বছর দুই পর সরাসরি হওয়া কনজ্যুমার ইলেকট্রনিকস শোতে কি এবার বড় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের দাপট কিছুটা কম? প্রদর্শনীতে স্যামস্যাং, সনি, মাইক্রোসফট, গুগল, এলজির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি ছোট অনেক প্রতিষ্ঠানই চমকে দিচ্ছে উপস্থাপনায়, আয়োজনে। কিন্তু এখানকার সবই যে একেবারে প্রযুক্তিজগৎ পাল্টে দেওয়া নতুন উদ্ভাবন, তা নয়। এখানকার একটা বড় অংশজুড়ে আছে টিভির পর্দা আরও কত সূক্ষ্ম, পাতলা আর বড় হবে—এসব বিষয়। বেশির ভাগই বর্তমান প্রযুক্তির হালনাগাদ।
তবে চোখধাঁধানো উদ্ভাবন দেখতে হলে যেতে হবে সিইএসের মূল প্রাঙ্গণ লাস ভেগাস কনভেনশন সেন্টার থেকে একটু দূরে। ভেনেটিয়ান প্রদর্শনী কেন্দ্রে আছে অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিষ্ঠান আর স্টার্টআপের (ধারণা ও প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন উদ্যোগ) প্রদর্শন। ‘ইউরেকা’ জোনের নামের সার্থকতা বুঝতে সময় লাগবে না বেশি। এ অংশে অত চাকচিক্য নেই। ছোট ছোট স্টলে গাদাগাদি বসে আছে ৭২১টি স্টার্টআপের বেশির ভাগ। আট ফুট বাই আট ফুট স্টলে দুনিয়া পাল্টে দেওয়ার একেকটা স্বপ্ন।
স্টার্টআপ জোনেও কোরীয়দের দাপট। এরপর তাইওয়ান, জাপানের পাশাপাশি এ বছর ফ্রান্সের অনেক স্টার্টআপ অংশ নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবনী প্রকল্পের জন্য আছে আলাদা জায়গা। শিক্ষার্থী আর শিক্ষকেরা একসঙ্গে তৈরি করেছেন অসাধারণ প্রকল্প। তাইওয়ানের জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওয়াঙ লিও প্রথম আলোকে জানান, তাদের দেশের সরকার সিইএসকে আলাদা করে গুরুত্ব দেয়। প্রায় বছরব্যাপী বাছাইয়ের পর সরকার তাদের সিইএসের জন্য নির্বাচন করে। এ জন্য তাইওয়ানে জাতীয়ভাবে সিইএস উদ্ভাবনী পুরস্কার চালু রয়েছে।
যুদ্ধরত দেশ ইউক্রেনের ১২টি স্টার্টআপ অংশ নিচ্ছে তাদের সরকারের সহযোগিতায়। নাজার ট্রফিচোক এসেছেন কফির উচ্ছিষ্ট থেকে কাজের জিনিস বানানোর একটি প্রকল্প নিয়ে। গাছের পাতা থেকে কাগজ বানানোর প্রযুক্তিও দেখাচ্ছেন তাঁরা। যুদ্ধদিনে এই অংশগ্রহণ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনী যুদ্ধ করছে। এর মধ্যে কাজ বা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থাকবে না কেন!’
স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোতে মূলত স্বাস্থ্য, পরিবেশবান্ধব, বিদ্যুৎসাশ্রয়ী প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ–চালিত যানবাহন ও রোবটের প্রকল্পই বেশি দেখা যাচ্ছে। স্টার্টআপে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান জেলোপের স্টলে দর্শকদের ভিড় তাদের অংশীদার লিমবার তৈরি বুদ্ধিমান রোবট প্রাণী লুনাকে ঘিরে। লুনা পোষা বিড়ালের মতোই অনুভূতি দেখাতে পারে। ফ্রান্সের পিকহুইল নিয়ে এসেছে শুধু পা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এমন একটি বাহন, যেটি আলোকচিত্রীদের কাজে লাগবে, এমনকি বড় বড় কারখানায় কর্মীদের কাজে অনেক সহযোগিতা করতে পারবে। কোরীয়রা কে-পপ, কে-ড্রামাকে যেভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা পৃথিবীতে, সিইএসে অংশ নিতে এসে এই ‘কে’–এর ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। কোরিয়ার নতুন উদ্যোগগুলোকে ‘কে-স্টার্টআপ’ নামে পরিচয় করাচ্ছে তারা।
অনেক চীনা স্টার্টআপ থাকলেও বেশির ভাগই উৎপাদন ও বিপণনকেন্দ্রিক। সিইএসের শাটল বাসে সহযাত্রী চীনা বংশোদ্ভূত মার্কিন তরুণী উয়ো হুয়ান বলছিলেন, ‘কোরিয়ার পাশে চীনের স্টলগুলো দেখে লজ্জাই পাচ্ছিলাম। আমার দেশ বসে আছে অন্যদের উদ্ভাবনের আশায়—তারা উৎপাদন আর বাজারে নিয়ে যাবে শুধু।’
সিইএসে উদ্ভাবনের পাশাপাশি নিজেদের পণ্যের বিশ্বব্যাপী বাজার তৈরির চেষ্টা আছে সবার। ছোটদের চেয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানই এই বাজার তৈরিতে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিইএসে আছে ওয়ালটন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী গোলাম মুর্শেদ বলেন, ‘আমি পুরো সময় প্যাভিলিয়নেই থাকি। নানা দেশের লোকজন আসেন আর বাংলাদেশি একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপ্তি দেখে অবাক হন। বাংলাদেশকে অনেকেই এভাবে নতুন করে দেখছেন, এটা দেখে সত্যিই ভালো লাগে। তবে অনেকের সঙ্গেই ইতিবাচক কথা হচ্ছে। শুধু বাজার সম্প্রসারণ নয়, আমরা কথা বলছি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সম্ভাব্য সহযোগীদের সঙ্গেও। শিগগির যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওয়ালটনের বাংলাদেশি পণ্য যাবে। প্রযুক্তি দুনিয়ার এটি হবে বাংলাদেশের নতুন এক পথচলা।’
যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে চার দিনের এই প্রদর্শনী শেষ হবে আগামীকাল রোববার। এই আয়োজনে পৃথিবীর ১৬০টির বেশি দেশের ৩ হাজারের বেশি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে।