সাকিবের ফসল ডটকমে যুক্ত ১১ হাজার কৃষক
প্রথম দিন মাত্র ৫ কেজি বেগুন আর ১৫ কেজি পটল—মোট ২০ কেজি সবজির চাহিদা (অর্ডার) এসেছিল ফসল ডটকম নামের কৃষিপণ্য বিক্রির ই–কমার্স ওয়েবসাইটটিতে। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের কথা এটি। তিন বছরের ব্যবধানে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে এই ওয়েবসাইট থেকে বিক্রি হয় প্রায় ৮০ হাজার কেজি (৮০ টনের বেশি) সবজি।
শুরুতে যেখানে মাত্র দুজন কর্মী ছিলেন, এখন সেখানে প্রতিদিন তিন শতাধিক কর্মী কাজ করেন। ফসল ডটকমে যে কৃষকেরা পণ্য সরবরাহ করেছেন, তাঁরা প্রচলিত বিপণনব্যবস্থার চেয়ে বেশি আয় করেছেন। পাঁচ হাজারের বেশি খুচরা দোকানদার যুক্ত হয়েছেন প্ল্যাটফর্মটিতে।
ফসল ডটকমের উদ্যোক্তা সাকিব হোসাইন। পরে মো. মামুনুর রশীদকে অংশীদার বানিয়ে নেন। প্রথম তিন মাস সাকিব ও মামুনুর নিজেরাই কৃষিপণ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে মোড়কজাত ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছেন।
সাকিব দেখলেন পাঁচ টাকা পরিবহন খরচ বাড়ার অজুহাতে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। ঢাকার কারওয়ান বাজার এবং কাপ্তান বাজারে মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঘুরতেন তিনি।
কৈশোরেই উদ্যোক্তা
২০২১ সালে ফসল ডটকম চালু করলেও উদ্যোক্তা হিসেবে সাকিবের যাত্রা শুরু হয় ২০১২ সালে। তখন তিনি সপ্তম শ্রেণিতে পড়তেন, বয়স মাত্র ১২ বছর। এক বন্ধুর বড় ভাই ছিলেন মেরিন প্রকৌশলী। চীন থেকে তিনি সাকিবকে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্য এনে দিতেন। ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে সেগুলো বিক্রি করা হতো। এ কাজের পাশাপাশি তিনি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখেন। সফটওয়্যার ও অ্যাপ তৈরি করতে তাঁর ভালো লাগত। ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত তিনি অনলাইনে ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রি করতেন।
২০১৫ সালে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় সাকিব প্রিন্ট ভ্যালি নামে আরেকটি উদ্যোগ শুরু করেন। এই উদ্যোগের কাজ ছিল ছাপাখানা ও গ্রাহকদের একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা। যে বিশেষ সফটওয়্যারে এটি চালানো হতো, সেটিও তাঁর বানানো। ২০১৭ পর্যন্ত চলে প্রিন্ট ভ্যালি। মাসে তখন বিক্রি হতো তিন–চার লাখ টাকার পণ্য।
২০১৭ সালের শেষ দিকে সাকিব আলাদিন কিডস নামের একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন।ওখানে তিনি বিপণন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তী সময়ে শিশুদের জন্য অনলাইনে একটি বড় বাজার হিসেবে গড়ে ওঠে।
ফসল ডটকমের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে। ১৪টি জেলায় রয়েছেন পণ্য সংগ্রহ কেন্দ্র। এই কেন্দ্রগুলো থেকে কৃষকদের কাছ থেকে নগদ অর্থে পণ্য কেনা হয়।
করোনাকালে নতুন উদ্যোগ
করোনা মহামারির সময়ে সাকিবের ভাবনায় কৃষকদের নিয়ে কাজের আগ্রহ জাগে। গ্রাম ও শহরে কৃষিপণ্যের দামে বিস্তর পার্থক্য দেখে সিদ্ধান্ত নেন এটা নিয়ে কাজ করবেন। সাকিব দেখলেন পাঁচ টাকা পরিবহন খরচ বাড়ার অজুহাতে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। ঢাকার কারওয়ান বাজার এবং কাপ্তান বাজারে মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঘুরতেন তিনি।
ঢাকার পাইকারি বাজার দেখার পর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর–অক্টোবর মাস পর্যন্ত চষে বেড়ান বাংলাদেশের ৩৮টি জেলা। সরাসরি কথা বলেন নানা পর্যায়ের সাত শতাধিক কৃষকের সঙ্গে। বোঝার চেষ্টা করেন কৃষিপণ্যের সরবরাহপ্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে। সাকিব খেয়াল করেন, কৃষকেরা তাঁদের পণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। অন্যদিকে বাজারে ক্রেতা চড়া দামে পণ্য কিনছেন। সাকিব ভাবলেন, তিনি যদি ন্যায্যমূল্যে কৃষকের সব পণ্য কিনে ফেলতে পারেন, তাহলে তাঁদের অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব। সেই চিন্তা থেকেই ফসল ডটকমের জন্ম।
২০২০ সালের শেষ দিকে ফসল ডটকমের কার্যক্রম শুরু করেন সাকিব। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। বর্তমানে ১১ হাজারের বেশি কৃষকের উৎপাদিত সবজি কিনে নিজস্ব পরিবহনে ঢাকার সব কাঁচাবাজারে সরবরাহ করছে সাকিবের হোসাইনের এই উদ্ভাবনী উদ্যোগটি (স্টার্টআপ)।
আমরা চেষ্টা করছি বাংলাদেশে এমন একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করতে, যেটি ব্যবহার করে আমরা প্রত্যেকেই উপকৃত হব।সাকিব হোসাইন, উদ্যোক্তা, ফসল ডটকম
ঢাকার বিভিন্ন কাঁচাবাজারে ফসল ডটকমের বিক্রয়কর্মীরা প্রতিদিন পণ্যের চাহিদা গ্রহণ করেন। সে অনুযায়ী ভোর পাঁচটার মধ্যে নিজস্ব পরিবহনে পণ্য পৌঁছে যায় খুচরা বিক্রেতার কাছে। শুধু ঢাকায় নয়, ফসল ডটকম দেশের ৩৫টি জেলায় পণ্য সরবরাহ করে থাকে।
ফসল ডটকমের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে। ১৪টি জেলায় রয়েছেন পণ্য সংগ্রহ কেন্দ্র। এই কেন্দ্রগুলো থেকে কৃষকদের কাছ থেকে নগদ অর্থে পণ্য কেনা হয়। শাকসবজি মোড়কজাত করার জন্য ঢাকার মহাখালীতে আছে ফসলের কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র। এমন কেন্দ্র ঢাকার বাইরে আছে আরও আটটি। রাজধানীর অধিকাংশ কাঁচাবাজারে ফসল ডটকম পণ্য সরবরাহ করে। এ ছাড়া বড় বড় সুপারশপ, যেমন ডেইলি শপিং, মীনাবাজার এবং ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান ফুড পান্ডা, চালডাল, দারাজ ছাড়াও প্রায় ২০০ রেস্তোরাঁয় কৃষকের পণ্য সরাসরি পৌঁছে দিচ্ছে ফসল।
২৪ বছর বয়সেই নতুন উদ্যোগে সফল
একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কৃষিপণ্য নিয়ে কেন কাজ করছে? ফসল ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা ২৪ বছর বয়সী সাকিব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৃথিবীর যত বড় বড় স্টার্টআপ কোম্পানি রয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই কোনো একটা সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদেরও একটা সমস্যা থেকে “ফসল”–এর ধারণা মাথায় আসে। সমস্যাটা হলো কৃষকের ন্যায্য দাম না পাওয়া। এর সমাধানে প্রচলিত ব্যবস্থা থেকে সরে এসে উদ্ভাবনী কিছু করার চেষ্টা করেছি।
২০১৯ সালে ঢাকার আইডিয়াল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার পর তেজগাঁও কলেজে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন সাকিব। তবে নিজের উদ্যোগ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় কয়েক দিন ক্লাস করার পর পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে সাকিব বলেন, ‘পরিকল্পনা একটিই। কৃষক এবং ভোক্তা—দুই পক্ষের সঠিক মূল্যায়ন। আমরা একটি লক্ষ্যে এগোচ্ছি। প্রতিবছরের জন্যই আমাদের কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি বাংলাদেশে এমন একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করতে, যেটি ব্যবহার করে আমরা প্রত্যেকেই উপকৃত হব।’
এসেছে বিনিয়োগ, পেয়েছে পুরস্কার
পরিকল্পনা একটিই। কৃষক এবং ভোক্তা—দুই পক্ষের সঠিক মূল্যায়ন। আমরা একটি লক্ষ্যে এগোচ্ছি। প্রতিবছরের জন্যই আমাদের কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি বাংলাদেশে এমন একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করতে, যেটি ব্যবহার করে আমরা প্রত্যেকেই উপকৃত হব।সাকিব
প্রসঙ্গত, ফসল ডটকমের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এরই মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী (ভেঞ্চার ক্যাপিটাল) প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১০ কোটি টাকার ‘প্রি-সিড’ স্তরের বিনিয়োগ পেয়েছে ফসল ডটকম। গত বছর ই–কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সেরা কৃষিপ্রযুক্তি শ্রেণিতে ‘ই-কমার্স মুভার্স (ইকমা)’ পুরস্কার পেয়েছে ফসল ডটকম।