যে বার্তা দিয়ে গেলেন জিমি ওয়েলস
১২ ঘণ্টার বিমান যাত্রা। অথচ চেহারায় নেই কোনো ক্লান্তির ছাপ। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছেন, সেলফি তুলছেন। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসে ‘দারুন খুশি’ উইকিপিডিয়ার সহ-প্রতিষ্ঠাতা জিমি ওয়েলস। ২৬ ফেব্রুয়ারি ইন্টারনেটে মুক্ত বিশ্বকোষ বাংলা উইকিপিডিয়ার এক দশক পূর্তি উপলক্ষে উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ ও গ্রামীণফোন আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। সেখানে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
উইকিপিডিয়ায় নতুন যাঁরা নিবন্ধ যোগ করতে চান তাঁদের জন্য কী বার্তা দিতে চান? জিমি ওয়েলস জানালেন, ‘স্বাগতম, স্বাগতম তাঁদের। আমাদের কমিউনিটিতে দারুণ মানুষ আছেন যাঁরা নতুন বন্ধুদের অবশ্যই স্বাগতম জানাবেন। প্রথমে আমি বলব, আমি আমার সেই পুরোনো দিনগুলো খুব মিস করি। ইংরেজি উইকিপিডিয়ার পরিসর এখন এতটাই বড় আর বিস্তৃত যে, নতুনদের জন্য তাতে যুক্ত হওয়া কঠিন। সেখানে অনেক বিষয়ে লেখা আছে এবং অনেক কমিউনিটিতে ঢোকা কঠিন। কিন্তু বাংলা ভাষাভাষী তরুণদের জন্য কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। এখানে একটি ভালো কমিউনিটি রয়েছে। নিজের ভাষা নিয়ে সবার কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বাংলা উইকিপিডিয়া সমৃদ্ধ করতে তরুণরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। নতুনরা এগিয়ে আসুন। আপনাদের সাহায্যই আমাদের দরকার। তাঁদের আমাদের সঙ্গে পেলে ভালো লাগবে। ’
উইকিপিডিয়া এখন জ্ঞানভিত্তিক জটিল ওয়েবসাইট হওয়া স্বত্বেও দারুণ জনপ্রিয়। বিশ্বের জনপ্রিয় ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে উইকিপিডিয়া এখন ছয় নম্বরে রয়েছে। উইকিপিডিয়ার জনপ্রিয়তার নেপথ্যে কী কারণ রয়েছে? জিমি এই প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে এটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করছে। মানুষে এখন অনেক বিস্তৃত ব্যাকগ্রাউন্ড তথ্য জানতে চায়। অনেক সময় মানুষ কোনো খবর পড়ার পর তার পেছনের উত্সটাও জানতে চায়। উদাহরণ হিসেবে বলব, আমি একবার আজারবাইজানে গিয়েছিলাম। আপনারা হয়তো রেডিওতে আজারবাইনে কোনো ঘটনার কথা শুনতে পান। কিন্তু দেখা গেল সেই দেশটি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু আমরা জানি না। সেই দেশটি সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য তখন উইকিপিডিয়ায় গেলাম এবং প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে গেলাম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথাও। আমি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে খুব বেশি জানি না। আমি উইকিপিডিয়াতে গেলাম। আমি দুইটি রাজনৈতিক দল সম্পর্কে জানতে পারলাম। এ ধরনের বিষয়গুলো সহজেই উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়। আর এ কারণেই উইকিপিডিয়া মানুষের কাছে এত জনপ্রিয়।
উইকিতে বাংলা ভাষা এখন তৃতীয়!
বাংলা উইকিপিডিয়ার ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে একটি বক্তৃতা করেন জিমি ওয়েলস। তরুণদের উইকিপিডিয়া সমৃদ্ধ করার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি উইকিপিডিয়ার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন তিনি। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘নিবন্ধের মান অর্থাৎ বিষয়বস্তুর গভীরতা নির্ণয়ের একটি সূত্র আছে উইকিপিডিয়ার। সেই “ডেপথ” সূত্র অনুযায়ী উইকিপিডিয়ায় বাংলা ভাষার অবস্থান তৃতীয়। এর আগে আছে ইংরেজি ও মেসিডোনীয় ভাষা। ইন্টারনেটভিত্তিক এই বিশ্বকোষ এখন ২৮৭ টি ভাষায় প্রকাশিত হয়। ’
জিমি ওয়েলস বলেন, ‘২০ বছর পরের অবস্থা ভাবুন। ইন্টারনেটে সবাই তখন মাতৃভাষায় কথা বলবেন। এই গ্রহের যে কেউ যাতে বিনা মূল্যে ও মুক্তভাবে জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশ করতে পারে, সে জন্য প্রথম থেকেই উইকিপিডিয়া বৈশ্বিক। ’
জিমি ওয়েলস তার বক্তব্যে বলেন, ‘জ্ঞান আহরণের পথে বাধা হতে পারে এমন যেকোনো কিছু যেমন ক্রয়ক্ষমতা, ভাষা বা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় কনটেন্ট এর অভাব ইত্যাদি দূর করার জন্য আমাদের সকল সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। বাংলা উইকিপিডিয়ার ১০ বছর পূর্তি উদযাপনের অংশ হতে পেরে এবং সবার জন্য জ্ঞানের দুয়ার উন্মুক্ত করতে বাংলা উইকিপিডিয়ান, গ্রামীণফোন এবং উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ এর প্রচেষ্টা উদ্যাপন করতে পেরে আমি আনন্দিত। ’
এ অনুষ্ঠানে জিমি ওয়েলস ছাড়াও বক্তব্য দেন গ্রামীণফোনের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা অ্যালেন বঙ্কে ও উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের সভাপতি মুনির হাসান।
মুনির হাসান জানান, ‘গত ১০ বছর ধরে বাংলা উইকিপিডিয়াতে এমন অসাধারণ সব কনটেন্ট তৈরি হয়েছে যে এখন এটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভান্ডার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে কনটেন্ট এর পরিমাণ আরও বাড়ানো। আমরা তরুণদের নতুন প্রবন্ধ তৈরির জন্য উদ্বুদ্ধ করতে গ্রামীণফোনের সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমরা বেশ আনন্দিত। ’
উইকিপিডিয়া জিরো
অনুষ্ঠানে গ্রামীণফোনের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা অ্যালেন বঙ্কে বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা মাত্র দশমিক চার শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতো। সাশ্রয়ী মূল্য, নেটওয়ার্ক ব্যাপ্তি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং প্রাসঙ্গিক কনটেন্ট বৃদ্ধির কারণে ২০১৪ সাল শেষে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২.৭৬ মিলিয়নে। ২০১৯ সালের মধ্যে নিজস্ব নেটওয়ার্কের আওতায় ৫০ মিলিয়ন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে গ্রামীণফোন। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উদ্দেশ্যে গ্রামীণফোন ইন্টারনেট সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একাধিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে যার মধ্যে অন্যতম ছিল সকল গ্রামীণফোন ব্যবহারকারীদের জন্য বিনা মূল্যে উইকিপিডিয়া ব্যবহারের সুযোগ। ‘উইকিপিডিয়া জিরো’ নামের এই উদ্যোগটি নেওয়া হয় উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের সহায়তায়।
অ্যালেন বঙ্কে আরও বলেন, গ্রামীণফোন গ্রাহকদের জন্য বিন মূল্যে উইকিমিডিয়ার মোবাইল সাইটগুলো ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে। বর্তমানে বাংলায় আরও কনটেন্ট তৈরিতে উইকিপিডিয়ার সঙ্গে কাজ করছে গ্রামীণফোন। অধিক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তৈরিতে স্থানীয় ভাষার কনটেন্ট বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রবন্ধ লিখে সনদ ও পুরস্কার
আয়োজকেরা জানিয়েছেন, ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত বছর থেকে গ্রামীণফোনের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর সহযোগিতায় নানা রকম কার্যক্রম হাতে নেয় উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ। এর পরে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাসে এক হাজার ৬৮০ টি নিবন্ধ যোগ হয়েছে এই বিশ্বকোষে। অনুষ্ঠানে বেশি নিবন্ধ যোগ করার জন্য প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরস্কার পেয়েছেন শরীফ উদ্দিন, সজীবুর রহমান ও এম এম ছন্দ। প্রতিযোগিতার ১০ জন বিজয়ীকে উইকিপিডিয়া ও গ্রামীণফোনের পক্ষ হতে একটি ক্রেস্ট ও একটি প্রশংসাপত্র দেওয়া হয়। শীর্ষ তিন বিজয়ী পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন ম্যাকবুক প্রো, একটি এইচপি ল্যাপটপ এবং একটি আইপ্যাড এয়ার।
রবি ঠাকুরের কবিতা
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,/জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রার্থনা’ কবিতার এ পংক্তিগুলো বাংলা ও ইংরেজিতে উচ্চারণ করেন জিমি ওয়েলস। তিনি জানালেন, এটাই উইকিপিডিয়ার মূল সুর অর্থাৎ, এ লক্ষ্যে উইকিপিডিয়ার স্বেচ্ছাসেবকদের এগিয়ে যেতে আহ্বান জানালেন তিনি।
সবার জন্য ইন্টারনেট
অনুষ্ঠানে ‘সবার জন্য ইন্টারনেট মানে সবার জন্য জ্ঞানে প্রবেশ’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্যানেল আলোচনা সঞ্চালনা করেন অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের নীতিমালা উপদেষ্টা আনীর চৌধুরী। অংশ নেন টেলিনর গ্রুপের এশিয়া অঞ্চলের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স হাকন ব্রুয়াসেট জল, গ্রামীণফোনের হেড অব স্ট্র্যাটেজি এরল্যান্ড প্রেস্টগার্ড এবং এটুআইয়ের নীতিমালাবিশেষজ্ঞ (শিক্ষা) আফজাল হোসেন।
প্যানেল আলোচনায় আলোচকরা স্থানীয় ভাষায় কনটেন্ট তৈরির ওপরেই জোর দেন। ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার বাড়াতে এবং বাংলাদেশে নতুন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করতে বাংলা ভাষায় কনটেন্ট তৈরি জরুরি। এখন শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ইন্টারনেটে যে তথ্য রয়েছে তাতে খরচ বেশি হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য কম খরচে তথ্য ব্যবহারের সুবিধা কম। এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এগিয়ে আসতে হবে বলে আলোচনায় উঠে আসে।
আলোচনায় জিমি ওয়েলস খান একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত সালমান খানের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। জিমি বলেন, সালমান খান এই অনুষ্ঠানে থাকলে তিনি খুশি হতেন এবং সহজে তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য চ্যালেঞ্জ জানাতে পারতেন।
অনুষ্ঠানে জিপির কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশি ইন্টারনেট স্টার্টআপগুলোকে তুলে আনতে সাহায্য করবেন তাঁরা। এজন্য তাঁদের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়।
আবার দেখা হবে
১২ ঘণ্টা বিমানে করে বাংলাদেশের উইকিপিডিয়ার স্বেচ্ছাসেবকদের উৎসাহ দিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন জিমি ওয়ালেস। ‘দারুণ সময় কাটলো’ বলে সন্ধ্যায় লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে গেলেন জিমি ওয়েলস। বলে গেলেন, ‘আবার আসব। ’