গান শোনা বা সিনেমা দেখার জন্য নয় এটি। নেই গেম খেলার ব্যবস্থাও। এটি হিসাব কষতে পারে। গণিতের দুর্বোধ্য সব সমস্যা এনে এই যন্ত্রের সামনে হাজির করুন, সমাধান করবে এক তুড়িতে। তাবৎ বিজ্ঞানীদের মতে, প্রযুক্তি বিশ্বে নতুন বিপ্লবের সূচনা করবে অনেক ধাতব সিলিন্ডার ও প্যাঁচানো তারে তৈরি কিম্ভূতকিমাকার যন্ত্রটি। আর এর সবকিছুর নিচে থাকবে ছোট্ট এক কালো চিপ।
ছবি দেখে একে কম্পিউটার মনে না হলেও এটি একটি কম্পিউটার। এর নাম কোয়ান্টাম কম্পিউটার। কোয়ান্টাম মেকানিকসের জটিল সমীকরণ কাজে লাগিয়ে গাণিতিক সব সমস্যার সমাধান করবে। প্রযুক্তিবিদেরা বলছেন, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সম্ভাবনা অসীম। যানজট নিরসন থেকে শুরু করে নতুন নতুন ওষুধ তৈরি—সবই থাকবে এর আয়ত্তে।
কীভাবে কাজ করে?
সাধারণ কম্পিউটার কাজ করে বাইনারি সংখ্যা ০ ও ১ দিয়ে। এ নিয়েই আজকালকার কম্পিউটারের যত কেরদানি। এই কম্পিউটারগুলো হয় ০, নাহয় ১-এর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। একসঙ্গে দুটি সংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। আর এখানেই ভিন্ন কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এটি আলাদা আলাদা করে তো বটেই, একই সময়ে একই সঙ্গে ০ ও ১-এর প্রতিনিধিত্বও করতে পারে।
বিশেষ এই কম্পিউটারের মৌলিক একককে বলা হয় কোয়ান্টাম বিটস বা কিউবিটস। প্রথাগত কম্পিউটার বিটসের চেয়ে বহুগুণ বেশি কাজ করতে পারে কিউবিটস। ফলে দুটি কিউবিটস একই সঙ্গে চারটি সংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, তিনটি কিউবিটস করতে পারে আটটি সংখ্যার। এই অবস্থাকে বলা হয় সুপারপজিশন।
তত্ত্ব মতে, কোয়ান্টাম মেকানিকসের দুটি কৌশলে কাজ করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এর একটি হলো ওপরের সুপারপজিশন। অন্যটি হলো এনট্যাংগেলমেন্ট পদ্ধতি। প্রায় ৪০ বছর আগে নোবেলজয়ী পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান প্রথম বলেছিলেন, কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা সম্ভব। এত দিন পর এবার ধীরে ধীরে কোয়ান্টাম বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। মাইক্রোসফট করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সত্য নাদেলার জবানিতে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে পুরো বিশ্ব ব্যবস্থা বদলে ফেলা সম্ভব। এমনকি হালের সুপার কম্পিউটারকে আদ্যিকালের অ্যাবাকাসে পরিণত করতে পারে এটি!
চলছে প্রতিযোগিতার ইঁদুরদৌড়
এমন কম্পিউটার নিয়ে বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে প্রতিযোগিতার ইঁদুরদৌড় শুরু হবে, সেটি সহজেই অনুমেয়। কে আগে কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করবে—এটিই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। ২০১১ সালে ডি-ওয়েভ সিস্টেমস ইনকরপোরেটেড নামে কানাডার একটি প্রতিষ্ঠান প্রথম আনে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। তবে একে ঠিক কোয়ান্টাম কম্পিউটার বলায় প্রযুক্তিবিদদের জোর আপত্তি আছে। বলা হচ্ছে, আসল কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির দৌড়ে বেশ এগিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিনস (আইবিএম) করপোরেশন। ২০১৬ সাল থেকেই গবেষকদের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রাথমিক মডেলের ওপর পরীক্ষামূলক কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে আইবিএম। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের এই প্রাথমিক মডেলের ক্ষমতা ২০ কিউবিটস।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির প্রকল্প নিয়েছে গুগল, ইনটেল ও রিজেত্তি কম্পিউটিং। বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের উপযোগী কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির প্রকল্প নিয়েছে মাইক্রোসফট। গুগল ঘোষণা দিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই কোয়ান্টাম প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু করতে চায় তারা। এই প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে চীনের আলিবাবা ও হুয়াওয়ে।
বসে নেই বিশ্বের পরাশক্তিরাও। যুক্তরাজ্য ২০১৩ সালে জাতীয় কোয়ান্টাম প্রযুক্তি কর্মসূচির গবেষণাকাজে মোট ২৭ কোটি পাউন্ড বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। কোয়ান্টাম প্রযুক্তির উন্নতির জন্য ১০ বছর মেয়াদি প্রকল্প আনার কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওদিকে ২০২০ সালের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে কোয়ান্টাম ইনফরমেশন সায়েন্সভিত্তিক পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করতে এক হাজার কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে চীন।
১০ কোটি গুণ বেশি গতি
যে জিনিস তৈরি নিয়ে এত কাড়াকাড়ি, তার কাজ কী? এক কথায়, অনেক। নতুন টেকসই নির্মাণসামগ্রী তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। ক্যানসার বা এইডসের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ তৈরিতে সহায়তা করবে এটি। কারণ জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে আরও নিখুঁত করার ক্ষমতা আছে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের। তথ্যভান্ডারের সুরক্ষা দেওয়ায় এই যন্ত্রের জুড়ি নেই। আবার আবহাওয়া ও পরিবেশ পরিবর্তনের পূর্বাভাসও দিতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। পারবে কার্যকর ট্রাফিকব্যবস্থা সৃষ্টি করতে, পানি-গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থাকেও নির্ভুল করা যাবে। গুগল এক পরীক্ষায় দেখেছে, কিছু ক্ষেত্রে প্রথাগত প্রসেসরের চেয়ে ১০ কোটি গুণ দ্রুত গতিতে কাজ করতে পারে নতুন কোয়ান্টাম কম্পিউটার।
মুদ্রার ওপিঠ
টারমিনেটর সিরিজের সিনেমায় যেমন ভালো ও খারাপ দুই ধরনের রোবটই ছিল, তেমনি কোয়ান্টাম কম্পিউটারেরও ধ্বংসাত্মক দিক আছে। বর্তমান ইন্টারনেট যে ক্রিপ্টোগ্রাফিক ব্যবস্থায় সুরক্ষিত থাকে, তা নিমেষে ভেঙেচুরে একাকার করে দিতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। তাই এই যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ হ্যাকার বা অপরাধীদের হাতে গেলে, বিশ্ববাসীর কপালে আদতেই দুঃখ আছে। ভেঙে পড়তে পারে পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থা। কোটি কোটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য বেহাত হয়ে যেতে পারে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নামবে ধস। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও করতে পারে উল্টোপাল্টা আচরণ।
সবই ফাঁকা আওয়াজ?
নিন্দুকেরা অবশ্য বলছেন, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের নাগাল পাওয়া দূর অস্ত! আরও ১২ থেকে ১৫ বছরের আগে পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর কোয়ান্টাম কম্পিউটার পাওয়া যাবে না। কারণ হাজারো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও তাত্ত্বিকভাবে নিখুঁত কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির পথে অগ্রগতি খুব বেশি নয়। বরং এ নিয়ে ফাঁকা আওয়াজই বেশি হচ্ছে। আশাবাদীরা অবশ্য এতে সায় দিচ্ছেন না। কারণ এই খাতে এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হচ্ছে। যেভাবে সবাই কোমর বেঁধে লেগেছে, তাতে ধারণা, কোয়ান্টাম বিপ্লব খুব দূরে নয়।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, দ্য টেলিগ্রাফ, ফোর্বস, ব্লুমবার্গ ও ওয়্যার্ড