করোনায় চীনের প্রথম ভ্যাকসিন দৌড়ে গেছে অনেক দূর
চীনা ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ক্যানসিনো প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষায় মিশ্র ফল এসেছে। এরপরও চীনা প্রতিষ্ঠানটি দেশে ও কানাডায় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
চিকিৎসা সাময়িকী ‘ল্যানসেট’–এ এই গবেষণাবিষয়ক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
বিশ্বের প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে গত ১৬ মার্চ থেকে কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী সার্স কোভ-২ সংক্রমণ ঠেকাতে ভ্যাকসিন গবেষণাকাজ শুরু করেছিল ক্যানসিনো। ১০ সপ্তাহেরও কম সময়ে বৈশ্বিক ভ্যাকসিন তৈরির প্রতিযোগিতায় আরও একবার প্রথম হলো চীনা প্রতিষ্ঠানটি। তারা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের নিরাপদ দিক ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা সৃষ্টিকারী দিক বিবেচনায় পিয়ার-রিভিউড জার্নালে তথ্য প্রকাশ করেছে।
ক্যানসিনোর ভ্যাকসিন জেনিটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারড অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করে, যাকে অ্যাডেনোভাইরাল ভেক্টর বলা হয়, যে জিনটি সারস-কোভ-২ স্পাইক প্রোটিনকে মানুষের কোষে এনকোড করে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ভ্যাকসিন থেকে উত্পন্ন স্পাইক প্রোটিনগুলো আমাদের প্রতিরোধব্যবস্থাটিকে কিছু টার্গেট অনুশীলন করতে দেবে, যাতে আমরা দ্রুত প্রকৃত ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করতে পারি।
তবে বিজ্ঞানীরা অ্যান্টিবডিগুলোর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করেন, যা কেবল স্পাইক প্রোটিনকে আটকে দেয় এবং সংক্রমণ প্রতিরোধকারী হিসেবে কাজ করে বা তথাকথিত নিরপেক্ষ অ্যান্টিবডি (নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি) হিসেবে তৈরি হয়। তাঁদের মতে, শরীরে নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ, যাতে ভাইরাসটি শরীরে জেঁকে বসতে না পারে।
ক্যানসিনো নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডির ঘনত্বকে পরিমাপ করেছে, যা মানবকোষকে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে প্রতিরোধ করে। এতে দেখা গেছে, যা বেশি মাত্রার ডোজ পেয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ ও যাঁরা মাঝারি ও স্বল্প মাত্রার ডোজ পেয়েছেন, তাঁদের ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।
স্ক্রিপস রিসার্চের ইমিউনোলজিস্ট ডেনিস বার্টন ব্যাখ্যা করেন, ‘সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য কোন স্তরের নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডির প্রয়োজন, তা কেউ জানে না। তবে ক্যানসিনোর ভ্যাকসিনে যে স্তর পাওয়া গেছে, তা কোনোভাবেই বিস্ময়কর নয়।’
ফিলাডেলফিয়ার উইস্টার ইনস্টিটিউটে অ্যাডেনোভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন তৈরি এবং অধ্যয়নরত বিজ্ঞানী হিলডেগুন্ড সিজে আর্টল বলেছেন, ‘এটি দুর্দান্ত নয়, তবে একেবারে কিছু না পাওয়ার চেয়ে এটা ভালো।’
আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, ক্যানসিনোর অতিরিক্ত ক্ষমতার ডোজ বিষাক্ত হতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকেরা। ৮১ ভাগ ক্ষেত্রে মাথাব্যথা, মাংসপেশি ব্যথা, জ্বরের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ক্যানসিনো নিরাপত্তার কথা ভেবে উচ্চ মাত্রার ডোজ বাতিল করেছে। গত এপ্রিল থেকে প্রতিষ্ঠানটির চলমান দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় ৫০০ জনের ওপর মাঝারি ও স্বল্প মাত্রার ডোজ পরীক্ষা চলছে।
ক্যানসিনোর তথ্য প্রকাশের পর গবেষকেরা অনেকটাই মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার ভ্যাকসিন পরীক্ষার প্রাথমিক তথ্য প্রকাশের পর সবাই উচ্ছ্বসিত ছিলেন।
গত ১৮ মে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানি মডার্না দাবি করে, তাদের প্রথম ধাপের পরীক্ষায় ৪৫ জনের প্রত্যেকের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে এবং যে ৮ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছ, তাঁদের নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। এতে মডার্নার শেয়ারের দাম বেড়ে যায়। তবে মডার্না তাদের গবেষণার তথ্য সাময়িকীতে প্রকাশ করেনি। এ বিষয়টির সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজেসের পরিচালক অ্যান্টনি এস ফসি।
সোমবার স্ট্যাট নিউজ প্রচারিত সাক্ষাৎকারে ফসি বলেন, ‘নিরপেক্ষ অ্যান্টিবডির দৃষ্টিকেোণ থেকে সংস্থাটির প্রাথমিক তথ্য খুব আশাব্যঞ্জক বলে মনে হচ্ছে। তবে তারা পূর্ণ তথ্য প্রকাশ না করে যেভাবে আগেভাগে শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে, সেটি আমার পছন্দ হয়নি।’
লোনকার ইনভেস্টমেন্টসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং একটি চীনা বায়োটেক বিনিয়োগ তহবিলের উদ্যোক্তা ব্র্যাড লোনকার বলেন, ‘চীন প্রথম প্রকাশ করেছে। এটি এমন একটি বিষয়, যা আমাদের খুব গুরুত্বসহকারে নেওয়া উচিত। অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে তারা ভ্যাকসিনের দৌড়ে জিততে চায়।’
অ্যাডেনোভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন তৈরির অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি ইমিউনিটিবায়ো। তারা বলছে, আগে থেকে বিদ্যমান ইমিউনিটি সমস্যাটি সমাধান করার বিশেষভাবে রূপান্তরিত অ্যাড-৫-এর একটি সংস্করণ ব্যবহার করবে তারা। যুক্তরাষ্ট্রে চলতি মাসেই এর পরীক্ষা শুরু হবে।
অ্যাড-৫-এর বিকল্প ব্যবহার করে অ্যাডেনোভাইরাল ভেকটর ভ্যাকসিন তৈরিতে দুটি প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন করছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে জনসন অ্যান্ড জনসন অ্যাড ২৬ ব্যবহার করছে। অ্যাস্ট্রোজেনেকা অক্সফোর্ডের গবেষকেদের সঙ্গে কাজ করছে। এটি যে অ্যাডেনোভাইরাস নিয়ে কাজ করছে, তা মূলত শিম্পাঞ্জিতে থাকে। এর উদ্দেশ্য মূলত অ্যাড-৫ সৃষ্ট নিট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি পরিহার করা, যা মূলত ক্যানসিনোর ক্ষেত্রে তাদের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমাতে পারে।
তবু কিছু পর্যবেক্ষক বলেন, ক্যানসিনোর ভ্যাকসিন মহামারিকে বিস্তার কমিয়ে আনতে কার্যকর হতে পারে। স্বাস্থ্যবান ও তরুণদের ক্ষেত্রে এ ভ্যাকসিনের বড় বাজার হতে পারে। লোনকার বলেন, একে গ্র্যান্ডস্লাম জয় বলা যাবে না। আবার উড়িয়েও দেওয়া যাবে না। একে সর্বোচ্চ মিশ্র প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে।