মোবাইলে লাইভ ভিডিও ধারণের ১০ কৌশল
গণমাধ্যম থেকে শুরু করে ছোট-বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিংবা নতুন উদ্যোক্তা নিজেদের সুনির্দিষ্ট গ্রাহকের কাছে পৌঁছতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মার্কেটিং কৌশলে লাইভ ভিডিওকে এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। আর অধিকাংশ সময় এই লাইভ ভিডিও তাঁরা করছেন মোবাইল ফোন থেকে।
বর্তমানে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামসহ জনপ্রিয় সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে লাইভ ভিডিও সম্প্রচার করার সুযোগ রয়েছে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা সামাজিক যোগোযোগমাধ্যমগুলো কয়েক বছর ধরে লাইভ ভিডিও ফিচারকেই অন্যতম অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছে।
স্মার্টফোনের ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় হাতের কাছে থাকা মোবাইলে লাইভ ভিডিও প্রচারের আদর্শ ডিভাইস হিসেবে পরিণত হয়েছে। নাগরিক সাংবাদিকেরা মোবাইল ফোন থেকে লাইভ ভিডিওর মাধ্যমে এমন সব ফুটেজ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, যা প্রচলিত সম্প্রচার সরঞ্জামগুলো দিয়ে হয়তো পাওয়া সম্ভব নয়।
দাঙ্গা, জনসমাবেশে অথবা দুর্যোগপূর্ণ ঘটনাস্থলে যেখানে সংবাদকর্মী বড় ক্যামেরা ক্রু না গিয়ে থাকলে, সেখানে মোবাইল লাইভ হতে পারে সহজ সমাধান।
বিবিসির সাবেক সোশ্যাল মিডিয়া সম্পাদক মার্ক ফ্রাঙ্কেল বলেছিলেন, ‘ব্রেকিং নিউজের ক্ষেত্রে মোবাইল লাইভ একটি গুরুত্বপুর্ন সংবাদ উৎসে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বিগত কয়েক বছরের বড় বড় ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে এই কথার সত্যতা আমরা দেখতে পেয়েছি।’
আজকাল ঘটনাস্থল থেকে মোবাইলে লাইভ ভিডিও সম্প্রচারের জন্য ফেসবুককেই আদর্শ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ধরা হয়। ২০১৫ সালে স্বল্পপরিসরে ফেসবুকে সরাসরি ভিডিও সম্প্রচার সেবা ‘ফেসবুক লাইভ’-এর যাত্রা শুরু হলেও ২০১৬ সালে তা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। সহজে লাইভ ভিডিও সম্প্রচার প্রক্রিয়া, ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি থাকা এবং সম্পৃক্ততার নানাবিধ ফিচার থাকার কারণেই ফেসবুক লাইভ ভিডিও প্রচারের জন্য অন্য সব প্ল্যাটফর্ম থেকে এগিয়ে রয়েছে। আমাদের দেশে মোবাইলে লাইভ সম্প্রচারের জন্য ফেসবুকই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম।
স্মার্টফোন থেকে সহজে লাইভ ভিডিও প্রচার করার কিছু কৌশল রয়েছে। পেশাগত সাংবাদিকেরা মোবাইল থেকে লাইভে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিশ্চিত করে নিলে অযথা ঝামেলায় পড়তে হয় না। মোবাইল দিয়ে লাইভ ভিডিও প্রচারের সময় নিচের ১০টি বিষয় খেয়াল রাখতে পারেন।
প্রথম আপনার নিরাপত্তা
আপনার লাইভ সম্প্রচারে কোনো প্রকার হয়রানি কিংবা বিপজ্জনক ঝুঁকি থাকতে পারে কি না, তা মূল্যায়ন করা জরুরি। সাধারণত মোবাইল সাংবাদিকেরা একা কাজ করেন এবং তাঁদের সঙ্গে কোনো ক্রু থাকে না। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে প্রয়োজন হলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করুন। নিজেকে, যে মানুষদের নিয়ে লাইভ করছেন তাঁদের এবং আপনার দর্শকদের বিপদে ফেলবেন না।
ট্রোল মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। কখনো কখনো ট্রোলগুলো রীতিমত ভয়াবহ হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন করে এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এটা বেশি ঘটে নারী সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে তাঁরা হয়রানি এবং হুমকির লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন।
নৈতিকতা
সর্বদা প্রতিষ্ঠানের নৈতিক দিকগুলোকে প্রাধান্য দিন। সাংবাদিক হিসেবে নৈতিক বিবেচনার ভিত্তিতে মোবাইল সাংবাদিকতা পরিচালনা করুন। এখানে কিছু দিক রয়েছে।
অনুমতি নিয়ে ছবি বা ভিডিও করা: অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়গুলোকে সম্মান করা এবং ভিডিও বা ছবি তোলার সময় অনুমতি নেওয়া।
দর্শকদের বিষয়টি মাথায় রাখা: মনে রাখবেন যখন ব্রেকিং নিউজ স্ট্রিমিং করা হয় তখন আপনি আগে থেকে দর্শকদের সতর্ক করতে পারেন না। এমনকি আপনি নিজেও এটি জানেন না। যেকোনো সম্ভাব্য দৃশ্যকল্পের জন্য প্রস্তুত থাকুন।
কপিরাইট: আপনি যখন কোনো কনটেন্ট লাইভ স্ট্রিম করবেন তা কপিরাইট আইনে পড়ে কি না, নিশ্চিত হোন।
স্থির ফুটেজ
ভালো মানের লাইভ স্ট্রিমিংয়ের প্রথম ধাপ হলো, ভিডিওর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। সহজ ভাষায়, আপনি আপনার ফোনটি হাতে রেখে একটি ভিডিও ধারণ করুন। স্বভাবতই হাত কাঁপার কারণে ভিডিওর মান খারাপ হবে। দেখে মনে হবে অপরিপক্ক হাতে করা। সে ক্ষেত্রে আমরা ট্রাইপড ব্যবহার করতে পারি। আপনি ঢালু রাস্তায় শুট করছেন? আশপাশে দেখুন। যদি কোনো পাচিল বা পোস্ট বক্স কিংবা কোনো দেয়াল দেখেন, তবে চেষ্টা করুন তার ওপর ফোনটা রেখে ভিডিও ধারণ করতে।
শব্দধারণে গুরুত্ব দিন
লাইভ ভিডিওতে প্রায় অডিও শোনা যাচ্ছে না—এই ধরনের মতামত আমরা কমেন্ট বক্সে দেখতে পাই। ভিডিও রেকর্ডের জন্য আপনি যতটা সচেতন হবেন, ঠিক অডিওর বেলাতেও আপনাকে সচেতন হতে হবে। ধারা বর্ণনাসহ লাইভ ভিডিও ধারণের সময় অবশ্যই একটি লেপেল মাইক্রোফোন বা হেডফোনের ব্যবহার করুন। দর্শক আপনার কথা পুরোপুরি না শুনতে পেলে বা বুঝতে না পারলে আপনার ওই লাইভের মূল উদ্দেশ্য অর্জনে আপনি ব্যর্থ হবেন।
ইন্টারনেট সংযোগ
নিউজ রুম থেকে আপনার ধারণ করা ভিডিও কনটেন্টটি পেতে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করুন। ভালো সিগন্যাল রয়েছে এমন জায়গায় যান কিংবা ওয়াই-ফাই সেবা দেয়, এমন কোনো কফি শপ খুঁজে বের করুন।
যে শটটিতে যত বেশি নড়াচড়া করানো হয়, ডেটা খরচ তত বেশি হয়। শট নেওয়ার সময় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার এটাও একটা বড় কারণ।
ইন্টারনেট সংযোগ দুর্বল হলে লাইভ স্ট্রিমিং করতে বেগ পেতে হতে পারে। লাইভ স্ট্রিমিংয়ের সময় আপনার ইনকামিং কল বন্ধ করতে ভুলবেন না। কারণ, ফোন কল এলে আপনার ডেটা সংযোগটি কেটে যেতে পারে।
ডেটা ও চার্জ সম্পর্কে সচেতন হোন
ভালো সংযোগ এবং ব্যাটারির স্থায়িত্বের পাশাপাশি লাইভ স্ট্রিমের সময় আপনি কতখানি ডেটা ব্যবহার করবেন, সে বিষয়ে সচেতন থাকাও জরুরি। লাইভ ভিডিও সম্প্রচারের সময় ব্যাটারির চার্জ দ্রুত শেষ হতে থাকে। তা ছাড়া যে স্থান থেকে আপনি লাইভ করছেন সেখানের বায়ুমণ্ডলের তাপ (সাধারণত ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঊর্ধ্বে) থেকেও আপনার মোবাইল ফোনের প্রসেসর গরম হতে থাকবে। লাইভের সময় আপনাকে অবশ্যই সঙ্গে একটা পোর্টোবল চার্জার রাখতে হবে।
সঠিক অ্যাপ নির্বাচন করুন
লাইভ স্ট্রিমিং ভিডিও বা অডিও হোক, বিভিন্ন অ্যাপ নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করুন, দেখুন কোনটি আপনার কাজের জন্য উপযোগী। ভিডিও এবং অডিও উভয় লাইভ স্ট্রিমিংয়ের জন্য স্কাইপে অ্যাপ ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা Bambuser বা Switcher অ্যাপ্লিকেশনটি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আপনি যদি Bambuser এর মতো কোনো অ্যাপ ব্যবহার করতে চান, তবে আপনার ফোনের মেমরি খালি রাখতে হব।
লাইভ ভিডিওর দৈর্ঘ্য
সাধারণত ফেসবুক ভিডিওর দৈর্ঘ্য হয় ১ মিনিট। আদর্শ ফেসবুক লাইভের সময়কাল ১০ মিনিট। কনটেন্টের সঙ্গে যুক্ত হতে দর্শকদের যথেষ্ট সময় দিতে হবে।
দর্শকের মতামতের জবাব দিন
লাইভের জন্য আপনার দুটি ফোনের দরকার হবে। একটি থেকে আপনি লাইভ স্ট্রিমিং চালু রাখবেন অন্যটি ব্যবহার করে দর্শকদের মতামত পড়বেন এবং তার জবাব দেবেন।
সঠিক সরঞ্জাম নির্বাচন করুন
দরকারি কিছু সরঞ্জাম ব্যবহার করে আপনার স্মার্টফোন থেকে পেশাদার মানের লাইভ ভিডিও করতে পারেন। কম খরচে সরঞ্জাম ব্যবহার করে যে কেউ তাঁদের লাইভ ভিডিওটিকে নতুন মাত্রা দিতে পারেন এবং ছবি, অডিও এবং লাইভ সম্প্রচারের সামগ্রিক গুণমান উন্নত করতে পারেন। এসব সরঞ্জাম আইফোন বা অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনের জন্য প্রযোজ্য। এখানে কিছু সরঞ্জামের তালিকা দেওয়া হলো—
-স্মার্টফোন রিগ (Shoulderpod S1)
-ল্যাপেল মাইক্রোফন (Boya By-M1 )
-ইন্টারভিউ মাইক্রোফোন (BUB interview microphone)
জামিল খান: সহকারী অধ্যাপক, মিডিয়া স্টাডিজ ও জার্নালিজম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)