করোনার ওষুধ তৈরিতে কোমর বেঁধে নেমেছে কোম্পানিগুলো
করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারি রুখতে কার্যকর চিকিৎসা খোঁজার কাজ চলছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। প্রতিদিনই নতুন ওষুধ কোম্পানি, সরকারি বা আধা সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আর দাতব্য সংস্থাগুলো তাদের একক বা যৌথ উদ্যোগের কথা ঘোষণা করছে।
ভাইরাসজনিত মহামারি রুখতে দুই ধরনের ওষুধ দরকার। প্রথমটা ভ্যাকসিন। এর কাজ হচ্ছে সুস্থ মানুষের শরীরে ওই বিশেষ ভাইরাসপ্রতিরোধী সক্ষমতা গড়ে তোলা, যাতে তারা সংক্রমণ এড়াতে পারে। দ্বিতীয়টা হলো ট্রিটমেন্ট বা চিকিৎসা। যাদের শরীরে সংক্রমণ ঘটেছে, তাদের দ্রুত সুস্থ করে তোলা। শরীরে ভাইরাস যাতে দ্রুত বংশবৃদ্ধি না করতে পারে, সেটা ঠেকানো। ভাইরাস দ্রুত বাড়তে না পারলে মানুষের শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধী ক্ষমতাই ভাইরাসকে পরাস্ত করার জন্য যথেষ্ট। তবে এখানেই শেষ নয়, শরীরে জীবাণু প্রবেশ করলে অনেক সময় শরীরের রোগপ্রতিরোধী ক্ষমতা অধিক মাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা যেখানে জীবাণুর সন্ধান পায়, সেখানে হাজার হাজার শক্তিশালী সেনা বা অ্যান্টিবডি পাঠাতে থাকে। ধরুন, সংক্রমণের স্থান ফুসফুস, সেখানে যদি হাজার হাজার অ্যান্টিবডি গিয়ে ভিড় জমায়, তাহলে শ্বাসনালি সংকুচিত হয়ে যায়। ইমিউন সিস্টেমের এই অতি সক্রিয়তা ঠেকাতেও ওষুধের দরকার। এদের বলা হয় অ্যান্টি লিউকিনস। করোনা ঠেকাতে উল্লিখিত এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে ওষুধের নানা পরীক্ষা চলছে। বিশ্বের ৪০টির বেশি ওষুধ পরীক্ষার নানা পর্যায়ে রয়েছে। অ্যান্টিভাইরাল, অর্থাৎ, আক্রান্ত লোকজনের চিকিৎসার জন্য যে ওষুধ দরকার, মানবদেহে সেগুলোর পরীক্ষা প্রায় শেষ পর্যায়ে। কয়েকটার ফলাফলও আসতে শুরু করেছে। আর প্রতিরোধী ভ্যাকসিন পেতে ছয় মাস থেকে এক বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে।
বিশ্বের ক্লিনিক্যাল ট্রায়েলের ডেটা বেসের পরিসংখ্যান বলছে, ৪০টির বেশি ভ্যাকসিন মানব শরীরের পরীক্ষার জন্য নিবন্ধিত হয়েছে। করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার কাজ অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে চীন। এ বছরের শুরুতে ভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্স তারা পৃথিবীর সব বিজ্ঞানীর জন্য উন্মুক্ত করে দেয়।
ভ্যাকসিন বানানোর জন্য কৃত্রিম উপায়ে গবেষণাগারে ভাইরাস তৈরি অত্যন্ত জরুরি। এতে করে ভাইরাসটি কীভাবে মানুষের দেহে প্রবেশ করে, শরীরের বিভিন্ন অংশের স্বাভাবিক কার্যক্রম নষ্ট করে, সেগুলো জানা যায়।
চীনকে অবশ্যই তাদের এই উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছিলেন, পরবর্তী মহামারি ফ্লুতেই হবে। সে জন্য করোনাভাইরাসের সঙ্গে মিল আছে এবং ভাইরাস প্রতিরোধ করার মতো বেশ কিছু ভ্যাকসিনের নমুনা অনেকের কাছে ছিল।
করোনা ভাইরাসের জেনেটিক গঠনের সঙ্গে সার্স ভাইরাসের প্রায় ৯০ শতাংশ মিল রয়েছে। ২০০২-০৪ সালে সার্সের সংক্রমণ হয়েছিল চীনে। যে কোম্পানিগুলো সার্স নিয়ে কাজ করেছিল, করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতে তারা এগিয়ে রয়েছে।
আমেরিকার কোম্পানি মর্ডানা ইতিমধ্যে সুস্থ মানুষের শরীরে তাদের ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ শুরু করেছে। উদ্দেশ্য, প্রতিক্রিয়া দেখা। এরপর এটি করোনায় আক্রান্ত মানুষের মধ্যে দেওয়া হবে। জনসন অ্যান্ড জনসন আমেরিকার বেথ ইসরায়েল মেডিকেল সেন্টারের সঙ্গে যৌথভাবে ভ্যাকসিন তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। এ বছরের শেষে মানবদেহে এর ট্রায়াল বা কার্যকারিতা পরীক্ষা শুরু হবে। ইনোভিয়ো ফার্মাসিউটিক্যালস চীনের একটি বায়োটেকনোলজি কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে আগামী মাসে মানবদেহে পরীক্ষা শুরু করবে। চীন-কোরিয়া ও আমেরিকায় এই পরীক্ষা চালানো হবে। ইতিমধ্যে ১০ লাখ ভ্যাকসিন ডোজ এই বছরের শেষ নাগাদ তৈরির প্রস্তুতি রয়েছে এই কোম্পানির।
হিট বায়োলজিকস এবং ইউনিভার্সিটি অব মিয়ামি যৌথভাবে ভ্যাকসিন তৈরির কথা জানিয়েছে। তাদের একটি পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন ইতিমধ্যে জিকা ভাইরাসের আক্রান্ত মানুষের মধ্যে ভালো ফল পাওয়া গেছে। জার্মান বায়োটেকনোলজি কোম্পানি কিউয়রভ্যাক ভ্যাকসিন তৈরির কাজ করছে। দুই মাসের মধ্যেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হবে। এই সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৮০ মিলিয়ন ইউরো অনুদান দিয়েছে কিউয়রভ্যাক কোম্পানিকে। জার্মান ধনকুবের ডিটার হগ এবং গেটস ফাউন্ডেশন এর আগেই করোনা ভ্যাকসিন তৈরির জন্য এই কোম্পানিকে সহায়তা করেছে।
তা ছাড়াও আরও বেশ কিছু বায়োটেকনোলজি কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো যোগ দিয়েছে ভ্যাকসিন তৈরির কাজে। মানবদেহে এ পরীক্ষা সফল হলে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হবে সারা বিশ্বের মানুষের জন্য কম সময়ে এগুলো তৈরি করা। আশার কথা হলো, অনেক কোম্পানি ঘোষণা দিয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভ্যাকসিন উৎপাদনে তাদের প্রতিষ্ঠানকে সে পর্যায়ে উন্নত করবে। মনে রাখা দরকার, ব্যাপক হারে ভ্যাকসিন তৈরি বিপণনে ভবিষ্যতে ছোট-বড় ফার্মাসিউটিক্যালস, সরকারি এবং দাতব্য সংস্থাগুলোর যৌথভাবে কাজ করতে হবে। ভ্যাকসিন তৈরি, সরবরাহ এবং মজুত করার জন্য অনেক মানদণ্ড মানতে হয়।
এবার আসি অ্যান্টিভাইরাল ট্রিটমেন্ট প্রসঙ্গে। অর্থাৎ, আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ করে তোলা। বাজার আছে এমনকি বেশ কয়েকটি অ্যান্টিভাইরাল এজেন্ট ইতিমধ্যে করোনা-আক্রান্ত মানুষকে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল প্রায় শেষের দিকে।
এই ওষুধ বাজারে ছিল অন্য রোগের চিকিৎসার জন্য, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও জানা ছিল। সেই জন্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে শরীরে এগুলো একেবারে প্রয়োগ করা গেছে। সবচেয়ে বড় ট্রায়াল চলছে এইডসের ওষুধ রেমডেসিভির দিয়ে। বিভিন্ন মাত্রার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে এটা দেওয়া হচ্ছে চীনে। এপ্রিলে জানা যাবে বিস্তারিত। তবে একই ওষুধ প্রয়োগ করে তেমন কোনো ফল না পাওয়ার কথা এই সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে। ট্রায়ালটা অবশ্য ছোট ছিল।
ইনফ্লুয়েঞ্জায় ব্যবহৃত জাপানের ফুজিফ্লিম কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান টয়ামা কেমিক্যালের ওষুধটি থেকে ফল পাওয়ার কথা চীনের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে জানিয়েছেন। ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুয়াইন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ AVIPTADIL ও পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে আক্রান্তদের মাঝে। অর্থ্রাইটিসের ওষুধ কেভজারার ট্রায়াল শুরু হচ্ছে—ধারণাটা এমন এটি জ্বর কমাতে এবং অক্সিজেনের সরবরাহ ঠিক রাখতে কাজ করতে পারে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল জটিল এবং নিয়ন্ত্রিত এক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। বছরের পর বছর ধরে বিজ্ঞানলব্ধ ধারণা ভুল প্রমাণ হয়। আবার কাঙ্ক্ষিত ফলাফলকে তথ্য এবং উপাত্ত দিয়ে ছবির মতো পরিষ্কার করে দেয়। সময় আসবেই। সবাই ভালো থাকবেন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মানবেন। ভয়কে জয় করার কথা তো রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন। ‘আমি ভয় করব না ভয় করব না।/ দু বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না॥/ তরীখানা বাইতে গেলে মাঝে মাঝে তুফান মেলে—/ তাই ব’লে হাল ছেড়ে দিয়ে ধরব না, কান্নাকাটি ধরব না॥’ (গীতবিতান)
ড. সুব্রত বোস: প্রবাসী বাংলাদেশি ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়ালস অ্যানালিটিকসের গ্লোবাল প্রধান।
[email protected]