করোনাভাইরাসের কামড়ে অ্যাপলের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা
চীনে করোনাভাইরাসের আক্রমণে দিন দিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত মানুষের সংখ্যা। কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন কলকারখানা। এ কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে দেখা দিচ্ছে অশনিসংকেত। তবে আইফোনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাপল পড়েছে সবচেয়ে বিপদে। এতটাই যে বিকল্প উপায় খুঁজতে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা অ্যাপলের।
ওপরে যা বলা হলো, তার প্রমাণ হিসেবে কিছু তথ্য জানিয়ে দেওয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করে থাকে অ্যাপল। সেই হিসাবে মার্কিন মুলুকই সিলিকন ভ্যালির এই কোম্পানির সবচেয়ে বড় বাজার। এরপরই আছে সি চিন পিংয়ের দেশ। ২০১৯ সালে চীনের বাজার থেকে ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার আয় করেছে টিম কুকের কোম্পানি। এর বেশির ভাগই এসেছে আইফোন বিক্রি করে। সেই দেশে কারখানা দূরে থাক, যদি বিক্রয়কেন্দ্রও বন্ধ করে দিতে হয়, তবে কোম্পানির হর্তাকর্তাদের কপালে ভাঁজ পড়া স্বাভাবিক। আর অ্যাপলকে দুটোই বন্ধ করে দিতে হয়েছে কোভিড-১৯-এর কারণে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব শুধু লাভ-ক্ষতির হিসাবে সীমাবদ্ধ থাকছে না। বরং পুরো বিশ্বের বাজারে অ্যাপলের সার্বিক ব্যবসাকে পড়তির দিকে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নতুন করোনাভাইরাস বর্তমানে চীনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে দেশটির অন্যান্য প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে কোভিড-১৯। চীনে এখন পর্যন্ত ৭৬ হাজারের বেশি মানুষ নতুন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে প্রায় ২ হাজার ৪০০ জন। চীনের বাইরে ২৭টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন করোনাভাইরাস। হাজারের বেশি মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে কয়েকজন। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, এই রোগের কোনো প্রতিষেধক এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি এবং রোগটি সম্পর্কে ভালোভাবে জানাশোনাও নেই কারও। ফলে নতুন এই রোগকে ঠেকাতে কিছুটা অন্ধকারেই হাঁটতে হচ্ছে চিকিৎসকদের।
এহেন পরিস্থিতিতে রোগের বিস্তার ঠেকাতে সি চিন পিংয়ের সরকার বেশ কঠোর ব্যবস্থাই নিচ্ছে। হুবেই প্রদেশ ও উহান শহর কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। অন্যান্য প্রদেশেও যেখানে নতুন আক্রান্ত পাওয়া যাচ্ছে, কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছে। চীন বাদে যেসব দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেও অনুসরণ করা হচ্ছে এই একই পদ্ধতি। কিন্তু সমস্যা হলো, এভাবে রোগের বিস্তার ঠেকাতে গিয়ে চীনে বন্ধ করে দিতে হচ্ছে কলকারখানা থেকে শুরু করে সাধারণ দোকানও। এতে করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও উৎপাদনব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ছে। আর এই সমস্যার কারণেই বিপদে পড়েছে অ্যাপল।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, নতুন করোনাভাইরাসের কারণে অ্যাপল এমন এক শাঁখের করাতে পড়েছে, যা দুই দিকেই কাটছে সমানতালে। একদিকে চীনা সরকারের বিধিনিষেধে কারখানা বন্ধ রাখায় অ্যাপলের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে চীনের বিশাল বাজারে কমে যাচ্ছে আইফোন ও অন্যান্য গ্যাজেটের বিক্রি। ১৭ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে অ্যাপল জানিয়ে দিয়েছে, চলতি প্রান্তিকে লাভের পরিমাণ কমে আসতে পারে। আর এমন ঘোষণার পর শেয়ারবাজারে এই টেক জায়ান্টের শেয়ারের দামও কমা শুরু করেছে। এখন বোঝা যাচ্ছে, অ্যাপলের কাঁড়ি কাঁড়ি ডলারের লাভ ধরে রাখতে চীন কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যাপলের এই চীনকেন্দ্রিক বিপুল ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গত ১০ বছরে। নিখুঁতভাবে বললে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে। এই সময়টায় চীনে অ্যাপলের আয় ২৮০ কোটি ডলার থেকে পৌঁছেছে ৫ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে; যদিও গত কয়েক বছরে আয়ের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। ক্যানালিস নামের এক গবেষণা সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে চীনে আইফোনের বিক্রি কমেছিল ২১ শতাংশ। তবে এখনো অ্যাপলের ট্যাঁক ভরাতে চীনের বাজারই সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হয়ে রয়েছে। কারণ, দেশটিতে অ্যাপলের বাজার আরও বড় করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই ঝামেলা বাধিয়েছে কোভিড-১৯।
নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, অ্যাপলের হয়ে আইফোন তৈরি করা তাইওয়ানের কোম্পানি ফক্সকনের ওপর টিম কুক অনেক বেশি নির্ভরশীল। কারণ, একমাত্র চীনেই আছে হাইটেক ম্যানুফ্যাকচারিং ইকোসিস্টেম। এর সঙ্গে আছে সস্তা শ্রম। এই দুইয়ের সমন্বয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ আইফোন তৈরি হয় ফক্সকনের তত্ত্বাবধানে। আবার আইফোন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশও সরবরাহ করে চীনের বিভিন্ন স্থানীয় কোম্পানি। এর বিকল্প হিসেবে ব্রাজিল ও ভারতে অ্যাপল কারখানা খোলার চেষ্টা চালালেও সেগুলো চীনের মতো সফল হয়নি। ফলে নতুন করোনাভাইরাসের কারণে অ্যাপলের বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন এলোমেলো হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অ্যাপল অবশ্য বলছে, শিগগিরই ধাপে ধাপে কারখানা ও বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে এতে আস্থা রাখা কঠিন। কারণ, নতুন করোনাভাইরাসের বিস্তার এখনো বন্ধ হয়নি। তার ওপর আছে কঠোর সরকারি নির্দেশনা ও এ–সংক্রান্ত বিধিনিষেধ। তাই সবকিছু স্বাভাবিক হতে ঢের সময় লাগবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
চলতি প্রান্তিকে অ্যাপলের আশা ছিল, আয় হবে ৬ হাজার ৩০০ কোটি থেকে ৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। তা অর্জন হবে না বলেই জানিয়ে দিয়েছে অ্যাপল। ব্লুমবার্গ বলছে, হার্ডওয়্যারের ওপর বেশি নির্ভরশীল থাকায় গুগল-ফেসবুকের তুলনায় বেশ কিছুটা পিছিয়ে অ্যাপল। যদিও এখন সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক বিভিন্ন সেবার (অ্যাপল মিউজিক, টিভি প্লাস, নিউজ প্লাস, আর্কেড ইত্যাদি) প্রসারে কাজ করছে অ্যাপল, কিন্তু এখনো প্রতিষ্ঠানটির মূল আয় আসে আইফোনের বিক্রি থেকেই। এর পরিমাণ প্রতিষ্ঠানের মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ।
টাইম ম্যাগাজিন বলছে, যেহেতু গুগল, ফেসবুক, আমাজনের মতো অন্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর চীনে ব্যবসা করা তুলনামূলক কঠিন, সেহেতু এই বাজারে পাওয়া সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের মূল ডেবিট-ক্রেডিটের হিসাবে কিছুটা এগিয়ে থাকার সুযোগ পেত অ্যাপল। এখন চীনে নতুন করোনাভাইরাসের কারণে সেই সুবিধা মাঠে মারা যাচ্ছে। সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে নতুন মডেলের পণ্য উৎপাদনেও। এই ফেব্রুয়ারিতেই কম দামের নতুন মডেলের আইফোন তৈরির কাজ শুরু করার পরিকল্পনা ছিল অ্যাপলের। ওই পরিকল্পনাও এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমান অচলাবস্থা ও এর কারণে হওয়া ক্ষতি সামলাতে অ্যাপল তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে পারে ফাইভ–জি প্রযুক্তি–সমর্থিত আইফোন। চলতি বছরের শেষ দিকে এটি বাজারে আসার কথা শোনা যাচ্ছে। ফাইভ–জি প্রযুক্তিতে স্বাভাবিকভাবেই যোগাযোগ সক্ষমতা ভালো হবে। ধারণা করা হচ্ছে, একমাত্র নতুন মডেলের এই আইফোন দিয়েই চীনা বাজারে উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারে অ্যাপল।
তাই বলে কি শুধু এক মডেলের আইফোনে অ্যাপলের শেষরক্ষা হবে? এর আগে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধে এক দফা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অ্যাপল। এবারের নতুন করোনাভাইরাস তো আরও সর্বগ্রাসী। হয়তো নতুন পণ্য বিক্রি করে কিছু অতিরিক্ত আয় হবে, কিন্তু চীনের বাজারের বিকল্প তা হবে না। কারণ, অ্যাপলের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে চীনের মতো শক্তিশালী ইঞ্জিন দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন।