প্রযুক্তিজগতের তারকা ও ধনকুবেরদের প্রেম–বিয়ের গল্প
মূল ধারার গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গেল কয়েক দিন এশিয়ার শীর্ষ ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানির ছেলের প্রাক্-বিবাহের অনুষ্ঠানের রাজকীয় আয়োজন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা দেখা যায়। মুকেশ আম্বানির ছোট ছেলে অনন্ত আম্বানি ও হবু পুত্রবধূ রাধিকা মার্চেন্টের প্রাক্-বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ভারতের গুজরাটের জামনগরে। টানা তিন দিন ধরে চলা এই অনুষ্ঠানে বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গসহ বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি উদ্যোক্তারাও অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে আছেন তথ্যপ্রযুক্তিজগতের অনেক তারকা; বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিদের তালিকায়ও আছেন অনেকেই। প্রযুক্তিজগতের তারকাদের বিয়ের আয়োজনও কি এমন জাঁকজমকপূর্ণ হয়? সাম্প্রতিক কালের আলোচিত কয়েকজন প্রযুক্তি তারকার বিয়ের গল্প শোনা যাক।
ইলন মাস্কের প্রেম ও বিয়ে
স্পেসএক্স ও টেসলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইলন মাস্ক। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৯০ দশকে জেনিফার গাউয়েনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। যদিও পরবর্তীকালে সেই সম্পর্ক আর টেকেনি। মাস্ক কানাডার অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জাস্টিন উইলসনের সঙ্গে পরিচিত হন। প্রথম দেখায় মাস্ক তাঁকে আইসক্রিম খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। ২০০০ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। ২০০২ সালে তাঁদের প্রথম সন্তান নেভাদার জন্ম হয়। ২০০৮ সালে জাস্টিনের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘোষণা করেন মাস্ক। পরবর্তী সময়ে মাস্কের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে অভিনয়শিল্পী তালুলাহ রাইলির। ২০১০ সালে স্কটল্যান্ডের ডরনচ ক্যাথেড্রালে জুটিবদ্ধ হন মাস্ক ও রাইলি। বেশ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনেই তাঁদের বিয়ে হয়। ২০১৬ সালে এই জুটির বিচ্ছেদ হয়। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ইলন মাস্কের সঙ্গে অভিনেত্রী অ্যাম্বার হার্ডের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ২০১৮ সাল থেকে গায়িকা গ্রিমসের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় মাস্কের। এই জুটি কবে কোথায় বিয়ে করেছেন, তা নিয়ে তেমন তথ্য জানা যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোয় মার্ক জাকারবার্গ ও প্রিসিলা চ্যানের প্রেম
মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তাঁর স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান। মার্ক ও প্রিসিলা একসঙ্গে ‘চ্যান জাকারবার্গ ইনিশিয়েটিভ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৩ সালে দুজনের প্রথম দেখা হয়। বিয়ে করেন ২০১২ সালে। ফেসবুকের শেয়ার বাজারে আসার পরদিনই তাঁরা বিয়ে করেন। এই দম্পতির তিন সন্তান—ম্যাক্সিমা, আগস্ট ও অরেলিয়া। একটি পার্টিতে দুজনের প্রথম দেখা হয়। সে সময় মার্ক ফেসম্যাশ নামের একটি নেটওয়ার্ক সাইট নিয়ে কাজ করছিলেন। ২০০৫ সালে মার্ক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা ছেড়ে দেন। যদিও চ্যান ২০০৭ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। ২০১১ সালে জাকারবার্গ ও চ্যান পাঁচ কক্ষের বাড়ি কেনেন ৭০ লাখ মার্কিন ডলারে। পালো আল্টো এলাকায় থাকতে শুরু করেন তাঁরা। ২০১২ সালের মে মাসে তাঁদের বিয়ের আয়োজন করা হয়। বিয়ের এক দিন আগে চ্যান মেডিকেল স্কুল থেকে সনদ অর্জন করেন আর ফেসবুকের শেয়ার বাজারে আসে। আমন্ত্রিত অতিথিদের গ্র্যাজুয়েশন পার্টির কথা বলে নিমন্ত্রণ করেন মার্ক। নিজেদের বাড়ির পেছনে সংক্ষিপ্ত আয়োজনে বিয়ে করেন মার্ক ও চ্যান। হানিমুন করতে ইতালির রোমে যান এই দম্পতি।
সের্গেই ব্রিনের রাজকীয় বিয়ে
২০০৭ সালে গুগলের সহপ্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিন তাঁর দীর্ঘদিনের বান্ধবী অ্যান ওয়াজসকিকে বিয়ে করেন। অ্যান জীবপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা। বাহামা দ্বীপে বিয়ে করেন ব্রিন ও অ্যান। বেশ লুকিয়ে বিয়ে করেছিলেন গুগলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ব্রিন। তাঁদের বিয়ের অনুষ্ঠানে ধর্মীয় ও স্থানীয় রীতির সমন্বয় ঘটতে দেখা যায়। প্রায় ৬০ জন বিশেষ অতিথি তাঁদের বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। ব্রিনের দুই বন্ধু বিয়ের অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। ব্রিন ও গুগলের আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজের মালিকানাধীন জেটলাইনারে চড়ে অতিথিরা বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজির হন। গণমাধ্যমের ধারণা অনুসারে, বেশ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন ব্রিন।
বিল গেটসের কন্যার বিয়ে
মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের বড় মেয়ে জেনিফার গেটস ২০২১ সালের অক্টোবরে বিয়ে করেন। তাঁর স্বামী নায়েল নাসার। নায়েল ও জেনিফারের পছন্দের বিষয় হচ্ছে ঘোড়দৌড়। সেখান থেকেই দুজনের পরিচয়। পারিবারিক আয়োজনেই তাঁদের বিয়ের আয়োজন করা হয়। মেয়ের বিয়ের ছবি ইনস্টাগ্রামে প্রকাশ করে মেয়ের উদ্দেশে বিল লেখেন, ‘তোমাকে বিয়ের দিন দেখতে পেয়ে আমি ভীষণ আনন্দিত। কোনো শব্দেই আমি আমাদের আনন্দ প্রকশ করতে পারছি না। আমি তোমাদের দুজনকে নিয়ে গর্বিত।’ নিউইয়র্কের ওয়েস্টচেস্টার কাউন্টিতে নিজের কেনা জমির ওপর বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন জেনিফার। অনুষ্ঠানে বাবা বিল গেটস, মা মেলিন্ডাসহ বন্ধুবান্ধবেরা উপস্থিত ছিলেন।
শেরিল স্যান্ডবার্গের বিয়ে খামারবাড়িতে
ফেসবুকের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) শেরিল স্যান্ডবার্গ। তিনি ১৯৯৩ সালে ব্রায়ান ক্র্যাফকে বিয়ে করেন। তাঁদের বিচ্ছেদ হয় ১৯৯৪ সালে। আরেক প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ডেভ গোল্ডবার্গকে শেরিল বিয়ে করেন ২০০৪ সালে। ডেভের মৃত্যু হয় ২০১৫ সালে। পরবর্তীকালে শেরিল ২০২২ সালে টম বার্নথালকে বিয়ে করেন। এই দম্পতি ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েমিংয়েল জ্যাকসনে ট্রেল ক্রিক খামারে (র্যাঞ্চ) বিয়ে করেন। বন্ধুবান্ধব ও প্রযুক্তি দুনিয়ার তারকারা তাঁদের বিয়েতে অংশ নেন। মার্ক জাকারবার্গকেও দেখা যায় বিয়ের আয়োজনে। এ ছাড়া সেরেনা উইলিয়ামস, আরিয়ানা হাফিংটনের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও হাজির ছিলেন।
ইভান স্পিগেল ও মিরান্ডা কেরের সাদাসিধে বিয়ে
ইভান স্পিগেল স্ন্যাপচ্যাটের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর স্ত্রী মিরান্ডা কের বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উপার্জনকারী মডেলদের একজন। কের ‘কোরা অর্গানিকস’ নামের স্বাস্থ্যকর খাবার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা৷ ২০১৪ সালে এক ফ্যাশন শোতে প্রথম তাঁদের দেখা হয়। ইভান স্পিগেল ও মিরান্ডা কের ২০১৫ সালে ডেটিং শুরু করেন। তাঁরা ২০১৭ সালের মে মাসে বিয়ে করেন। বিয়ের দিন কের ১৯৫৬ সালের মার্কিন অভিনেত্রী গ্রেস কেলির বিয়ের পোশাক অনুকরণ করেন। বেশ সাধারণ বিয়ের আয়োজন ছিল তাঁদের। বিয়ের দিন সকালে কের ইভানকে রান্না করে খাওয়ান বলে ভোগ ম্যাগাজিনকে জানিয়েছিলেন। নিজেদের লস অ্যাঞ্জেলেসের বাড়ির পেছনে ইভান ও কের বিয়ের মন্ত্র পড়েন। তাঁদের বিয়ের অনুষ্ঠানে মাত্র ৪০ জন অতিথি আমন্ত্রিত ছিলেন।
সেরেনা উইলিয়ামস ও অ্যালেক্সিস ওহানিয়ানের রোমান বিয়ে
অ্যালেক্সিস ওহানিয়ান মার্কিন জনপ্রিয় প্রশ্নোত্তরের সাইট রেডিটের সহপ্রতিষ্ঠাতা। আর সেরেনা উইলিয়ামস বিশ্বের অন্যতম সেরা টেনিস তারকা। ২০১৫ সালের মে মাসে রোমে প্রথম দেখা হয় এই জুটির। তখন থেকেই তাঁরা ডেটিং শুরু করেন। ২০১৬ সালের শেষের দিকে রোমে তাঁদের বাগদান হয়। ২০১৭ সালে তাঁদের প্রথম কন্যার জন্ম হয়। ওই বছরই তাঁরা বিয়ে করেন। বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল নিউ অর্লিয়ন্সে। নিজেদের স্বজন ও পরিচিত ব্যক্তিদের নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করেছিলেন তাঁরা। ভোগ ম্যাগাজিন তাঁদের বিয়েকে রূপকথার বিয়ের অনুষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করেছিল। তাঁদের বিয়ের অনুষ্ঠানে গায়িকা বিয়ন্সে, কিম কার্দাশিয়ানসহ অনেক তারকা বন্ধু উপস্থিত ছিলেন।
মারিসা মেয়ারের জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে
সার্চ ইঞ্জিন ইয়াহুর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মারিসা মেয়ার। তিনি ২০০৯ সালে সান ফ্রান্সিসকোর ট্রেজার আইল্যান্ডে আরেক উদ্যোক্তা জ্যাক বোগকে বিয়ে করেন। তিনি বিয়েতে ডিজাইনার নাঈম খানের নকশা করা পোশক পরেন। পোষাকটিতে তুষারকণার লেসে ক্রোশেটে ও এমব্রয়ডারির কাজ ছিল। ট্রেজার আইল্যান্ডে অনুষ্ঠানের পর আতশবাজির প্রদর্শনী হয়। অতিথিদের ফোর সিজন হোটেলে গলদা চিংড়ি ও ক্যারামেলাইজড গরুর মাংসে তৈরি খাবার পরিবেশন করা হয়।
গ্রিন কার্ড ছেড়েছিলেন সত্য নাদেলা
মাইক্রোসফট করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সত্য নাদেলা ১৯৯২ সালে বিয়ে করেন। পারিবারিকভাবে ভারতীয় আয়োজনেই বিয়ে করেন তিনি। তাঁর স্ত্রীর নাম অনুপমা। অনুপমা ও সত্যের বাবা আইএএস কর্মকর্তা ছিলেন। বিয়ের সময় সত্য নাদেলার গ্রিন কার্ড জমা দিতে হয়েছিল। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিন কার্ডধারী কেউ বিয়ে করলে তাঁর স্ত্রীর ভিসা বাতিল করা হতো। সেই আইনের কারণে গ্রিন কার্ড জমা দিয়ে সাধারণ ভিসায় স্ত্রী অনুপমাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসেন সত্য।সতীর্থকে বিয়ে করেন সুন্দর পিচাইগুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুন্দর পিচাই। তাঁর স্ত্রীর নাম অঞ্জলি পিচাই। অঞ্জলি ও সুন্দরের পরিচয় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (আইআইটি), খড়গপুরে পড়ার সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্লস হোস্টেলে প্রথম তাঁদের দেখা হয়। ভিন্ন বিষয় হলেও একই ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে ক্যাম্পাসে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁদের। সুন্দর মেটালার্জিক্যাল প্রকৌশল পড়তেন। স্নাতক শেষ বর্ষে সুন্দর অঞ্জলিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। পড়াশোনা শেষে সুন্দর যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। এর বেশ পরে তাঁরা বিয়ে করেন।
নারায়ণ মূর্তির মেয়ে অক্ষতার বিয়ে
ভারতের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইনফোসিসের সহপ্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি। তাঁর মেয়ে অক্ষতা মূর্তি। অক্ষতা ২০০৯ সালে ঋষি সুনাককে বিয়ে করেন। ঋষির সঙ্গে অক্ষতার পরিচয় হয় ২০০৪ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঋষি সুনাক বর্তমানে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। ভারতীয় ঢঙে ভারতে বিয়ে করেন এই জুটি।