যে কথা মনে করায় কালো রাজহাঁস
কৃত্রিম এক হ্রদের শান্ত শীতল পানিতে এক জোড়া কালো রাজহাঁস সাঁতার কাটছে আর কাচঘেরা বিশাল ভবনের মধ্যে বসে হাজারো গবেষক, নকশাবিদ, প্রকৌশলী চিন্তায় বিভোর। নতুন স্মার্টফোন কেমন হবে, কীভাবে গ্রাহকের সন্তুষ্টি অর্জন করবে, কীভাবে অ্যাপল আর স্যামসাংকে টপকে বাজারে সেরার আসনে বসবে, এর আয়োজন চলছে।
এখন বিশ্বজুড়ে যত মনকাড়া স্মার্টফোন দেখা যায়, এর সবই চীনের কোনো না কোনো কারখানায় তৈরি। চীনের প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশটির সেনাবাহিনীর সাবেক কারিগরি প্রকৌশলী রেন ঝেংফেই। এ বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে বিশ্বজুড়ে অ্যাপলকে টপকে স্মার্টফোনের বাজারের দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে চীনের হুয়াওয়ে।
হুয়াওয়ের শেনঝেন ক্যাম্পাসে প্রকৃতির সবুজ আর আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণার এক অপূর্ব মেলবন্ধন হয়ে উঠেছে। এ শহরের মধ্যে সবুজের বুক চিরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্মার্টফোন সংযোজন কারখানা গড়ে তুলেছে হুয়াওয়ে। প্রিমিয়াম ফিচার আর তুলনামূলক কম দামের হুয়াওয়ে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের জন্মস্থান এটি।
ব্ল্যাক সোয়ান বা কালো রাজহাঁসকে প্রতীকী অর্থেই তুলে ধরেছে প্রতিষ্ঠানটি। এটি হুয়াওয়ের জন্য অনুপ্রেরণা আর সতর্ক থাকার প্রতীক। হুয়াওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের ‘বিগ বস’ এ হ্রদের পাড়ে হাঁটাহাঁটি করেন। তিনি নিয়মিত এখানে আসেন। হুয়াওয়ের কর্মীদের এখান থেকে অনুপ্রেরণা নিতে বলেন। এ রাজহাঁসগুলো দুর্লভ। নিউজিল্যান্ড থেকে তিনি এগুলো এনেছেন।
কালো রঙের রাজহাঁস থাকার কারণে হুয়াওয়ের কর্মীদের কাছে এটি ‘ব্ল্যাক সোয়ান লেক’ নামে পরিচিত। এখানে অনেক কর্মী তাঁদের শিশুদের নিয়ে আসেন। অনেকেই এর পাড়ে বসেন।
হুয়াওয়ের গ্রাহক সম্পর্ক বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, ব্ল্যাক সোয়ান মূলত অনিশ্চয়তা বা দুর্ভাগ্যের প্রতীক। মানুষের জীবনে বা প্রতিষ্ঠানের সর্বদা ভালো সময় যাবে না। যেকোনো সময় ব্যবসায় দুর্ঘটনা বা ক্ষতি হতে পারে। দুঃসময় আসতে পারে। এ জন্য দুঃসময়কে সব সময় মাথায় রাখতে হবে। ভালো কাজ করতে হবে। মানুষকে ফাঁকি দেওয়ার অশুভ চিন্তা বাদ দিতে হবে। ভালো কিছু করার, নিখুঁত থাকার, মান নিয়ন্ত্রণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, দুঃসময় যেকোনো সময় আসতে পারে। কালো রাজহাঁস সে কথাই মনে করিয়ে দেবে।
হুয়াওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, অ্যাপলের সঙ্গে তাদের এখন প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। তবে অ্যাপলের সম্প্রতি বাজারে ছাড়া আইফোনের তুলনায় তারা উদ্ভাবনের দিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। আইফোন এক্সএম ম্যাক্সের সঙ্গে তারা প্রতিযোগিতা করতে বাজারে ছেড়েছে হুয়াওয়ে মেট ২০ সিরিজের নতুন স্মার্টফোন। সাংহাইয়ের ওরিয়েন্টাল স্পোর্টস সেন্টারে নতুন স্মার্টফোন উন্মুক্ত করেছে হুয়াওয়ে।
চীনের বাজারে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে ওই কালো রাজহাঁসের কাছ থেকেই এসেছে অনুপ্রেরণা। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী রিচার্ড ইউ জানান, বর্তমানে চীনের বাজারে হুয়াওয়ের দখল ২২ দশমিক ৬ শতাংশ। এর নতুন ফিচার হিসেবে আসা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত চিপসেট, ক্যামেরা, থ্রিজি–প্রযুক্তি, ব্যাটারি, ভয়েস রিকগনিশন, চার্জ–প্রযুক্তিসহ সবকিছুই হুয়াওয়ের নিজস্বতা প্রকাশ করে। তবে ক্যামেরা–প্রযুক্তির ক্ষেত্রে লেইকার সঙ্গে চুক্তি করে কাজ করছে তারা।
হুয়াওয়ের কর্মকর্তারা বলেন, ‘আমরা দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে চাই। ভবিষ্যতে আসছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ আইওটির যুগ। স্মার্টফোনের সঙ্গে নতুন নতুন যেসব প্রযুক্তি আসবে, সেগুলো নিয়েও কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা।’
স্কুলশিক্ষকের ছেলে হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা রেন প্রকৌশল ও স্থাপত্য নিয়ে প্যারিসে পড়াশোনা করেছেন। প্রকৃতি তাঁর দারুণ পছন্দের। তিনি হুয়াওয়ের ক্যাম্পাসে তাই প্রকৃতির সঙ্গে জ্ঞান অর্জনের এক অপূর্ব সম্মেলন ঘটিয়েছেন। তিনি এখানে তৈরি করেছেন হুয়াওয়ে ইউনিভার্সিটি। এখানে হুয়াওয়ের বিভিন্ন দেশের কর্মীরা পড়াশোনা করতে পারেন। এখানে নানা রকম কোর্স রয়েছে। এখানে পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিতে পারলে তবে পদোন্নতি পাবেন। রেন হুয়াওয়ের শীর্ষ পদে সাধারণত কাউকে দীর্ঘ মেয়াদে রাখার পক্ষে নন। সেখানে শীর্ষ পদে তিনজন নির্বাহী কর্মকর্তার বদল হয়। কৌশল, মানবসম্পদ ও আর্থিক বিষয়ে নিয়মিত রদবদল হয়। এ বিষয় তিনি একঝাঁক পাখির উড়ে চলার দৃশ্য থেকে বেছে নিয়েছেন। পাখির উড়ে চলার সময় একেকবার একেক পাখি সামনে আসে। তেমনি একজন সিইও সব সময় সব সামলাতে পারবেন বলে তিনি মনে করেন না।
হুয়াওয়ের বর্তমান প্রধান নির্বাহী রিচার্ড ইউ বলেন, তাঁদের বর্তমান স্মার্টফোনের নকশায় প্রকৃতির ওই অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে। যেমন মেট ২০–এর নকশার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে পানির প্রবহমানতার নকশা। স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮৭ সালে চীনের শেনঝেন শহরে প্রথম কার্যক্রম শুরু করে। যখন এর যাত্রা শুরু হয়, তখন প্রতিষ্ঠাতা রে ঝেংফেইয়ের হাতে ছিল মাত্র ৫ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার। হুয়াওয়ে শব্দটির অর্থ সাফল্য বা সফলতা। ৪২ বছর বয়সে একটি নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার মতো সাহস এবং উদ্যম আসলেই অবাক করার মতো। ঠিক এই কাজই করে দেখিয়েছেন হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা।
প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে কাজ করছেন প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কর্মী। হুয়াওয়ে মূলত একটি কর্মী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে দূরে থাকতে প্রতিষ্ঠানটি এই কৌশল ব্যবহার করেছে। হুয়াওয়ের প্রায় ৬৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক মূলত এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। সুনির্দিষ্ট নিয়মের মাধ্যমে কর্মীদের মধ্যে মুনাফার বিষয়টি বণ্টন করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে কর্মীদের অবসর, কর্মদক্ষতাসহ বেশ কিছু বিষয় মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। হুয়াওয়ে তাদের মোট কর্মীর বেশির ভাগই গবেষণা ও উন্নয়নে কাজে লাগায়।