লাইক গুনে কি লাভ?
অনেকেই ফেসবুক-টুইটারে পোস্ট দেন। তাতে যদি প্রচুর লাইক, কমেন্ট পড়ে বা শেয়ার হয় তবে ব্যাপক খুশি থাকেন। কারণ, তিনি এতে বুঝতে পারেন তাঁর জনপ্রিয়তা। আশানুরূপ লাইক-কমেন্ট বা প্রতিক্রিয়া না পেলেই তাঁদের বিষণ্নতা পেয়ে বসে। আবার যাঁরা ফেসবুকে পোস্ট পড়েন তাঁরা বেশি বেশি লাইক-কমেন্ট বা শেয়ার হওয়া পোস্ট পড়েন বেশি। এতে অনেক অগুরুত্বপূর্ণ পোস্টও লাইক-কমেন্টের জোরে ভাইরাল হয়ে যায়। কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট কেউ চোখ পর্যন্ত বোলান না। ফলে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, এখন জনপ্রিয়তার মাপকাঠি ‘লাইক’। সমস্যা হচ্ছে—লাইক তো কিনতে পাওয়া যায়! অর্থাৎ, অর্থ খরচ করলেই লাইকে ভরে যেতে পারে আপনার পোস্ট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাইক পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টি এখন হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। হয়ে উঠেছে বিষাক্ত। তাই ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ও ইউটিউব লাইক ‘বিষ’ কমাতে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
মানুষের এত দিনের অভ্যাস ‘লাইক’দেখানোর সুযোগ যদি হঠাৎ বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানগুলো? উইয়ার্ড অনলাইনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনপ্রিয়তা মাপার পদ্ধতিটিকে লুকিয়ে ফেলার বা অস্পষ্ট করে দেওয়ার প্রচেষ্টা ব্যবহারকারীরা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। লাইক গণনা বন্ধ করার উদ্যোগ তাদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। লাইক না থাকলে এনগেজমেন্ট বা ব্যবহারকারীর সক্রিয়তা কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। কে কত লাইক দিল তা দেখতে না পেয়ে অনেকেই সমালোচনা করছেন।
উইয়ার্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনলাইনে সবকিছুর মূল্য এখন বিভিন্ন সূচক দিয়ে পরিমাপ করা যায়। একজন ব্যক্তির ও তাঁর ধারণার মূল্য লাইক-কমেন্টের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয়ে যায়। কে কতগুলো লাইক পেল, কার টুইট কত রিটুইট হলো, কোন পোস্ট কতো শেয়ার হলো, কার কতো ফলোয়ার, কার কনটেন্টে কতো ভিউ, কে কতো রিপ্লাই পান এসব এখন মূল্যায়নের সূচক। যার লাইক যত বেশি তিনি তত বেশি মূল্যবান বলে ধরে নেওয়া হয়। ইউটিউবে কোনো বাজে কনটেন্টের ভিউ যদি লাখ ছাড়ায় তবে ১০০ ভিউয়ের ভালো কনটেন্টের চেয়ে তার মূল্য অনেক বেশি। কিন্তু সবাই জানেন, অনলাইন এনগেজমেন্টের বেশির ভাগই অর্থের বিনিময়ে পাওয়া যায়।
ব্যবসার ভালো-মন্দ বিবেচনা করলে অবশ্য এনগেজমেন্টের দিকে নজর দিতেই হয়। কারণ এনগেজমেন্ট বাড়লে তা ব্যবসার জন্য ভালো। লাইক-শেয়ার-ভিউয়ের হিসাব তখনই আসে। ব্যবসায়ীকে তার কনটেন্টে ব্যবহারকারী ফিরে আসছে কিনা তা জানার জন্য পরীক্ষা করে দেখতে হয়। অর্থাৎ, ক্রেতা আকৃষ্ট করতে লাইক বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হয়। লাইক বাড়ানোর জন্য নিতে হয় নানা কৌশল।
টুইটারের প্রধান নির্বাহী জ্যাক ডরসি গত বছর এক সম্মেলনে বলেছেন, টুইটারে লাইক বাড়ানোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। লাইক শিকারিদের ধরতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন তাঁরা।
লাইকের পেছনে ছোটার এ প্রবণতা অবশ্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর জন্য বুমেরাং হয়েছে। ব্যবহারকারীরা এখন ভালো কনটেন্টের দিকে নজর দিতে আগ্রহী নন। বরং, বেশি লাইকের ভাইরালের দিকে ছোটেন বেশির ভাগ মানুষ। এতে ‘ইন্টারনেটের স্বাস্থ্যের’ বারোটা বেজেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভের বদলে লোকসানের ঝুঁকি বাড়ছে। তারা এটা মেনে নেবে কেন? এখন ‘লাইক বিষ’ নিয়ন্ত্রণের কথা উঠে আসছে। ইন্টারনেটের বৃহৎ পরিসরে এ বিষের প্রভাবের বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তাদের মাথায় ঢুকে গেছে। ইন্টারনেটের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে তারা ততপর।
যুক্তরাষ্ট্রের সাইরাকাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হুইটনি ফিলিপস বলেছেন, সর্বজনীনভাবে পরিমাপযোগ্য সূচক হিসেবে ভিউ, রিটুইট বা লাইক এখন মৌলবাদের অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। এটা দ্বিমুখী নীতিতে কাজ করে। কনটেন্ট নির্মাতা ব্যবহারকারীকে কনটেন্ট দিয়ে উসকে মৌলবাদে দিকে নিয়ে যেতে পারে। ব্যবহারকারীও প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কনটেন্ট নির্মাতাকে মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে সাহায্য করে।
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ও ইউটিউব ইউজার এনগেজমেন্ট বাড়ানোর বিষয়টি ‘মেট্রিকস’ হিসাব হিসেবে পরিচিত। ব্যবহারকারী যাতে মেট্রিকস নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে না পড়েন তা কমাতেই এখন চালু হয়েছে ‘ডিমেট্রিকেটরস’ নামের একটি বিশেষ পদ্ধতি। গত কয়েক বছর ধরে ‘ডিমেট্রিকেশনের’ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ডিমেট্রিকেশন বিষয়টি ব্যবহারকারীর মনে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
কিছুদিন আগেই ফেসবুকে নিউজ ফিড পোস্টে লাইক কাউন্টার শিগগিরই সরিয়ে ফেলার বিষয়টি জানায় ফেসবুক। এতে কোন পোস্টে কত লাইক পড়ল, তা গোনার সুযোগ আর নাও থাকতে পারে। এর আগে ইনস্টাগ্রাম দেয়, সাতটি দেশে লাইক গণনা করার সুবিধা লুকানোর বিষয়টি পরীক্ষা করেছে তারা। তাদের উদ্দেশ্য—ব্যবহারকারী যাতে পোস্ট করা ছবি বা ভিডিও কত লাইক পেয়েছে তাতে গুরুত্ব না দিয়ে তা শেয়ারের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়।
ফেসবুক ও টুইটারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন অনেকেই। কারণ, এগুলোতে তাদের এনগেজমেন্টে উৎসাহ দেয়। বিষয়টি নিয়ে টুইটারের পক্ষ থেকেও পরীক্ষা চালানো হয়। তাতে দেখা গেছে, লাইকের সুযোগ সীমাবদ্ধ হলে এনগেজমেন্ট কমছে।
টুইটারের পণ্য পরিচালক সারা হায়দার বলেছেন, অনেকের কাছ থেকে তারা শুনেছেন যে ব্যবহারকারীরা লাইক গণনার বিষয়টি মিস করে। তাদের জন্য বাড়তি ক্লিক করে তা দেখা চ্যালেঞ্জিং।
ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকের মতোই লাইক কাউন্টার সীমিতভাবে দেখানোর পথে হাঁটছে ইউটিউব। এতে সাবসক্রাইবারের সংখ্যা যাতে বিস্তারিত না দেখা যায় তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এতে ইউটিউব ব্যবহারকারীদের আবেগে হয়তো বাঁধ দেওয়া যাবে। ইউটিউব একে দেখছে ব্যবহারকারীর ইন্টারনেট স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয় হিসেবে।
ইউটিউব কর্তৃপক্ষ চাইছে, কনটেন্ট নির্মাতারা গল্প বলতে মনোযোগী হোক। লাইক শেয়ারের সংখ্যা নিয়ে চাপ তাদের মাথায় যেন না থাকে। ব্যবহারকারীরও যাতে লাইক শেয়ারের চিন্তা না করে ভালো কনটেন্টকে গুরুত্ব দেয়।