কোয়ান্টাম কম্পিউটার আপনার যে কাজে লাগবে
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে আলোচনা শুনলে আপনার মনে হবে বৈজ্ঞানিক কোনো কল্পকাহিনি বলা হচ্ছে। কিন্তু আমরা এমন এক কম্পিউটার প্রযুক্তির চূড়ায় পৌঁছে গেছি, যা যুক্তি অমান্য করে, কল্পনাকেও হার মানায়। এখনকার কম্পিউটারের ব্যবহৃত ট্রানজিস্টরগুলো এতটাই ক্ষুদ্র যে তা হাতের নাগালে থাকা প্রযুক্তি দিয়েই বানানো যায়। তাই কম্পিউটার উদ্ভাবকেরা পারমাণবিক ও অতিপারমাণবিক স্তরে সম্ভাব্য সমাধান খোঁজা শুরু করেছেন, যা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং হিসেবে পরিচিত।
প্রযুক্তি দুনিয়ার বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু করেছে এবং বাণিজ্যিকভাবে তা বাজারে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার এমন কম্পিউটিং শক্তি দিতে সক্ষম হবে, যা প্রচলিত ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটারের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা যেকোনো সমস্যা দ্রুত সমাধান করে ফেলবে। জেনে নিন কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ব্যবহার সম্পর্কে:
যুক্তির বাইরে নতুন কম্পিউটিং
কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের কাজ সম্পর্কে বুঝতে হলে আগে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কী তা জানতে হবে। ২০ শতকের শুরুর দিকে যখন পরমাণু নিয়ে প্রথম গবেষণা চালানো হয়, তখন থেকে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান লজিক বা যুক্তি অস্বীকার করেছে। কোয়ান্টামের জগতে পরমাণু প্রচলিত পদার্থবিদ্যার সূত্র মানে না। কোয়ান্টাম কণা একই সময়ে সামনে বা পেছনে যেতে পারে, একই সময়ে দুই জায়গায় অবস্থান করতে পারে। অর্থাৎ একটি কোয়ান্টাম কণা বা পারমাণবিক মাত্রার একটি কণা একই সঙ্গে তার সব রকম অবস্থায় থাকতে পারে। এই অদ্ভুতুড়ে আচরণের কারণে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে সুবিধা নেওয়ার কথা ভাবেন গবেষকেরা।
হিসাবের সময় কমবে
এখনকার কম্পিউটার চলে বিটের হিসাবে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার চলবে কিউবিটের হিসাবে। বর্তমান কম্পিউটার মূলত বিটের মধ্যেই তথ্য সংরক্ষণ করে। এই বিট হচ্ছে বাইনারি ‘০’ অথবা ‘১’-প্রতিনিধিত্বকারী, যা বৈদ্যুতিক বা আলোক সংকেতের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। এই বিটস পদ্ধতিতে আট বিট মিলে তৈরি হয় বাইট, যা সাধারণত একটি সংকেতকে সংরক্ষণে সক্ষম। তাহলে কিউবিট কী জিনিস?
এটিও ০-১ বাইনারিকেই ব্যবহার করে তথ্য সংরক্ষণের জন্য। কিন্তু আলাদাভাবে নয়। একই সঙ্গে। অনেকটা কোয়ান্টাম তত্ত্বে বর্ণিত পদার্থের কণা ও তরঙ্গ ধর্মের মতো। কারণ, কোয়ান্টাম দুনিয়ায় একই কণা একই সঙ্গে একাধিক জায়গায় থাকতে পারে এবং তরঙ্গ ও কণাধর্মী অচরণের মধ্যে তার বিচরণও সাবলীল। এটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মূল শক্তি, যা ০-১–এর সহাবস্থানের মাধ্যমে একসঙ্গে বহু তথ্য সংরক্ষণে একে সক্ষম করে তোলে। এটি এর শক্তিকে দ্বিগুণ নয়, বহুগুণ করবে। কারণ, এই শক্তি জ্যামিতিক হারে বাড়ে। যেমন দুই কিউবিটে যদি চারটি সংখ্যা সংরক্ষণ করা যায়, তবে তিন কিউবিটে যাবে আটটি, আর চার কিউবিট পারবে ১৬টি সংখ্যা সংরক্ষণ করতে। এটি একই সঙ্গে একাধিক হিসাব করার সক্ষমতাও দেয়। এতে হিসাবের সময় কমে। প্রতিদিন আমরা প্রচুর তথ্য উৎপাদন করি। এসব তথ্য প্রসেস করে তা থেকে অর্থপূর্ণ ইনসাইট বের করতে অনেক কম্পিউটিং শক্তির প্রয়োজন। এতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেই সময় বাঁচাবে।
অবাস্তবকে বাস্তব করবে
ধরুন, কোনো একটি সমস্যা শেষ করতে বিলিয়ন বছর লাগত। অর্থাৎ প্রায় অসম্ভব গাণিতিক সমস্যার সমাধান এক তুড়িতেই করে ফেলতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। একসময় যা অসম্ভব বলে ধরে নেওয়া হতো, তা অসম্ভব থাকবে না। প্রচলিত কম্পিউটারকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার।
ডেটা নিরাপত্তা
অনেকেই তথ্যের নিরাপত্তায় এনক্রিপশনকে যথেষ্ট মনে করেন। কিন্তু ভার্চ্যুয়াল যে এনক্রিপশন ভাঙা সম্ভব নয় তা তৈরি করা যাবে। এতে ডেটা নিরাপত্তার পরিস্থিতি বদলে যাবে। এখনকার বেশির ভাগ এনক্রিপশন পদ্ধতি ভেঙে দিতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এর বদলে হ্যাক ঠেকানোর মতো বিকল্প ব্যবস্থা পাওয়া যাবে।
সব কাজের কাজি
কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে বলা যেতে পারে সব কাজের কাজি। প্রচলিত কম্পিউটারে হয়তো মেইল, স্প্রেডশিট বা ডেস্কটপ পাবলিশিংয়ের মতো কাজগুলো ভালোভাবে করা যায়। তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির লক্ষ্যটাই ভিন্ন। এটা মূলত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন টুল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এটা প্রচলিত কম্পিউটারের জায়গা নেবে না। যেমন কোনো বিমানবন্দরের ফ্লাইট শিডিউল সবচেয়ে নিখুঁতভাবে নির্ণয় করার কাজ করা যাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে।
গতির রাজা
গুগল সম্প্রতি কোয়ান্টাম কম্পিউটারে সুপ্রিমেসি অর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গুগলের এআই কোয়ান্টাম টিম কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে। গুগলের সিকামোর প্রসেসর সাড়ে তিন মিনিট সময়ে এমন এক হিসাব সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে, যা প্রচলিত সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারের করতে ১০ হাজার বছর সময় লাগত। আর্মহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ক্যাথরিন ম্যাকগিওচের মতে, প্রচলিত কম্পিউটারের চেয়ে হাজার হাজার গুণ গতিসম্পন্ন কোয়ান্টাম কম্পিউটার।
বিগ ডেটার সমাধান
প্রতিদিন আমরা ২ দশমিক ৫ হেক্সাবাইট তথ্য উৎপন্ন করছি, যা ৫০ লাখ ল্যাপটপে থাকা কনটেন্টের সমান। বিশাল এ তথ্য ভান্ডার বিশ্লেষণ করবে কোন কম্পিউটার? কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পক্ষেই এ পরিমাণ তথ্য প্রসেস করে বিগ ডেটা যুগের চাহিদা মেটানো সম্ভব। ভবিষ্যতে মেশিন বা যন্ত্রের যুগ আসছে। প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যন্ত্র থেকেও তৈরি হবে ডেটা। এসব তথ্যের নিখুঁত বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়েই।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী
কোয়ান্টাম কম্পিউটারে অধিক বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে না। এটি ১০০ থেকে এক হাজার গুণ কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে, কারণ কোয়ান্টাম টানেলিং নামের এক পদ্ধতি এতে ব্যবহৃত হয়, যাতে বিদ্যুতের খরচ কমে। এ ছাড়া এ কম্পিউটার নাজুক। যেকোনো ধরনের কম্পন পরমাণুর ওপর প্রভাব ফেলে অসংগতি তৈরি করতে পারে।
উন্নত সফটওয়্যার ও মেশিন লার্নিং
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য ইতিমধ্যে কয়েক ধরনের অ্যালগরিদম তৈরি হয়ে গেছে। এর মধ্যে আনস্ট্রাকচারড ডেটাবেইস খুঁজতে গ্রোভারস অ্যালগরিদম ও বৃহৎ সংখ্যাকে উৎপাদন কাজে লাগাতে সর অ্যালগরিদ উল্লেখযোগ্য। টেকসই কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি হয়ে গেলে মেশিন লার্নিং সমস্যা সমাধানের জন্য সময় কমাতে সাহায্য করবে।