদর্শন করে। বর্তমানে ৩৪টি পাম্পে স্মার্ট ইরিগেশন সিস্টেম সফলভাবে চলছে। ৫০০ কৃষক এই প্রযুক্তি সরাসরি ব্যবহার করছেন।