করোনার ভ্যাকসিন যেভাবে তৈরি হচ্ছে
রিসাস ম্যাকাকস। মুখটা গোলাপি। বাঁদরের এই বিশেষ প্রজাতির সঙ্গে মানুষের ডিএনএ–এর অনেক মিল। অক্সফোর্ডের পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনটা মানুষের শরীরে পরীক্ষা করার আগে বাঁদরের এই প্রজাতির ওপর পরীক্ষা করা হয়েছিল। ৬টি বাঁদরকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পর করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে রাখা হয় ২৮ দিন। এদের কারও শরীরেই করোনার আক্রমণ হয়নি। এই ফলাফল নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক।
অক্সফোর্ডের এই ভ্যাকসিনের মানবদেহের পরীক্ষাও এগিয়ে চলছে। ইতিমধ্যে আট শ জনকে পরীক্ষার জন্য বাছাই করা হয়েছে। কয়েক শ মানুষের শরীরে ইতিমধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই প্রাথমিক ফলাফল জানা যাবে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে ব্রিটিশ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি অ্যাস্ট্রা জেনিকার সঙ্গে ব্যাপক হারে ভ্যাকসিন উৎপাদন এবং সরবরাহের জন্য চুক্তি করেছে। মানবদেহে পরীক্ষা সফল হলে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ১০ কোটি মানুষের শরীরে দেওয়ার জন্য উৎপাদন শুরু হবে। উৎপাদন খরচটাই দাম হিসেবে নির্ধারণ করা হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১০০টির মতো ভ্যাকসিন গবেষণায় বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৬টি মানবদেহে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে। ভ্যাকসিন গবেষণার অতীতের সাফল্যের নিরিখে বলা যায় ১০০টির মধ্যে হয়তো ৬–৭টি ভ্যাকসিন কার্যকর হতে পারে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এত দ্রুত ভ্যাকসিন তৈরি এবং মানবদেহে প্রয়োগের এমন নজির আর নেই।
পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন গুলোতে মোটামুটি দুই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাইরাসের অতি ক্ষুদ্র একটি দুর্বল অংশ শরীরে প্রয়োগ করে ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধী অংশকে সক্রিয় করা এবং ওই ভাইরাসকে মনে রাখা। যাতে করে পরবর্তীতে সত্যিকার আক্রমণ ঠেকানো যায়। এটি প্রচলিত পদ্ধতি। বাজারের অধিকাংশ ভ্যাকসিন এই পদ্ধতিতে তৈরি।
বিশ্বের অধিকাংশ ভ্যাকসিন তৈরির কারখানাগুলো এই পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম। নিরাপদ উৎপাদনে পদ্ধতি এবং পরীক্ষার সম্যক ধারণা রয়েছে তাদের। এই পদ্ধতিতে তৈরি ভ্যাকসিনগুলো ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ঠিক থাকে। কিন্তু সমস্যা একটাই উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণ কাঁচামালের দরকার। পরিমাণটা শুনবেন? একজনের শরীরে দেওয়ার জন্য ভ্যাকসিন বানাতে এক টনেরও বেশি কাঁচামাল লাগে। বুঝতেই পারছেন এই পদ্ধতিতে উৎপাদনের সময়টা একটু বেশি লাগে। অক্সফোর্ডের পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনটা এই পদ্ধতিতে তৈরি।
দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো আরএনএ এবং ডিএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ভাইরাসের ক্ষুদ্র অংশ বা অ্যান্টিজেন ভ্যাকসিন হিসেবে দেওয়া হয় না। ওই ক্ষুদ্র অংশ তৈরির জন্য সংকেতটিকে পাঠানো হয় শরীরে। শরীর তখন এই অ্যান্টিজেন তৈরি করতে থাকে। কার্যকরী হয় আমাদের প্রতিরোধী ব্যবস্থা। আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা মনে রাখে এই ভাইরাসের ধরন। যাতে করে ভবিষ্যতে আমাদের শরীরে এই ভাইরাস আক্রমণ করলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।
নতুন এই আরএনএ প্রযুক্তিতে এখন পর্যন্ত কোনো ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি। এই ভ্যাকসিনের উৎপাদন ব্যয় বেশ কম। খুব অল্প পরিমাণ ওষুধে কাজ হয়। তবে ব্যাপক হারে উৎপাদন করতে নতুন কারখানা তৈরি করতে হবে। প্রশিক্ষণ দিতে হবে ভ্যাকসিন উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের। এই ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করার জন্য দরকার হবে -৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। বুঝতেই পারছেন বিশ্বের অনেক দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই ভ্যাকসিন পৌঁছে দেওয়া আর একটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
একই সঙ্গে এত বেশি সংস্থার পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য সমন্বয় প্রয়োজন। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়ে থাকে হাসপাতালে। দরকার হয় নার্স, চিকিৎসক, ডেটা ম্যানেজারসহ বিজ্ঞানের অন্য শাখায় দক্ষ মানুষের। বিশেষ প্রশিক্ষণ না থাকলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কাজ করা যায় না। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের হাসপাতালগুলো করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে ব্যস্ত। এর পাশাপাশি একাধিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য অবকাঠামো এবং জনবল সরবরাহ করাটা বেশ কঠিন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সমস্যা সমাধানের একটা প্রস্তাব করেছে। একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে একে একে পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনগুলো পর্যায়ক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই পদ্ধতিকে আমরা বলি অ্যাডাপটিভ ট্রায়াল। এর সুবিধা হলো যে ভ্যাকসিনটা কাজ করবে না সেটা বাদ দেওয়া হবে। নতুন ভ্যাকসিন পরীক্ষার আওতায় আনা হবে। এতে করে সময় ও অবকাঠামোর সবচেয়ে সাশ্রয়ী ব্যবহার হয়।
কীভাবে? আলাদাভাবে ট্রায়াল শুরু করতে প্রত্যেক কোম্পানিকে পরীক্ষার বিস্তারিত বিবরণ আলাদাভাবে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হয়। এতে সময়ের দরকার। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এই পরীক্ষা পদ্ধতি পর্যালোচনা করে অনুমতি দেয়। এরপর ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী কোম্পানি হাসপাতালে নার্স ও ডাক্তারদের নিয়োগ দেয়। এসবের জন্য অনেক সময় প্রয়োজন। স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে কম সময়ে অনেক সংখ্যক পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রমাণ পাওয়া সম্ভব। এতে করে কার্যকারিতার দ্রুত প্রমাণ দেবে এমন ভ্যাকসিনে স্বল্পতম সময়ে অনেক স্বেচ্ছাসেবীদের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। করোনা ভ্যাকসিনের পরীক্ষার একটা বড় সমস্যা হচ্ছে যে সব দেশে পরীক্ষা হচ্ছে সেখানে সংক্রমণের একটা স্বাভাবিক হার থাকতে হবে। তা না হলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষা সম্ভব নয়।
বিশ্বব্যাপী করোনার প্রকোপ রুখতে প্রাথমিকভাবে ৭০০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দরকার। একটা ভ্যাকসিন যদি ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কাজ করে তাহলেও করোনাকে রুখে দেওয়া যাবে। পাঠক বলে রাখি, গুটি বসন্ত ছাড়া শতভাগ কার্যকরী অন্য কোনো ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি।
৭০০ কোটি ডোজের ভ্যাকসিনের উৎপাদনের জন্য বিশ্বব্যাপী সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন। প্রয়োজন সমন্বয়ের। আর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া। একমাত্র ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে এটি সম্ভব। সে পর্যন্ত ভালো থাকবেন আর বিজ্ঞানের ওপর আশা রাখবেন।
সুব্রত বোস: প্রবাসী বাংলাদেশি ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়ালস অ্যানালিটিকসের গ্লোবাল প্রধান।
লেখকের আরও লেখা