বিল গেটস ও স্যাম অল্টম্যানের আড্ডা
অভাবহীন পৃথিবী নিয়ে দুশ্চিন্তা কেন
মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস সম্প্রতি ওপেনএআইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্যাম অল্টম্যানের সঙ্গে এক আড্ডায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ আর বর্তমানের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। ১১ জানুয়ারি সেই ভিডিও আড্ডা গেটস নোটসে প্রকাশ করা হয়। সেই আড্ডার চুম্বক অংশ থাকছে এখানে।
বিল গেটস: আমি সৌভাগ্যবান যে আপনার কাজের বিকাশ সরাসরি দেখছি। শুরুতে আমি বেশ সন্দিহান ছিলাম। আমি আশা করিনি, চ্যাটজিপিটি এত ভালো কাজ করবে। আমি এর কাজ দেখে চমকে গেছি। আমরা সত্যিই চ্যাটজিপিটির এনকোডিং বুঝতে পারিনি। আমরা সংখ্যা সম্পর্কে জানি। আমরা গুণ করতে পারি। কিন্তু শেক্সপিয়ার কীভাবে মস্তিষ্কে গেঁথে থাকে, তা আমরা জানি না। আপনার কি মনে হয় আমরা সব জানতে পারব?
স্যাম অল্টম্যান: শতভাগ পারব। মানুষের মস্তিষ্কে এমন কাজ করার চেষ্টা করা খুব কঠিন। মস্তিষ্কে নিউরন আছে, তারা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। সংযোগগুলো চলমান। আমরা মস্তিষ্ককে টুকরা টুকরা করে দেখতে যাচ্ছি না। কীভাবে বিকশিত হচ্ছে, তা দেখতে এক্স-রে ব্যবহার করতে পারি। ইন্টারপ্রেটাবিলিটি বা ব্যাখ্যার বিষয়টি নিয়ে খুব ভালো কাজ হয়েছে। আমি মনে করি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু হবে। আমি মনে করি, আমরা এই নেটওয়ার্ক বুঝতে সক্ষম হব। যদিও আমাদের বর্তমানে বোঝার মাত্রা বেশ কম। আমরা যা সামান্য বুঝতে পারছি, তা দিয়ে ধীরে ধীরে উন্নতি করছি। বৈজ্ঞানিক কৌতূহলকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সবাই সত্যিকার অর্থে বুঝতে অনুপ্রাণিত হচ্ছি। যদিও এগুলোর মাত্রা অনেক বিশাল। আমরা বলতে পারব, আপনার মস্তিষ্কের কোথায় শেক্সপিয়ার এনকোড করা আছে আর কীভাবে তা উপস্থাপন করা হয়।
বিল গেটস: বর্তমানে প্রযুক্তির ধারা কোন দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন?
স্যাম অল্টম্যান: আমি সব সময় মনে করি, আমরা এক দীর্ঘ ও লম্বা বক্ররেখার ওপর আছি। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) সিস্টেম রয়েছে, যা কিছু কাজ করতে পারে। এগুলো অবশ্যই চাকরির বিকল্প নয়, এআই সিস্টেম কাজ করতে পারে এবং সেখানে উত্পাদনশীলতা বাড়ে। ভবিষ্যতে এআই সিস্টেম আরও অনেক কিছু করতে সক্ষম হবে, যা আমরা আজ চাকরির মতো মনে করি। আমরা অবশ্যই নতুন চাকরি এবং আরও ভালো চাকরি খুঁজে পাব ভবিষ্যতে। আমি বিশ্বাস করি, মানুষকে শক্তিশালী যন্ত্র দিলে তাঁরা কেবলমাত্র একটু দ্রুত কাজ করতে পারেন, তা নয়। তাঁরা গুণগতভাবে বিভিন্ন কাজ করতে পারেন। এই মুহূর্তে হয়তো আমরা একজন প্রোগ্রামারের গতি তিন গুণ বাড়াতে পারি। আমরা এই গতি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত। এভাবে দারুণ ভালো কাজ করা যাচ্ছে। যদি একজন প্রোগ্রামারকে তিন গুণ বেশি কার্যকর করে তোলা যায়, তিনি তিন গুণ বেশি কাজ করার পাশাপাশি মস্তিষ্কের শক্তি অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারেন। তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস চিন্তা করতে পারবেন। এটা অনেকটা পাঞ্চ কার্ড থেকে উচ্চস্তরের প্রোগ্রামিং ভাষায় কাজের মতো। দ্রুত প্রোগ্রামিং করার মতো গুণগতভাবে নতুন কাজ করার সুযোগ দেয় এটা। আমরা সত্যিই তা–ই দেখছি। আমরা পরবর্তী ধাপে আরও কাজ করতে পারব। কল্পনা করুন, আপনার কোনো কর্মী আছেন, যাঁকে বলছেন, ‘যান আমার জন্য এই পুরো প্রোগ্রাম লিখে আনেন। আমি একই সঙ্গে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব। শুধু কয়েকটি ফাংশন লিখবেন না।’ তখন নতুন কাজ করার পাশাপাশি আরও জটিল কাজ করা যাবে। কোনো দিন হয়তো এমন একটি এআই আসবে, যাকে আপনি বলবেন, ‘যাও আমার জন্য এই সংস্থা পরিচালনা করো।’ তারপর একদিন এআইকে আপনি বলবেন, ‘যাও, নতুন পদার্থবিদ্যা আবিষ্কার করো।’ আমরা এখন যে জিনিস দেখছি, তা উত্তেজনাপূর্ণ ও বিস্ময়কর। আমি মনে করি, সব সময় প্রযুক্তিকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে। আগামী ৫ বছর বা ১০ বছরের জন্য উন্নতির বক্ররেখা খুব খাড়া বা উলম্ব হতে পারে। এখনকার মডেল সবচেয়ে দুর্বল মডেল হয়ে যাবে। কোডিং করার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো নিয়ে আমরা এখন সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত। মডেলগুলোর উন্নয়নের বাঁকারেখায় সামনে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা চলে আসবে। এসব নিয়েও আমরাও খুব উত্তেজিত।
বিল গেটস: আমার এখানে সব অতিথি নিজেদের পছন্দের গান নিয়ে আসেন। আপনার কাছে কী আছে?
স্যাম অল্টম্যান: আমি ‘দ্য নিউ ফোর সিজন-ভিভাল্ডি রিকম্পোজড’ নিয়ে এসেছি। এটি রচনা করেছেন ম্যাক্স রিখটার। আমি কাজ করার সময় কথাহীন সংগীত পছন্দ করি। ভিভাল্ডির পুরোনো গানে আরাম আছে। নতুন আয়োজনের গান আমার জন্য ভিন্ন অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে। এমন কিছু গান আছে, যা আপনার সঙ্গে শক্তিশালী মানসিক সংযুক্তি তৈরি করে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কোনো গান হয়তো আপনি অনেক শুনেছেন। ওপেনএআই শুরু করার সময় আমি ম্যাক্স রিখটারের সংগীত অনেক শুনেছিলাম। আমি মনে করি, এটি খুব সুন্দর সংগীত। আশাবাদী ধরনের সংগীত। নতুন সংস্করণটি বেশ দুর্দান্ত।
বিল গেটস: এখন এআইয়ের সঙ্গে আমি বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি। আপনি যদি অবিশ্বাস্য ক্ষমতা অর্জন করেন, তখন এআই, এজিআই (আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা), এজিআই+ নিয়ে তিনটি বিষয়ে আমার চিন্তা আছে। ধরুন, একজন খারাপ লোক সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ভালো লোক থাকলে শক্তিশালী সিস্টেম নিয়ে সমস্যা কমাতে পারেন। যে কারও সিস্টেম নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিছু কারণে আমি এ বিষয়ে কম উদ্বিগ্ন। আমি আনন্দিত যে আরও মানুষ আছেন। অন্য একধরনের দুশ্চিন্তা আমাকে বিভ্রান্ত করে। আমি ম্যালেরিয়া নির্মূলে কাজ করতে চাই। বুদ্ধিমান মানুষ ও সিস্টেম প্রয়োগ করে ভালো কিছু করতে চাই। যখন যন্ত্র আমাকে বলে, ‘বিল, পিকলবল খেলতে যাও, আমি ম্যালেরিয়া নির্মূল করেছি। তুমি তো একজন ধীরগতির চিন্তক।’ তখন পুরো বিষয়টি আমার কাছে দার্শনিক আঙ্গিকে বিভ্রান্তিকর মনে হয়। সমাজকে কীভাবে সংগঠিত করবেন? আমরা শিক্ষার উন্নতি করতে যাচ্ছি, শিক্ষা দিয়ে আমরা কী করব? যদি আপনি এমন কোনো চরম পর্যায়ে চলে যান, তখন তা বড় অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। আগামী ২০ বছরের মধ্যে এমন অবস্থা তৈরি হতে পারে। অভাবের জন্য আমাদের মন বেশ সংগঠিত থাকে। শিক্ষক ও চিকিৎসকের অভাব রয়েছে, ভালো ধারণার অভাব রয়েছে। আমি আশ্চর্য হচ্ছি, অভাব ছাড়া বড় হওয়া একটি প্রজন্ম সমাজকে কীভাবে সংগঠিত করবে? কী করতে হবে, তার দার্শনিক ধারণা খুঁজে পাবে কি না। হয়তো তারা সমাধান নিয়ে আসবে। আমি ভয় পাচ্ছি, আমার মন অভাবের কারণেই একটি আকার ধারণ করেছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
স্যাম অল্টম্যান: আমি নিজেও সেটা বলি। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, আমরা এখন অনেক কিছু ছেড়ে যাচ্ছি। আমরা দারুণ কিছু কাজ করছি। আমরা যদি অভাবহীন নতুন পৃথিবীতে প্রবেশ করতে পারি, তবে আমরা নতুন জিনিস খুঁজে পাব। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আলাদা কাজ করবে। ম্যালেরিয়া নিয়ে সমাধানের পরিবর্তে তারা হয়তো অন্য কোনো ছায়াপথ পছন্দ করে নতুন কিছু করবে। আমি আত্মবিশ্বাসী যে কখনোই সমস্যা ফুরিয়ে যাবে না। আমরা পরিপূর্ণতা খুঁজে পেতে কখনোই পথ হারাব না।
আপনি প্রায়ই কোন পরামর্শটা দেন?
বিল গেটস: প্রতিভার নানা রূপ রয়েছে। আমার কর্মজীবনের শুরুর দিকে আমি ভেবেছিলাম, শুধু আইকিউ, যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং আইকিউ আর্থিক ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। যা ছিল আমার জন্য বড় একটা ভুল। নানা দক্ষতার মানুষ নিয়ে দল তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদের সমস্যা নিয়ে ভাবতে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন দক্ষতার মানুষকে নিয়ে দল তৈরি করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের বলছি, গণিত ও বিজ্ঞান জানা দুর্দান্ত ব্যাপার। যদিও নানা মানুষের প্রতিভার সম্মিলন আমাকে সত্যিই অবাক করে। আপনি কী ধরনের পরমার্শ দেন?
স্যাম অল্টম্যান: বেশির ভাগ মানুষ ঝুঁকি নিয়ে ভুল অঙ্ক করেন। তাঁরা আসলে যে কাজটি করতে চান, তা করতে ভয় পান। আরামের কাজ ছেড়ে যেতে ভয় পান। বাস্তবে কোনো এক সময় জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়ে তাঁরা ভাবেন, এই কোম্পানি শুরু করতে চেয়েছিলাম আমি। আমি কখনো এআই গবেষক হওয়ার চেষ্টা করিনি। আমি মনে করি, এসব ভাবনা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। আপনি কী করতে চান, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। অন্যদের জিজ্ঞাসা করা পথ আশ্চর্যজনক দীর্ঘ হয়। অনেক মানুষ যা করতে চান না, তা করতে আটকা পড়েন। আমি পরামর্শ দিই, যেকোনো উপায়ে এটা ঠিক করার চেষ্টা করতে হবে।
বিল গেটস: আপনি যদি মানুষকে এমন চাকরিতে যুক্ত করেন, যেখানে তাঁরা মনে করেন যে তাঁদের কোনো একটি উদ্দেশ্য আছে। তাহলে তা বেশ মজার ভ্রমণ হয়। কখনো কখনো এভাবে তাঁরা বিশাল প্রভাব ফেলতে পারেন। এখানে আসার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। দারুণ আলাপ হলো। আমি নিশ্চিত বছরখানেক পর আমরা আরও কথা বলার সুযোগ পাব।
স্যাম অল্টম্যান: অনেক ধন্যবাদ আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। সত্যি খুব উপভোগ করলাম।
বিল গেটস: আমাকে বলবেন, আপনার প্রথম কম্পিউটার কোনটা ছিল?
স্যাম অল্টম্যান: একটি ম্যাক এলসি–২।
বিল গেটস: ভালো পছন্দ।
স্যাম অল্টম্যান: ভালোগুলোর একটি ছিল এটি। এখনো এটি আমার কাছে আছে। কম্পিউটারটি এখনো সচল।
সূত্র: গেটস নোটস